ফেনী: স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পদত্যাগের একদফা দাবিতে গত ৪ আগস্ট ফেনীর মহিপাল ছাত্র-জনতার অবস্থান কর্মসূচিতে নির্বিচারে গুলি চালায় আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা। এতে গুলিবিদ্ধ হন মো. জগলু মিয়া রিয়াজ (২২) ও তাজুল ইসলাম (৩৩) নামের দুই ছাত্র।
ছয় মাস পেরিয়ে গেলে গুলিবিদ্ধ ওই দুই যুবকের মামলা নিতে গড়িমসি করছে ফেনী থানা পুলিশ। অভিযোগ দায়েরের পর দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও মামলা নথিভুক্ত না করে উল্টো আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলার অভিযোগ উঠেছে।
মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ভুক্তভোগীদের হয়রানি করার অভিযোগ উঠেছে ফেনী মডেল থানার ওসি মর্ম সিংহ ত্রিপুরার বিরুদ্ধে।
ভুক্তভোগী গুলিবিদ্ধ দুই যুবকের মধ্যে মো. জগলু মিয়া রিয়াজ ফেনী শহরের মধ্যম চাড়ীপুর এলাকার বাসিন্দা মৃত মো. ইলাছ মিয়ার ছেলে এবং তাজুল ইসলাম জেলার সোনাগাজী উপজেলার বিষ্ণপুর গ্রামের সিরাজ উদ্দিনের ছেলে।
এদের মধ্যে জগলু মিয়া রিয়াজ কয়েকদিন পূর্বে সব তথ্য-প্রমাণাদি নিয়ে ফেনী পুলিশ সুপারের কাছে গিয়ে ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা করেন। তাৎক্ষণিক ওসিকে নিজ কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে মামলাটি দ্রুত এন্ট্রি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন পুলিশ সুপার মো. হাবিবুর রহমান।
এরপর মামলা হয়ে গেছে উল্লেখ করে বাদীর কাছে দুই দিন সময় চান ওসি মর্ম সিংহ ত্রিপুরা। পরবর্তীতে বাদী রিয়াজকে কল করে ডাকা হবে জানিয়ে ওইদিন চলে যেতে বলেন।
নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও ওসির ফোন না পেয়ে পুনরায় থানায় গিয়ে বিষয়টি জানতে চান রিয়াজ। এজহারে ৩২, ৩৩ ও ৩৪ নং আওয়ামী ফ্যাসিস্ট আসামিদের জামায়াত-বিএনপির লোক দাবি করেন ওসি। তাদের নাম বাদ দিয়ে রিয়াজকে এজহার সংশোধন করে আনার কথা বলে থানা থেকে বের করে দেওয়া হয়।
পরবর্তীতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত ওই তিন আসামির রাজনৈতিক পরিচয়সহ যাবতীয় প্রমাণপত্র সংগ্রহ করে একই দিন ওসির কাছে হাজির করেন আহত রিয়াজ।
এরপর ওসি মর্ম সিংহ ত্রিপুরা এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে রিয়াজকে বাড়িতে চলে যেতে বলেন। এভাবে গত এক মাস ধরে বারবার থানায় গিয়ে অনেক চেষ্টা করেও পুলিশ মামলাটি না নেওয়ায় চরম হতাশ ও ক্ষুব্ধ আহত মো. জোগলু রিয়াজ।
তিনি জানান, ঘটনার দিন নোমান নামে স্থানীয় এক বড় ভাইয়ের ডাকে উত্তর চাড়ীপুর এলাকার আবুল কালামের ছেলে আশরাফুলসহ তারা ৪/৫ জন মিলে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পদত্যাগের একদফা দাবির আন্দোলনে যোগ দেন। দুপুরে সবাই নামাজ পড়ার জন্য ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে মহিপাল ফ্লাইওভারে নিচে দাঁড়ান। আশরাফুলসহ তারা বেশ কয়েকজন নিরাপত্তা