ঢাকা, শনিবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

আজন্ম দ্রোহী শহীদ ড. শামসুজ্জোহা

‘শিক্ষক দিবস’ জাতীয় দিন হয়নি আজও!

শরীফ সুমন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০০৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৫
‘শিক্ষক দিবস’ জাতীয় দিন হয়নি আজও! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

রাজশাহী: ‘ডোন্ট ফায়ার! আই সেইড, ডোন্ট ফায়ার! কোনো ছাত্রের গায়ে গুলি লাগার আগে যেন আমার গায়ে গুলি লাগে। ’ ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি এভাবেই ছাত্রদের বাঁচাতে শিনা টান করে নিজে পাকিস্তানি সেনাদের নিশানা হন ড. মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা।



যাদের ত্যাগে দেশ ও জাতি ঋণী- ড. মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা এমনি একজন আজন্ম দ্রোহী।

উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিত রচিত করেছিল। আর যাদের আত্মত্যাগে এ সংগ্রাম গণআন্দোলনে রূপ নিয়েছিল, তাদের অন্যতম একজন ড. শামসুজ্জোহা, বাংলার প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী। যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের জীবনের নিরাপত্তা দিয়েছেন নিজের জীবন দিয়ে।

দিবসটি এখন পালিত হয় ‘জোহা দিবস’ হিসেবে। আর প্রতি বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ক্যাম্পাসেই কেবল ‘শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালন হয় স্মরণীয় এ দিনটি। রাবি পরিবারের দাবি, দিনটিকে ‘জাতীয় শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালনের জন্য বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার কার্যকর উদ্যোগ নেবেন।

বাংলাদেশে বছরে অসংখ্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবস পালন করা হলেও এ দিবসটি জাতীয়ভাবে পালন করা হয় না আজও! অথচ দিনটিকে ‘শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালন করার সরকারি ঘোষণার জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষক সমিতি। ড. জোহার স্মৃতিকে ধরে রাখতে পাঠ্যপুস্তকে তার আত্মদানের কাহিনী অন্তর্ভুক্ত করাও এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুলিতে নির্মমভাবে শহীদ হন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রক্টর ও রসায়ন বিভাগের শিক্ষক ড. মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা। শহীদ ড. শামসুজ্জোহার শাহাদাত বরণের পর ৪৬ বছর পার হয়েছে, কিন্তু রাবি পরিবার আজও ভোলেনি তাকে।

শহীদ ড. শামসুজ্জোহা বাঙালির বীরত্বময় গৌরবগাথার ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। তার  মৃত্যুর পরই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন চরম আকার ধারণ করেছিল। তার রক্তের পথ ধরেই পতন ঘটেছিল লৌহমানব সামরিক জান্তা আইয়ুব খানের। গণআন্দোলনে বিজয় এসেছিল বাঙালির।

সেদিন যা ঘটেছিল
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন কর্মসূচির ঘোষণায় পাকিস্তানি সামরিক সরকার পূর্ব পাকিস্তানে ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু ১৮ ফেব্রুয়ারি সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে মেইনগেটের সামনের মহাসড়কে পাকিস্তানি স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন।

খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা মেইনগেটে ছুটে যান। প্রক্টর হিসেবে তিনি ছাত্রদের শান্ত করা এবং ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। ছাত্ররা পিছু হটতে না চাইলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন হাদী ছাত্রদের গুলি করার নির্দেশ দেন।
তখন ড. জোহা পাকিস্তানি বাহিনীর উদ্দেশ্যে বলেন, ‘কোনো ছাত্রের গায়ে গুলি লাগার আগে যেন আমার গায়ে গুলি লাগে’। এ সময় তিনি ‘ডোন্ট ফায়ার! ডোন্ট ফায়ার!’ বলে চিৎকার করতে থাকেন। তিনি ছাত্রদের ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে নেওয়ার আশ্বাস দেন।

কিন্তু প্রক্টরের আশ্বাসে কোনো কর্ণপাত না করে বেলা ১১টার সময় ক্যাপ্টেন হাদী তার পিস্তল বের করে ড. জোহাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। সেদিন মহান এই শিক্ষক ড. জোহার বুকের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল মতিহারের নিষ্পাপ সবুজ চত্বর। হাসপাতালে নেওয়ার পর ড. জোহা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

প্রথমে ছাত্ররা বুঝতে পারছিলেন না, ড. জোহা ও তার সহকর্মীদের ভাগ্যে কি ঘটেছে। দুপুর বারোটার দিকে ক্যাম্পাসে খবর আসে, ড. জোহাকে প্রথমে কাছ থেকে গুলি ও পরে বেয়নেট চার্জ করে ক্ষত-বিক্ষত করা হয়েছে। এবং তিনি মুমূর্ষু অবস্থায় রাজশাহী পৌরসভার একটি পুলিশ ভ্যানে প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে পড়ে আছেন। পরে তৎকালীন জেলা প্রশাসকের নির্দেশে ড. জোহাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।

খবর পেয়ে ছাত্র-জনতা ভিড় জমান হাসপাতালে। ইতোমধ্যেই অনেক দেরির কারণে প্রচুর রক্তক্ষরণ ঘটায় অপারেশন থিয়েটারে অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন ড. দত্ত। অকাতরে প্রাণ দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে ইতিহাসের পাতায় নাম লেখান তিনি। এর পরের ইতিহাস সবার জানা। ড. শামসুজ্জোহার রক্তস্নাত পথ ধরে গণআন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়।

