ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

হলুদ চাদরে ঢাকা পড়েছে মাঠ

মাহবুবুর রহমান মুন্না, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০১৫
হলুদ চাদরে ঢাকা পড়েছে মাঠ ছবি : মানজারুল ইসলাম/বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

খুলনা: পৌষের শিশিরসিক্ত মাঠভরা সরিষা ফুলের গন্ধ বাতাসে ভাসছে। গাঢ় হলুদ বর্ণের এ ফুলে মৌমাছি গুন গুন করে মধু আহরণ করছে।

দূর থেকে সরিষার ক্ষেতগুলো দেখে মনে হয়, কে যেন হলুদ চাদর বিছিয়ে রেখেছে। মাঠে মাঠে দিগন্ত জুড়ে সরিষা ফুলের নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে পথিকসহ কৃষকদেরও মন ভরে যায়।

খুলনার বিভিন্ন উপজেলার মাঠে মাঠে শোভা পাচ্ছে হলুদের সমারোহে সরিষা ক্ষেত। শীতের কুয়াশাকে উপেক্ষা করে চাষিরা সরিষা ক্ষেতের যত্ন নিচ্ছেন।

জেলার ডুমুরিয়া ও বটিয়াঘাটা উপজেলার কয়েকজন কৃষক বাংলানিউজকে জানান, অন্য যেকোনো আবাদের চেয়ে সরিষা চাষে তুলনামূলক খরচ ও পরিশ্রম কম হওয়ায় অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার বেশি জমিতে সরিষা চাষ করেছেন কৃষকরা। আবহাওয়া অনুকূলে এবং সার বীজ সংকট না থাকায় সরিষা বীজ বুনে ভালো ফলনের আশা করছেন তারা।

সরিষা ক্ষেতে পরিচর্যার সময় কথা হয় ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগরের মালতিয়া গ্রামের কৃষক কামরুজ্জামানের সঙ্গে। এ সময় তিনি বাংলানিউজকে জানান, এ বছর তিনি ৩ বিঘা জমিতে সরিষা চাষ করছেন। ইতিমধ্যে তার সরষে ক্ষেত ফুলে ফুলে ভরে গেছে।

তিনি জানান, দিন দিন অন্যান্য ফসলের মতো সরিষা চাষের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন এ অঞ্চলের চাষিরা।

গুটুদিয়া এলাকার কৃষক সাগর জানান, এবার ভালো ফলনের আশা করা যাচ্ছে। বাজারে সরিষার দাম ভালো যাচ্ছে। সরিষার তেলের দামও অনেক বেশি। এ কারণে তিনিও ৪ বিঘা জমিতে এবার সরষে চাষ করছেন বলেও জানান।

বটিয়াঘাটার জলমা এলাকার হাফিজুর রহমান বলেন, গত বছর এক বিঘা জমিতে সরিষা চাষ করে লাভবান হয়েছি। শোধ করেছি দায় দেনা। তাই এবার দুই বিঘা জমিতে সরিষা চাষ করেছি। ফলনও হয়েছে ভালো।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর খুলনার উপ-পরিচালক আব্দুল লতিফ বাংলানিউজকে জানান, এ বছর খুলনা জেলায় ৩শ’ ৮০ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিলো। এর মধ্যে এরই মধ্যে আবাদ হয়েছে ৩শ’ ১ হেক্টর জমিতে।

খুলনার বিভিন্ন উপজেলার মাঠের পর মাঠ জুড়ে এখন সরিষা ক্ষেত। কৃষকের মুখে ফুটে উঠছে মিষ্টি হাসি। কৃষকরা স্বল্প সময়ের মধ্যে ভালো ফলন পাওয়ায় সরিষা চাষে ঝুঁকছেন বলেও জানান তিনি।

আব্দুল লতিফ বলেন, উন্নত জাতের বীজ, সারের সরবরাহ এবং সেচ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে কৃষি বিভাগ কৃষকদের পাশে ছিলো। যে কারণে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সক্ষম হবে।

সরিষা চাষ পদ্ধতি
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ও কৃষিবিদদের মতে সরিষা ধানের চাষ পদ্ধতি ও ফলন বাড়ানোর উপায় নিচে উল্লেখ করা হলো।

মাটি ও আবহাওয়া
সরিষা বেলে-দোআঁশ মাটিতে ভালো জন্মে। মাঝারি ও মাঝারি উঁচু জমি এ সরিষার ক্ষেতের জন্য নির্বাচন করা উচিত। জলাবদ্ধতা অত্যন্ত ক্ষতিকর। সরিষা চাষের জন্য পর্যাপ্ত সূর্যকিরণ, কম তাপমাত্রা এবং জমিতে পর্যাপ্ত রস থাকা প্রয়োজন। তাপমাত্রা বেশি হলে ও খরা হলে বীজের আকার ছোট হয় ও বীজে তেলের ভাগ কমে যায়।