দিচ্ছিলেন। নামাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শহরের দিক থেকে একদল আওয়ামী সন্ত্রাসী মহিপাল প্লাজার সামনে গিয়ে রিয়াজসহ ছাত্র-জনতাকে উদ্দেশ্য করে নির্বিচারে গুলি চালাতে থাকে। এসময় আন্দোলনকারীরা এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করে বাঁচার চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে তারা কয়েকজন মহাসড়কে হাজারী রোডের মাথায় পৌঁছলে একটি গুলি এসে লাগে তার পায়ে। তিনি পড়ে যান রাস্তায়।
এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সঙ্গে থাকা আশরাফুল ও নোমান জানান, ওই ঘটনার সময় স্কুলে পুলিশ সদস্যরা থাকলেও তারা এর কোনো প্রতিকার না করে নীরব ভূমিকা পালন করছিলেন। পরে সেখান থেকে গুলিবিদ্ধ রিয়াজকে উদ্ধার করে তারা দুজন মিলে প্রথমে ফেনী জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু সেখানে অবস্থানরত একদল আওয়ামী সন্ত্রাসী তাদের ভেতরে ঢুকতে না দিয়ে উল্টো মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে চলে যেতে বাধ্য করে।
তারা জানান, বিভীষিকাময় ওই পরিস্থিতিতে কোনো উপায় না দেখে রিয়াজকে নিয়ে তারা হাজির হন শহরের সালাউদ্দিন মোড়ে মেডিল্যাব হাসপাতালে। সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার চিকিৎসকরা রিয়াজের বামকাঁধে বিদ্ধ গুলিটি বের করে কোনো টাকা পয়সা না নিয়ে শুধুমাত্র সন্ত্রাসীদের ভয়ে দ্রুত হাসপাতাল ছেড়ে চলে যেতে বলেন।
তারা আরও জানান, পরবর্তীতে ওখানকার ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে তাৎক্ষণিক ফিরে গেলেও দুই দিন পরপর ক্ষতস্থান ড্রেসিং করার জন্য ওই হাসপাতালে যেতে হয়েছে রিয়াজকে। এ অবস্থায় প্রায় ২৫/২৬ দিন ব্যান্ডেজ ছিল রিয়াজের শরীরে।
আহত মো. জগলু মিয়া রিয়াজ জানান, এরপর ফেনীতে আকস্মিক বন্যার কারণে নিজ জেলায় গিয়ে প্রায় একমাস পর সুস্থ হয়ে ফিরে এসে থানায় গিয়ে মামলা করতে চাইলে ফেনী মডেল থানার তৎকালীন ওসি সরকার পতনের পর বিক্ষুব্ধ জনতার আগুনে তাদের সবকিছু পুড়ে যাওয়ার কারণে ওই সময় মামলা নিতে অপারগতা জানান ও তাকে পরবর্তীতে যোগাযোগ করতে বলেন।
তার কয়েকদিন পর আস্তে আস্তে থানার কার্যক্রম শুরু হলে পুনরায় থানা গিয়ে এ ব্যাপারে যোগাযোগ করলে ‘প্রথমে তারা হত্যা মামলাগুলো নিয়ে কাজ করছেন’ উল্লেখ করে তাকে আরও কয়েকদিন পর আসতে বলেন। এভাবে প্রায় ৪/৫ মাস পেরিয়ে যাওয়ার পর গত ১৫ জানুয়ারি চিকিৎসার সকল কাগজপত্র ও গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তোলায় ছবিসহ ফেনীর সাবেক সংসদ সদস্য ও পতিত গডফাদার নিজাম উদ্দিন হাজারী ও তার সহযোগী শুসেন চন্দ্র শীল, নজরুল ইসলাম স্বপন মিয়াজী, মেজাবাহুল হায়দার চৌধুরী সোহেল, জানে আলম ভূঞাসহ ৮০ জনের নাম উল্লেখ করে থানায় একটি লিখিত অভিযোগ জমা দিতে সক্ষম হন রিয়াজ।
