ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

এফবি বন্ধনের মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩৪১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৫, ২০১৬
এফবি বন্ধনের মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি

ঢাকা: এক বছর অপেক্ষার পর অবশেষে স্বজনদের মর্মান্তিক মৃত্যুর মুখে ঢেলে দেওয়ার দায়ে ক্ষতিপূরণ ও হত্যা মামলা দায়েরের পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানানো হয়েছে ২০১৪ সালের ২৯ নভেম্বর নিহত ২৯ জন নাবিকের পরিবারের পক্ষ থেকে।

গত ২৩ ডিসেম্বর সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবরে তারা এ দাবি সম্বলিত আবেদন জানান।



সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী ও প্রধান পরিদর্শক এ কে এম ফকরুল ইসলাম বলেন, নিহতদের স্বজনরা ক্ষতিপূরণ আদায় ও দায়ী ফিশিং বোট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন করেছেন। বিষয়টি অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে এ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নিজেই দেখছেন।

সমুদ্রপরিবহন অধিদপ্তর সূত্র জানায়, বেঙ্গল ফিশারিজ লিমিটেড নামে একটি কোম্পানির প্রতারণা ও জালিয়াতির কারণে ২০১৪ সালের ২৯ নভেম্বর ভোরে সেন্ট মার্টিনস দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিমে ৩০ নটিক্যাল মাইল দূরে বঙ্গোপসাগরে এফবি বন্ধন নামে মাছধরা জাহাজটি প্রবল স্রোতের কবলে পড়ে ডুবে যায়। ঘটনার পর জাহাজে থাকা ৩১ জনের মধ্যে মাত্র দুজনকে জীবিত উদ্ধার করা যায়। বাকিদের কোনো খোঁজ মেলেনি। এমনকি দুর্ঘটনাস্থলে স্রোতের কারণে সমুদ্রের তলদেশ থেকে ওই জাহাজটিও আর উদ্ধার করাও সম্ভব হয়নি।

নিহতদের স্বজনরা তাদের আবেদনে বলেন, এফ বি বন্ধন শিপিং জাহাজের মালিক-কর্মকর্তাদের অবহেলা ও ইচ্ছাকৃতভাবে জেনেশুনে লক্কড়ঝক্কড় এবং আইন অনুযায়ী সাগরে যাওয়ার অনুপযুক্ত জাহাজটি সাগরে পাঠিয়ে ২৯জন নাবিকের মৃত্যু ঘটিয়েছে। এঘটনার পর বিভিন্ন সংস্থার তদন্ত থেকে আমরা জানতে পেরেছি ঘটনার দিন এফবি বন্ধনে সাগরে জাহাজ পরিচালনার যোগ্যতা সম্পন্ন কোনো সার্টিফাইড স্কিপার বা নেভিগেটিং অফিসার ছিলেন না।

এমনিক নৌযানটি ডুবে যাওয়ার পরে কোনো লাইফ রাফটও ভেসে ওঠেনি। ফলে ডুবে যাওয়ার পর নাবিকরা জীবন বাঁচানোর কোনো সুযোগই পাননি। যা মার্চেন্ট শিপিং অর্ডিনেন্স ১৯৮৩সহ অন্যান্য সব আইন লঙ্ঘনের সামিল।

নিহতদের স্বজনরা আবেদনে উল্লেখ করেন, ঘটনার পর এফ বি বন্ধনের মালিকের পক্ষ থেকে আমাদের জানানো হয়, বসুন্ধরা-৮ নামে একটি জাহাহের ধাক্কায় এফবি বন্ধন ডুবে যায়, কিন্তু আমরা পরবর্তীতে জানতে পারি, এফবি বন্ধনের সঙ্গে বসুন্ধরা-৮ জাহাজের কোনো ধরনের সংঘর্ষের প্রমাণ পাওয়া যায়নি বরং এফবি বন্ধনের সমুদ্রে চলাচলের অনুপযোগী ছিল। তাই অবিলম্বে এ হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে এফ বি বন্ধনের মালিক-পরিচালকদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থাগ্রহণসহ উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ আদায়ের পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য তারা আবেদন জানান।

নিহত নাবিকদের স্বজনদের পক্ষে পৃথক দুটি আবেদনে স্বাক্ষর করেন নিহত নাবিক বেলায়েত হোসেনের ছেলে মোকাম্মেল হোসেন, নিরব হোসেনের মা বিবি ছালেহা, জসিম উদ্দীনের বাবা মো. আকতার উল্লা, ফোরকান উদ্দীনের সঙ্গী শামসুন নাহার, মো. ইসমাইলের সঙ্গী দেলোয়ারা বেগম, জামাল উদ্দীনের সঙ্গী তাছলিমা আক্তার, মো. রবিউলের বাবা মো, সফিউল্লা, মো. রহিমের সঙ্গী সুমা প্রমুখ।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মো. মুকতাদির বিল্লাহ দেশের অভ্যন্তরীণ নদীপথে চলাচলকারী নৌযানের একজন প্রথম শ্রেণির মাস্টার। ২০১২ সালের ৫ আগস্ট নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে তিনি ওই পদের ‘যোগ্যতা সনদ’ পেয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি চাকরি নেন চট্টগ্রামের বেঙ্গল ফিশারিজ নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে।

