সাতক্ষীরা: সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার সুন্দরবন সংলগ্ন কৈখালী সীমান্ত এলাকা দিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সহকারীসহ তিন প্রভাবশালী ভারতে পালিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্থানীয় চোরাকারবারিদের সহায়তায় ভারতে প্রবেশের পর দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে ওই তিন ব্যক্তিসহ আরও আটজন আটক হয়েছেন বলে জানা গেছে।
গত ১১ অক্টোবর সীমান্তে পৌঁছালেও দালালের আস্তানা ও সুন্দরবন হয়ে তিন দিন পর তারা ভারতে প্রবেশ করেন বলে সূত্রের দাবি।
খবরটি ছড়িয়ে পড়ায় কৈখালী সীমান্তজুড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি বৃদ্ধি পেয়েছে।
ভারতে পালানো এসব ব্যক্তির মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত এক সহকারীসহ তার চাচাতো ভাইয়ের ব্যবসায়িক অংশীদারও রয়েছেন বলে দাবি স্থানীয়দের।
তাদের অভিযোগ, স্থানীয় একটি সিন্ডিকেট মাথাপিছু এক লাখ ৭০ হাজার টাকা চুক্তিতে তিন প্রভাবশালীকে সীমান্ত পার করে দেয়। তবে তিন প্রভাবশালীর ব্যবহৃত ‘নিশান’ ব্র্যান্ডের দামি একটি মাইক্রোবাস, তিনটি ট্রাভেল ব্যাগসহ তাদের মোটা অংকের অর্থ দালাল চক্রের হেফাজতে রয়ে গেছে।
অন্যদিকে ভারতে প্রবেশের পর ওপারের দালাল রবিসহ অনুপ্রবেশকারীদের আটকের ঘটনায় সীমান্তের চোরাচালানে জড়িতদের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে। নির্বিঘ্নে পারাপারের রুটে হঠাৎ ‘চালান’ আটকে যাওয়ায় প্রতিপক্ষকে দুষছে দালাল চক্রটি। বিষয়টি নিয়ে চোরাচালানে জড়িত স্থানীয় পক্ষগুলোর মধ্যে ইতোমধ্যে একাধিকবার সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে।
সীমান্ত এলাকা ঘুরে ও স্থানীয়দের পাশাপাশি চোরাকারবারে জড়িতদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য মিলেছে। এ ছাড়া ভারতীয় অংশের হেমনগর কোস্টাল থানার এক পুলিশ কর্মকর্তার ফাঁস হওয়া অডিও রেকর্ড বিষয়টিকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে।
তথ্য সূত্রে জানা যায়, ভারতে পালানো তিন প্রভাবশালীর মধ্যে দু’জনের নাম সাব্বির হোসেন ও আশিকুর রহমান শিমুল। তাদের বাড়ি যশোর ও গোপালগঞ্জে। তৃতীয় ‘হাই প্রোফাইল’ ব্যক্তি ঢাকার বাসিন্দা বলে দাবি পাচারকারী চক্রের এক সদস্যের। তার দাবি, নাম প্রকাশ না করে সুদর্শন তৃতীয় ব্যক্তিকে তাদের কাছে ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের’ মানুষ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, তিন প্রভাবশালীকে ভারতে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয় কৈখালী সীমান্তের চিহ্নিত চোরাকারবারি মামুন কয়াল, রেজাউল, রফিকুল ইসলাম নেদা, শফিকুল ও রবিউলকে। এর আগে কালিগঞ্জ উপজেলার নলতা হাসপাতাল এলাকার জনৈক শাহিন ভেটখালীর আব্দুস সবুরের মাধ্যমে পাঁচ লাখ ১০ হাজার টাকায় চুক্তিবদ্ধ হয় চক্রটির সঙ্গে।
জানা যায়, সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ার পর গত ৮ অক্টোবর তিন প্রভাবশালীকে সীমান্তে জড়ো করা হয়। প্রথমদিন বাবলু নামে এক দালালের বাড়িতে অবস্থানের পরদিন ভোরে নৌকাযোগে তাদের সুন্দরবনের ভারতীয় অংশে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে দু’দিন অবস্থানের পর তৃতীয় দিন সুযোগ বুঝে ভারতীয় অংশে পৌঁছে দেওয়া হলেও ঘটনাচক্রে তারা বিএসএফের হাতে আটক হন।