জমি তৈরি
সরিষার বীজ ছোট বলে ৪-৬টি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে জমি তৈরি করতে হয়। জমিতে যাতে বড় বড় টিলা ও আগাছা না থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

সারের পরিমাণ
জাত মাটি এবং মাটিতে রসের তারতম্য অনুসারে সরিষার জন্য বিভিন্ন পরিমাণ সার দিতে হয়।

সার প্রয়োগ পদ্ধতি
অর্ধেক ইউরিয়া এবং অন্য সারগুলোর সবটুকু শেষ চাষের আগে জমিতে ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। বাকি অর্ধেক ইউরিয়া উপরি প্রয়োগ হিসেবে চারা গজানোর ২২-২৫ দিন পর অর্থাৎ ফুল আসার আগে প্রয়োগ করতে হবে।

বপনের সময়
সাধারণত আশ্বিন মাসের শেষ থেকে কার্তিক মাসের শেষ পর্যন্ত (মধ্য অক্টোবর থেকে মধ্য নভেম্বর) সরিষা বপন করার উপযুক্ত সময়। দেরিতে বপন করলে ফলন কমে যায়। দেশের উত্তরাঞ্চলে আগাম শীত আসার কারণে সেখানে আগাম বপন করা সম্ভব। আমন ধান কাটার পর বেশি দেরি না করে সরিষা বপন করা উচিত।

বীজের হার
হেক্টর প্রতি (কেজি) ৬.০০-৭.০০, একর প্রতি (কেজি) ২.১-২.৪০ ও বিঘা প্রতি (কেজি) ০.৭০-০.৮০ বীজ বপন করতে হয়।

বপন পদ্ধতি
সারিতে এবং ছিটিয়ে উভয় পদ্ধতিতেই সরিষার বীজ বপন করা যায়। সারিতে বুনলে সারির দূরত্ব ৩০ সে.মি. এবং সারিতে বীজ লাগাতার বপন করতে হয়। সারিতে বুনলে পরবর্তীতে আগাছা দমন ও অন্যান্য অন্তর্বতী পরিচর্যা করা সহজ হয়। সারি তৈরির জন্য লোহার তৈরি টাইন অথবা কাঠের ছোট লাঙ্গল ব্যবহার করা যেতে পারে। আড়াই থেকে তিন সেন্টিমিটার গভীরে বুনলে শেষ চাষের পর বীজ বপন করতে হবে এবং মই দিয়ে জমি সমান করে দিতে হবে। সরিষার বীজ ছোট বলে বপনের সুবিধার জন্য বীজের সঙ্গে ঝুরঝুর মাটি অথবা ছাই মিশিয়ে নেওয়া যেতে পারে।

সেচ পদ্ধতি
সরিষা চাষের জন্য জমিতে পর্যাপ্ত রস থাকা প্রয়োজন। সেজন্য জমিতে রসের অভাব দেখা দিলে সেচ প্রয়োগ করতে হয়। কখনো কখনো বপনের সময় জমিতে রসের অভাব থাকে। সেক্ষেত্রে বপনের আগেই সেচ দিয়ে রসের ব্যবস্থা করতে হবে।

পোকা দমন
বিনা সরিষার বীজ ব্যাভিস্টিন (২.৫ গ্রাম ) বা বেনলেট (১.৫ গ্রাম) দিয়ে শোধন করতে হবে। অল্টারনারিয়া রোগের আক্রমণ বেশি দেখা দিলে ডায়াথেন এম ৪৫ বা রোভরাল স্প্রে করতে হবে। ফুল ধরা শেষ হলে ১৫ দিন পর পর দু’বার স্প্রে করলেই হবে।

জাব পোকার আক্রমণ হলে ফলন কমে যায়। ফুলের কুঁড়ি আসা শুরু করলে এ পোকা আক্রমণ করে। এ ক্ষেত্রে ডাইমেক্রন ১০০ সিসি বা ম্যালাথিয়ন ৫৭ ইসি ইত্যাদি কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।

পরাগায়ণে মৌমাছি
মৌমাছি সরিষার পরাগায়ণে সাহায্য করে এবং এতে ফলন বৃদ্ধি পায়। তাই সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সরিষা ফুলে প্রচুর মৌমাছি মধু সংগ্রহের জন্য বিচরণ করে।

ফসল সংগ্রহ
সরিষা গাছে ফল তথা সিলিকুয়া হলুদ রঙের হলে ফসল তুলতে হবে। মাটি নরম থাকলে গাছের গোড়া ধরে টেনে শিকড়সহ তোলা যায়। না হলে মাটির উপরিভাগের গাছের গোড়া কেটে নিতে হবে। তারপর ভালোভাবে ৪-৫ দিন বীজ রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৭২৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০১৫
এমআরএম/এমজেএফ/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।