ওই প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ ২০১৪ সালের ১৬ নভেম্বর নদীপথের যোগ্যতাসম্পন্ন মাস্টার মুকতাদিরকে সমুদ্রগামী জাহাজের ক্যাপ্টেন সাজিয়ে তাদের ‘এফবি বন্ধন’ নামে ৯৫ দশমিক ৬৭ ফুট দীর্ঘ মাছধরা জাহাজের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়ে দেয় গভীর সমুদ্রে।

একইভাবে তৃতীয় শ্রেণির ইঞ্জিনিয়ারের যোগ্যতা সনদপ্রাপ্ত মো. ইয়াকুব আলী খন্দকারকে প্রথম শ্রেণির প্রধান প্রকৌশলী সাজিয়ে পাঠানো হয়েছিল একই জাহাজে। একইভাবে ওই জাহাজে ছিল আরও কয়েকজন অযোগ্য ও অদক্ষ জনবল। সব মিলিয়ে জাহাজে জনবল ছিল ৩১ জন। যাদের মধ্যে মাত্র দুইজনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়।

এদিকে, ডুবে যাওয়া এফবি বন্ধনের কাগজপত্র খুঁজে দেখা যায়, ২০১৪ সালের ১৫ নভেম্বর অনুমোদিত অনবোর্ড মেম্বার্স লিস্টে ৩৭ জনের তালিকা দেওয়া আছে। কিন্তু ওই জাহাজের পরিদর্শন সনদে দেখা যায় অনবোর্ড জাহাজে কর্মকর্তা ও ক্রুসহ সর্বোচ্চ ২৯ জন থাকার কথা। অবশ্য পরে ওই তালিকা কাটাকাটি করে ছয়জন ছুটিতে থাকার তালিকা দেখানো হয়েছে।

কিন্তু দুর্ঘটনার সময়েও জাহাজে অনুমোদিত সংখ্যার চেয়ে দুজন বেশি ছিল। বাকি ছয়জনের বিষয়ে পরে ছুটিতে থাকার কথা হাতে লিখে দেওয়া আছে। এমন গরমিলের তালিকা নিয়েও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে সংশয় দেখা দিয়েছে।

সমুদ্রগামী জাহাজ চলাচলের বিষয়ে একজন সরকারি বিশেষজ্ঞ নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, মাছ ধরার এ রকম বড় জাহাজগুলোর অনুমোদিত জনসংখ্যা অনুসরণ করা বাধ্যতাম লক। এ ক্ষেত্রে একজন লোকও বেশি অনবোর্ড করার কোনো সুযোগ থাকে না। কোনো জাহাজে এমনটা করলে তা অবশ্যই অবৈধ কাজ।

এছাড়া এসব জাহাজের ওজনও বড় ব্যাপার। সাধারণত এক দেড় মাসের জন্য এমন জাহাজ গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যায়। ফলে এই সময়ের জন্য জাহাজে অবস্থানকারী প্রতিজনের খাবারসহ যাবতীয় প্রয়োজনীয় উপাদান-উপকরণ সঙ্গে নিতে হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ডুবে যাওয়ার সময় এফবি বন্ধনে আইন অনুসারে অনুমোদিত কোনো প্রধান প্রকৌশলী, স্কিপার, ভেসেল মেট বা অন্য কোনো দক্ষ জনবল ছিল না। যা সমুদ্রগামী জাহাজ পরিচালনায় বিদ্যমান ডেক অফিসার সার্টিফিকেশন রুল ২০০৩ কিংবা ফিশিং ভেসেল ইঞ্জিনিয়ারিং অফিসার সার্টিফিকেশন রুল ১৯৯২-সহ অন্যান্য আইন ও বিধিমালার লঙ্ঘন।

মৎস্য কর্মকর্তা ও সমুদ্রগামী মাছ ধরা জাহাজের মালিকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, সাগরে চলাচলকারী জাহাজের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অতিরিক্ত মাছ আহরণসহ  সাগরতলে নানা ঝুঁকি থাকে। দক্ষ জনবল দিয়ে এসব জাহাজ না চালালে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অনেক চালকই নিয়ন্ত্রণ রাখতে ব্যর্থ হয়ে দুর্ঘটনায় পড়েন। কিন্তু পরে সরকারে পক্ষ থেকে দায়ী নৌযান মালিকদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।

বাংলাদেশ সময়: ২৩৪১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৫, ২০১৬
পিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।