এদিকে নির্ভরযোগ্য সূত্রে তথ্য মিলেছে, তিন প্রভাবশালীকে ভারতে পার করার আগে চক্রের অন্যতম সদস্য শফিকুল ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে। তিনি ভারতের হেমনগর কোস্টাল থানার কালিতলা এলাকায় লিয়াকত গাজীর জামাতা। সেই সুযোগে শফিকুল এপাশে তার ভাই রেজাউলসহ তিন সহকর্মী মামুন, নেদা ও রবিউলকে দায়িত্ব দিয়ে প্রভাবশালীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আগে পৌঁছে ভারতীয় অংশে অবস্থান নেন।
সূত্রের দাবি, তিনজনকে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা করিয়ে দিয়ে শাহিন ও সবুরসহ অন্যরা উপরে উঠে যান। মাইক্রোবাস নিজেদের হেফাজতে রাখার নির্দেশনা থাকলেও গচ্ছিত অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে ভারতে পাঠাবেন তারা। তবে ভারতীয় অংশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে তিন প্রভাবশালীর আটকের ঘটনায় কিছুটা বেকায়দায় পড়েছে দালাল চক্রটি।
ওপারের কোস্টাল থানার ছোট বাবুর (দারোগা) ফাঁস হওয়া একটি ফোনালাপ থেকে জানা যায়, তিন প্রভাবশালীর সঙ্গে থাকা দুই নারীসহ দুই শিশুকে ছেড়ে দেয় থানা কর্তৃপক্ষ। একই চোরাকারবারি চক্রের মাধ্যমে অবৈধভাবে ভারতে পৌঁছানো ওইসব ব্যক্তিরা ভারতীয় নাগরিক হওয়ায় যাচাই-বাছাই শেষে কোর্টে না পাঠিয়ে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। ফোনালাপের একটি অংশে তিন প্রভাবশালীর একজনের বিষয়ে ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে ‘শেখ হাসিনার চাচাতো ভাইয়ের ব্যবসার অংশীদার’ শব্দ ব্যবহার করতেও শোনা যায়।
এদিকে ‘চালান’ আটকে যাওয়ার পর মামুন ও নেদা লোকজন নিয়ে গত শনিবার ও সোমবার দুই দফা প্রতিপক্ষ আরজ খান ও তার পরিবারের ওপর হামলা করেন বলে অভিযোগ উঠেছে। আরজ খানের সঙ্গীদের দেওয়া তথ্যের কারণে ওপারে পৌঁছে লোকজন ধরা পড়েছে অভিযোগ তুলে তাকে হত্যার হুমকি দিয়েছে দালাল চক্রটি।
আরজ খান বলেন, অসুস্থতার কারণে আমি বাড়িতে শয্যাশায়ী। অথচ অবৈধভাবে ভারতে পাড়ি জমানো কয়েকজনকে বিএসএফ আটক করলেও আমাকে দায়ী করা হচ্ছে।
আরজের দাবি ইতোপূর্বে একই চক্রের সাথে চোরাচালানে জড়িত থাকলেও অসুস্থতার পর থেকে তিনি এসব অন্যায় থেকে সরে এসেছেন।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে চক্রের সদস্য সফিকুল ইসলাম বলেন, তিনজন ভিআইপিকে বিএসএফ আটক করে হিঙ্গলগঞ্জ থানায় দেয় বলে শুনেছি। ভারতে অবস্থানের কথা সত্য হলেও আমি নিজে জড়িত না। তাছাড়া কারা কোন এলাকা দিয়ে তাদের ওপারে পাঠিয়েছে, সে বিষয়ে কিছু জানি না।
মামুন কয়াল জানান, তিনি অবৈধভাবে এসব পারাপারে জড়িত না। ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের জেরে রফিকুল ওরফে নেদা আরজকে মারার হুমকি দিচ্ছে বলেও দাবি তার। তবে সেই ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের কারণ জানতে চাইলে তিনি পরে কথা বলবেন বলে জানান।
তবে, এ বিষয়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এর পক্ষ থেকে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
যদিও শ্যামনগর থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) ফকির তাইজুর রহমান বলেন, সীমান্ত পথে অবৈধভাবে ভারতে যাওয়ার বিষয়ে পুলিশের কাছে কোনো তথ্য নেই। তবে হামলা সংক্রান্ত একটি লিখিত অভিযোগ পেয়ে একজন উপপরিদর্শককে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ২১৩১ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৩, ২০২৪
এমজেএফ