ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

বাবলাবন গণহত্যা

স্মৃতিফলকই ধরে রেখেছে ৪৪ বছরের ইতিহাস!

শরীফ সুমন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৪৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১২, ২০১৫
স্মৃতিফলকই ধরে রেখেছে ৪৪ বছরের ইতিহাস! ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

রাজশাহী: মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির এক গর্বিত ইতিহাস। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের নারকীয় গণহত্যা, নারী নির্যাতন, লুটতরাজ ও অন্যান্য ধ্বংসযজ্ঞের বিবরণ খুব কমই প্রকাশিত হয়েছে।

সংরক্ষণ করা যায়নি দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা গণহত্যার সব ক্ষত চিহ্নগুলোও।

তেমনি অবস্থা রাজশাহীতেও। স্বাধীনতার ৪৪ বছরেও রাজশাহীর প্রায় অর্ধশত গণকবর বা বধ্যভূমি অবহেলা আর অযত্নে পড়ে রয়েছে। এসব বধ্যভূমি এখন যেন গোচারণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে।

এতগুলো বছরেও বধ্যভূমিগুলোও সংস্কারের জন্য কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। অথচ গণকবরে স্মৃতিসৌধ নির্মিত হলে সেগুলো পাকিস্তানি সেনা ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদর আর আল-শামসদের অত্যাচার-নিপীড়ন-জুলুম ও নৃশংসতার সাক্ষী হয়ে থাকতো।

এমনই একটি বধ্যভূমি হচ্ছে রাজশাহীর শহরের পদ্মাপাড়ের ‘বাবলাবন’।

শহররক্ষা বাঁধের ‘টি-গ্রোয়েন’ সংলগ্ন বাবলাবন বধ্যভূমিতে ১৭ বিশিষ্ট ব্যক্তিসহ শতাধিক মুক্তিকামী মানুষকে নিয়ে গণহত্যা চালানো হয় একাত্তরের ২৫ নভেম্বর। কিন্তু এখনও স্থানটি সংরক্ষিত হয়নি।

দিনে জমজমাট ব্যবসা-বাণিজ্য, রাতে আলো ঝলমল চারদিক। মানুষের সমাগম লেগেই থাকে। বাঁধের নিচেই গড়ে উঠেছে দালান। প্রতিদিন কত যে মানুষ হেঁটে যান আপন খেয়ালে।

কিন্তু এসব পথচারী কিংবা দালানের বাসিন্দাদের মধ্যে হাতেগোনা দু-চারজনই হয়তো জানেন রাজশাহী শহর ঘেঁষা পদ্মাপাড়ের বধ্যভূমি এই বাবলাবনের কথা। বেশিরভাগই জানেন না তারা যেখান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, তার পাশেই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কত শান্তিকামী মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। যারা জানেন, অজস্র স্মৃতির ভিড়ে আজ তাদের কাছেও বহুদিন আগের কোনো ঘটনা হিসেবে তা নাড়া দিয়ে যায়।

রাজশাহী ৭নং সেক্টরের ৪নং সাব সেক্টর কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা সফিকুর রহমান রাজা বাংলানিউজকে জানান, পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য নাজমুল হক সরকার, সরকারি কর্মকর্তা আবদুল হক সরকার, অধ্যাপক মীর আব্দুল কাইয়ুম, শামসুল ইসলাম ঝাটু, অ্যাডভোকেট সুরেশ পাণ্ডে ও বীরেন সরকারসহ শত শত বাঙালি এবং বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছিল ‘টি-গ্রোয়েন’ সংলগ্ন এই বাবলাবন বধ্যভূমিতে।

মুক্তিযোদ্ধা সফিকুর রহমান রাজা বাংলানিউজকে আরও জানান, ওই বধ্যভূমি থেকে একই দঁড়িতে বাঁধা ১৭ জনের লাশ উদ্ধার করেছিলেন তারা। এমন হত্যাযজ্ঞের নিদর্শন রয়েছে প্রতিটি বধ্যভূমিতেই।

এদিকে, স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের দেওয়া তথ্য মতে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না থাকায় এমন আরও অর্ধশতাধিক বধ্যভূমি বর্তমানে অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে রাজশাহী জুড়ে। সংরক্ষণের অভাবে বধ্যভূমিগুলো পরিণত হয়েছে গোচারণভূমিতে।

এর মধ্যে বাবলাবন ছাড়া মহানগর এলাকার বধ্যভূমিগুলো হচ্ছে সাহেব বাজার বিসমিলল্লাহ মার্কেটের সামনে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, কাজলা, বিনোদপুর, উপশহরের সপুরা কলোনি, তালাইমারি, রাজশাহী পুলিশ লাইন, ফুদকিপাড়া, সেনানিবাসের ১ নম্বর গেট এলাকা, হাউজিং এস্টেট কলেজ, রাজশাহী কেন্দ্রীয় উদ্যান ও চিড়িয়াখানার পাশে এবং রুয়েট ক্যাম্পাস।

রাজশাহীর মুক্তিযোদ্ধা নূর হামীম রিজভী বীরপ্রতীক বাংলানিউজকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ৪৪ বছরেও রাজশাহী অঞ্চলের বধ্যভূমিগুলো অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে এ কথা ভাবতেই কষ্ট হয়। এসব স্থানে স্মৃতি সৌধ নির্মাণের প্রয়োজন ছিল। ইতিহাস বিকৃতির যুগে মুক্তি সংগ্রামের কথা নতুন প্রজন্মকে জানাতে বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণের কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন রাজশাহীর এই বীর প্রতীক।

রাজশাহী সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে ১৯৯৫ সালের ২৫ নভেম্বর বাবলাবন বধ্যভূমি স্মৃতি ফলকের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক মীর আব্দুল কাইয়ুমের স্ত্রী অধ্যাপক মাসতুরা খানম। এরপর ২০১১ সালে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন এই বধ্যভূমিতে আবারও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের কথা জানান।

ওই বছরের ২৫ নভেম্বর রাতে মহানগরীর একটি রেস্টুরেন্টে বাবলাবন গণহত্যার শিকার শহীদদের স্মরণসভায় রাসিকের সাবেক মেয়র এ কথা জানান। কিন্তু এরপর সেই উদ্যোগও ভেস্তে যায়।

বাংলাদেশ সময়: ১১৩৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১১, ২০১৫
এসএস/পিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।