ড. জোহার সংক্ষিপ্ত জীবনী
অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী ড. মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা ১৯৩৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিন ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। বাঁকুড়া জেলা স্কুলে তিনি লেখাপড়া শুরু করেন এবং ১৯৪৮ সালে এই স্কুল থেকে তিনি প্রথম বিভাগে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে বাঁকুড়া ক্রিশ্চান কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণিতে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হন ড. শামসুজ্জোহা।

১৯৫০ সালের পর ড. জোহার পরিবার স্থায়ীভাবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। ১৯৫৩ সালে ড. জোহা দ্বিতীয় শ্রেণিতে সম্মান ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৪ সালে তিনি প্রথম শ্রেণিতে এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন।

১৯৫৫ সালে তিনি পাকিস্তান অর্ডিন্যান্স কারখানায় সহকারী কারখানা পরিচালক পদে শিক্ষানবিশ হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৫৬ সালে বিষ্ফোরকদ্রব্যের ওপর প্রশিক্ষণ লাভের জন্য তিনি ইংল্যান্ডে যান। সেখানে তিনি ইমপেরিয়াল কলেজ ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এআরসিএস ও বিএস স্পেসিয়াল ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৬১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদান করেন শামসুজ্জোহা। বিদেশ থেকে পিএইচডি ও ডিআইসি ডিগ্রি নিয়ে পুনরায় তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন। ড. জোহা শহীদ হওয়ার সময় স্ত্রী নিলুফা জোহা ও এক কন্যা সন্তান রেখে যান। দীর্ঘ দিন ধরে তারা আমেররিকায় বাস করেন। বর্তমানে তারা সেখানকার নাগরিক।

ডাকটিকিট ও জোহা হল
শহীদ শামসুজ্জোহার অবদানকে স্মরণে রাখতে স্বাধীনতার পর তার নামে চার টাকা মূল্যের ডাকটিকেট অবমুক্ত করা হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্র হলের নামকরণ করা হয় ড. জোহার নামানুসারে। হলের সামনে নির্মিত হয়েছে শহীদ শামসুজ্জোহা স্মৃতি ভাস্কর্য ‘স্ফুলিঙ্গ’।

প্রতি বছর ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক দিবস পালন করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইনগেট দিয়ে প্রবেশ করলে প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থিত শহীদ ড. শামসুজ্জোহার সমাধি।

নির্মিত হচ্ছে ড. শামসুজ্জোহা স্মৃতিফলক
স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মিত হতে যাচ্ছে ড. শামসুজ্জোহার স্মৃতিফলক। ড. জোহার স্মৃতিকে চির অম্লান করে রাখার জন্য মেইনগেটে তার গুলিবিদ্ধ হওয়ার স্থানটিতে নির্মাণ করা হচ্ছে এটি।

রাজশাহী সদর আসনের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা স্মৃতিফলকটি নির্মাণের জন্য সরকারি বিশেষ তহবিল থেকে এক কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন গত ১১ সেপ্টেম্বর। ওইদিন দুপুরে সংসদ সদস্য বাদশা রাবি উপাচার্য প্রফেসর ড. মুহম্মদ মিজানউদ্দিনের হাতে এর চিঠি তুলে দেন।

বর্তমানে স্মৃতিফলক নির্মাণের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। এছাড়া রাবি প্রশাসনের অর্থায়নে তার সমাধি সংস্কারের কাজ চলছে। দ্রুত তা শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি প্রফেসর আনন্দ কুমার সাহা বাংলানিউজকে জানান, কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৮ ফেব্রুয়ারি শিক্ষক দিবস হিসেবে পালন করা হয়। কিন্তু জাতীয়ভাবে দিবসটি পালন করা এখন সময়ের দাবি। তারা দীর্ঘদিন ধরে সরকারের কাছে এ দাবি জানিয়ে আসছেন। কিন্তু আজও তার ঘোষণা আসেনি।

ড. শামসুজ্জোহার স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য পাঠ্যপুস্তকে তার আত্মদানের ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক নেতা।
 
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (ভিসি) প্রফেসর ড. মিজানউদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় যেজন্য গর্ববোধ করে থাকে তা হচ্ছে, স্বাধীনতার প্রাথমিক সোপান রচনায় প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. শামসুজ্জোহার অবদান। কিন্তু এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ড. জোহা সম্পর্কে তেমন কিছু জানেন না।

প্রফেসর ড. মিজানউদ্দিন বলেন, এখানে যারা পর্যটক হিসেবে আসেন ড. জোহা সম্পর্কে তাদের জানানোর জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই। যা খুবই হতাশাজনক ছিল। আর্থিক সমস্যার কারণে স্মৃতিফলক নির্মিত হয়নি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র এমপি ফজলে হোসেন বাদশা এ বিষয়ে এগিয়ে এসেছেন। আশা করছি, দ্রুত ড. জোহার স্মৃতিফলক নির্মাণ কাজ শেষ করা সম্ভব হবে।

ড. জোহার শহীদ দিবসটি জাতীয় শিক্ষক দিবস হিসেবে পালনের দাবি জানান রাবি উপাচার্যও।

বাংলাদেশ সময়: ১২০৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৫
এসএস/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।