ঢাকা, শনিবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

নাড়িপোঁতা ভিটার খোঁজে ৪৫ বছর পর...

এম আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৫৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৩, ২০১৫
নাড়িপোঁতা ভিটার খোঁজে ৪৫ বছর পর... ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ময়মনসিংহ: ৪৫ বছর পর ফিরলেন আশা লতা বসাক। ততদিনে বদলে গেছে অনেক কিছুই।

নিজের বয়সটাও পৌঁছে গেছে নব্বইয়ের কোঠায়। বুড়িয়ে গেছে শরীর। ঝাপসা দেখেন চোখে। জীবনের গোধূলিবেলায় নিজ সন্তান আর পুত্রবধূকে নিয়ে শেষ দেখা দেখতে এসেছিলেন তাদের নাড়িপোঁতা সেই ভিটা।

কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজি করেও পেলেন না সন্তানের শেকড় এ ভিটা। চোখভরা জলে হতাশ হয়ে ফিরে যেতে কষ্ট হচ্ছে তার।

মৃত্যুভয় আর আতঙ্ক নিয়েই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজেদের ঘর-বাড়ি ছেড়ে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। তখনও বুক ভাসিয়েছিলেন চোখের জলে।

৪৫ বছর পর আবারো একই দৃশ্যের অবতারণার পর আশা লতা বললেন, ‘পাকিস্তানিদের ভয়ে দেশ ছেড়ে গিয়েছিলাম। তার আগে অনেক শান্তিতে ছিলাম এখানে। ময়মনসিংহ শহরের আমলাপাড়া এলাকায় আমাদের ঘর-বাড়ি ছিল। স্বামীর জুয়েলারি দোকান ছিল। এখানে রয়েছে হাজারো স্মৃতি’।

‘কতো বছর পর বিজয়ের মাসেই স্বাধীন দেশে ফিরলাম! এ দিনটির জন্য কতো অপেক্ষা করেছি। কিন্তু আমাদের স্মৃতিচিহ্নটুকুও তো আর নেই’- বলতে বলতে ভারী হয়ে আসে আশা লতার কণ্ঠস্বর।

রোববার (১২ ডিসেম্বর) রাত সোয়া ৯টার দিকে ময়মনসিংহ নগরীর আমলাপাড়া এলাকায় কথা হচ্ছিল বর্তমানে কলকাতার কাশিপুর সড়কের উজানভাটি এলাকার বাসিন্দা আশা লতার সঙ্গে। সন্তান ডা. সুব্রত বসাক (৫০) ও তার স্ত্রী ডা. গীতা বৈদ্যকে (৪৫) নাড়িপোঁতা ভিটা দেখাতে রোববার সকালে কলকাতা থেকে ঢাকায় ও পরে রাতে ময়মনসিংহে আসেন তারা।

‘এখানে আমাদের পৈত্রিক ভিটা ছিল। এখন ঠিক চিনতে পারছি না। একটু চিনিয়ে দেবেন’- হেঁটে যাওয়ার সময় হঠাৎ এমন অনুরোধ করেন সুব্রত ও তার স্ত্রী গীতা। আলাপচারিতার সূত্র ধরে পরে প্রেসক্লাব ময়মনসিংহ কার্যালয়ে আসেন তারা।

‘আমাদের ফেলে যাওয়া বসত-ভিটা শুধুমাত্র চোখের দেখা দেখাতেই ওদের নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু চিনতে পারলাম না। সবকিছুই কেমন জানি বদলে গেছে। তবুও বুকভরে নি:শ্বাস নিতে পারলাম। এ প্রাপ্তিই কম কিসে?- বলেন সুব্রতের মা অশীতিপর বৃদ্ধা আশা লতা।  

যুদ্ধদিনের ভয়াল স্মৃতি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘তখন সবেমাত্র যুদ্ধ শুরু হয়েছে। চারদিকে আতঙ্ক। বোমাবাজি চলছে। আতঙ্কে প্রিয় সন্তানকে নিয়ে আমি আর আমার স্বামী মেঘালয় দিয়ে ভারতে চলে গিয়েছিলাম। শিয়ালদহ স্টেশন এলাকায় আমার মামার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। এরপর কলকাতাতেই স্থায়ী আবাস’।

মা-বাবার সঙ্গে নিজের নাড়িপোঁতা ভিটে ছেড়ে যাওয়ার সময় সুব্রত বসাকের বয়স ৪ বা ৫ বছর। শৈশবেই এ শহর ছেড়ে যাওয়া সুব্রত পরবর্তীতে কলকাতা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করেন। এখন তিনি কলকাতা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কর্পোরেশনের সহকারী মেডিকেল অফিসার। তার স্ত্রী গীতা বৈদ্যও চিকিৎসক। ১৯৯২ সালে সংসার গড়েন দু’জনে।

তার বাবা বিশ্বনাথ বসাক জুয়েলারি ব্যবসা করতে ঢাকার নবাবপুর থেকে ময়মনসিংহের আমলাপাড়ায় এসে বাড়ি করেছিলেন।

সুব্রত বলছিলেন, ‘অনেক দিন ধরেই মা ময়মনসিংহে আসতে চাচ্ছিলেন। আমাদের বসত-ভিটা দেখার আকুতি করছিলেন। এ কারণেই এখানে আসা। কিন্তু মায়ের ইচ্ছা তো পূরণ হলো না’- আক্ষেপ ঝরে তার কণ্ঠে।

বাংলানিউজকে এ চিকিৎসক আরও বলেন, ‘এদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের অবদান অনেক। বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন। পাকিস্তানিদের বিতাড়িত করেছিলেন। তার কারণেই একটি স্বাধীন দেশের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মা-বাবা প্রায় সময়েই এসব কথা বলতেন। সেই থেকে তাদের এ কথাগুলো আমার হৃদয়ে গেঁথে আছে’।

অতীতকাতরতায় আচ্ছন্ন সুব্রত বলেন, ‘আমার মা এখনো ময়মনসিংহের মায়া ছাড়তে পারেননি। ৪৫ বছর পর মায়ের সঙ্গে এখানে এসে আমিও নস্টালজিক হয়ে পড়েছি। কখনোই ভুলবো না এ শহরকে’।

বাংলাদেশ সময়: ১০৫৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৩, ২০১৫
এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।