গাজীপুর থেকে ফিরে: ভাই, এই অফিসে টেলিফোন নেই একটিও। অন্য যে কোনো রেঞ্জ থেকে তথ্য বিনিময় কেবল মোবাইল ফোনের মাধ্যমেই হয়।
চাকরির বয়স ৩১ বছরের, সেই ১৯৮৩ সাল থেকে। এই দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় সারা বাংলাদেশে কাজ করা হয়েছে। সেই আলোকে এ কথাগুলো বলা। বিষয়টি আশ্চর্যের মনে হলেও এটাই বাস্তবতা।
বাংলানিউজকে কথাগুলো বলছিলেন জহিরুল হক (৫৬)। ঢাকা বন বিভাগের রাজেন্দ্রপুর রেঞ্জের অফিস; গাজীপুরের পাঁচটি উপজেলার মধ্যে শ্রীপুরে। এই উপজেলা সদর থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ চার লেনের রাস্তা ঘেঁষে অনেকটা ভেতরের দিকে এই রেঞ্জের কার্যালয়। জায়গার নাম সালনা বাজার। এটি মূলত বিট ও চেক স্টেশন কর্মকর্তার কর্মস্থল। কাজ; বনজ দ্রব্য পরীক্ষণ ও সুবিশাল ভাওয়াল বনের বিভিন্ন প্রজাতির গাছের কাঠ বৈধ কি-না তা চেক করা। সে হিসেবে এই চেক পোস্টের গুরুত্ব অনেক।
সম্প্রতি ঘন কুয়াশা ভেজা শীতের এক শুক্রবারে সরেজমিন দেখা গেল, গুরুত্ববহ এই কার্যালয় সামাল দিচ্ছেন জহিরুল হক। তার পোস্ট ডেপুটি রেঞ্জার। জানার জন্য আরও বিস্তারিত কথা হলো তার সঙ্গে।
তিনি বলেন, আমরা এখানে মোট ৯ জন কাজ করি। এরমধ্যে ১ জন ফরেস্টার, ফরেস্ট গার্ড ৩ জন ও বাগান মালি ৪ জন, যা প্রয়োজনের তুলনায় কতটা কম এ নিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। কাজ চলছে। চালিয়ে নিচ্ছি আরকি।
আরেকটি বিষয় তিনি উল্লেখ করেন, তা হলো পরিবহন ব্যবস্থা। ‘ম্যানেজ’ করা মোটরসাইকেলে কাজ চালান, আবার অনেক সময় টেম্পু-লেগুনা ভাড়া করে যান রেঞ্জের আওয়াভুক্ত বন-বাদাড়ে। এটিকে তিনি সমস্যা হিসেবে মনে না করলেও জানান, যখন অবৈধ কোনো ট্রাক বনের কাঠ চুরি করে বা ট্রানজিট পাস ছাড়া এই রাস্তা পার করবে এমন তথ্য পেয়েও তাদের আটকানো সম্ভব হয় না শুধুমাত্র পরিবহন সমস্যার কারণে। আর তখন খুব খারাপ লাগে। ইতোপূর্বে এ ধরনের ঘটনা অনেক ঘটেছে বলেও জহিরুল হক জানান।
এক প্রশ্নের জবাবে দেশের বনভূমি ও এর বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে সিনিয়র এই বন কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের দেশে বনভূমি দখল হচ্ছে। স্বাধীনতার পর থেকে যার শুরু। এর পাশাপাশি গাছ-বৃক্ষের প্রতি ঝোঁক নেই মানুষের। সঙ্গে শিল্পায়নের জন্য বন হুমকির মুখে।
‘দেশের সাধারণ মানুষ গাছ কেটে টিনশেড ঘর হলেও তোলে, আর দেশের বড়লোকরা গাছ কেটে কারখানা, ইট-ভাটা এ সব তৈরি করে’ বলেন তিনি।
এই রূঢ় বাস্তবতা মেনে দেশের বন যেটুকু টিকে আছে তার জন্য বন বিভাগের অবদান অনস্বীকার্য বলেও মত জহিরুল হকের।
নিজের অফিস রাজেন্দ্রপুর রেঞ্জের আওতায় কী ধরনের বৃক্ষরাজি রয়েছে এবং সেগুলোর বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, কপিচ বন (শাল, গজারি গাছের চারা) এই অঞ্চলের অন্যতম সম্পদ। এছাড়া আকাশমনি, বড় বড় শাল, গজারি গাছ, ভাওয়াল স্টেট, সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে ছোট ছোট টিলাও এখানকার সম্পদ। আর এসবই বন বিভাগের আওতায়।
তিনি বলেন, ১৯৭৪ সালে এই অঞ্চলে ঘন গজারি বন ছিল, যা এখন সংরক্ষের আওয়াভুক্ত। ভাবতেও অবাক লাগে একটি দেশে একটা সময়কার এতো বনভূমি আজ শুধুই স্মৃতি। পাশের মওলানা বাড়ি জামে মসজিদ থেকে মাইলের পর মাইল শুধু বনই ছিল এক সময়, যা এখন শুধুই স্মৃতির পাতায়।
গাছপালা, বনকে বাঙালি ভূমি থেকে স্মৃতিতে স্থান দিয়েছে বলেই জলবায়ু পরিবর্তনের মতো ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে বলে মত তার।
নিজের ব্যক্তি জীবন নিয়ে জহিরুল হক বলেন, আমি তো অফিসেই বিছানা পেতে থাকি। সালনায় যে জায়গাটায় আমার রেঞ্জ অফিস তার পেছনে ঘন বনাঞ্চল। পাখিদের কলতান, ছিমছাম নীরবতার মায়া। এ সব মিলিয়ে এক অ্যাডভেঞ্চার জীবন আমার।
তিনি বলেন, নিজেরাই রান্না করে খাই। সারা দিন-রাতই অফিস, সারা দিন-রাতই অবসর। আসলে চাকরিটাই এমন। ঢাকায় আমার পরিবার থাকে। দুই ছেলে আমার। বড় ছেলে অনার্সে আর ছোট ছেলে এইচএসসি (উচ্চ মাধ্যমিক) দেবে।
ইচ্ছে ছিল সেনা কর্মকর্তা হওয়ার; হয়েছেন বন কর্মকর্তা, এমনটা জানিয়ে জহিরুল হক কথার ইতি টেনে বলেন, ভাগ্য কেন জানি সেনাবাহিনীতে সহায় হয়নি আমর। আমি অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ করি। আমার চাচা রেজওয়ান আলী ব্রিটিশ আমলে আসাম ফরেস্টে চাকরি করতেন। তাকে দেখে উৎসাহে এই পেশায় আসা। একটি নীরব ও নিভৃত জীবনের হাতছানি পাই সর্বদা, এটাই বেঁচে থাকার আনন্দ।
বাংলাদেশ সময়: ১০৩৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৯, ২০১৫