তারপর অন্তত একসপ্তাহ ধরে ফেনী মডেল থানার বর্তমান ওসি মর্ম সিংহ ত্রিপুরা নান্য তালবাহানা করে মামলাটি নিতে কালক্ষেপণ করতে থাকেন। বিষয়টি অবগত করতে এ সংক্রান্ত সকল প্রমাণপত্র নিয়ে জেলায় কর্মরত এক সাংবাদিকের সহযোগিতায় গত ২২ জানুয়ারি ফেনীর পুলিশ সুপার মো. হাবিবুর রহমানের সঙ্গে তার কার্যালয়ে গিয়ে ঘটনার বিস্তারিত জানান রিয়াজ।
ওইদিন তাৎক্ষণিক ওসিকে নিজ কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে রিয়াজের সামনেই মামলাটি এন্ট্রি করার নিদের্শ দেন পুলিশ সুপার। আহত রিয়াজের অভিযোগ, এরপর দীর্ঘ প্রায় একমাস হতে চললেও পুলিশ সুপারের নির্দেশনার তোয়াক্কা না করে আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা খেয়ে ওসি মর্ম সিংহ ত্রিপুরা তার মামলাটি এন্ট্রি না করে উল্টো আসামিদের সঙ্গে গোপনে সখ্য গড়ে তুলছেন। যার কারণে অনেকটা ক্লান্ত হয়ে গত সপ্তাহেও পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে গিয়ে তাকে না পেয়ে হতাশা নিয়ে ফিরতে হয়েছে।
এর আগে গত ৩০ অক্টোবর একই ঘটনায় গুলিবিদ্ধ তাজুল ইসলামবাদী হয়ে নিজাম উদ্দিন হাজারীসহ ফেনীর বিভিন্ন উপজেলায় আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ১৮৩ জনের নাম উল্লেখ করে ফেনী মডেল থানায় আরও একটি এজহার দাখিল করেছিলেন।
দীর্ঘ ৩/৪ মাসেও মামলাটি এন্ট্রি না হওয়া ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করে বাদী তাজুল ইসলাম জানান, স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পদত্যাগের একদফা দাবিতে গত ৪ আগস্ট মহিপালে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের অংশ নিয়ে আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের ছোড়া রাইফেলের একটি গুলি তার এক হাটুর ওপরের অংশ দিয়ে ঢুকে অপর হাঁটুর ওপরের অংশ গিয়ে বিঁধে।
এরপর রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে ফেনী জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা অনীহা প্রকাশ করে। পরবর্তীতে শহরের আল-কেমি হাসপাতালে নেওয়া হলে এক্স-রে করার পর তারাও গুলিটি বের করতে ভয়ে রাজি হয়নি।
এক পর্যায়ে অপারগ হয়ে ওই রিপোর্ট নিয়ে নিজ এলাকার বাপ্পি মেডিকেল হলে পল্লী চিকিৎসক মোহাম্মদ আইয়ুব আলীর কাছে গেলে তিনি গোপনে তাহার চেম্বারে অপারেশন করে গুলিটি বের করেন। সুস্থ হয়ে এ ব্যাপারে ফেনী মডেল থানায় মামলা দায়ের করতে গিয়ে পুলিশের অসহযোগিতার কারণে হতাশ হয়ে ফিরতে হয়েছে তাকে।
সোমবার (১০ ফেব্রুয়ারি) মোবাইলফোনে এসব বিষয়ে জানতে ফেনী মডেল থানার ওসি মর্ম সিংহ ত্রিপুরাকে কল করা হলে থানার ওসি (তদন্ত) মো. ইকবাল হোসেন রিসিভ করেন। এখনও মামলা হয়নি বলে স্বীকার করেন।
তিনি বলেন, ওসি স্যার নোয়াখালীতে ট্রেনিংয়ে গিয়েছেন। অভিযোগগুলোর তদন্ত চলছে। তিনি ফিরে এলে মামলা নেওয়া হবে।
নির্দেশের পরও থানায় দেওয়া অভিযোগের প্রেক্ষিতে মামলা না হওয়ার বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে এ বিষয়ে পুলিশ সুপার মো. হাবিবুর রহমানের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ সময়: ০৯২৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২৫
এসএইচডি/এসএএইচ