ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

নির্যাতিত নারীদের ভরসা নারীনেত্রী মুক্তা

রেজাউল করিম বিপুল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৫২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৬, ২০১৬
নির্যাতিত নারীদের ভরসা নারীনেত্রী মুক্তা ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ফরিদপুর: আসমা আক্তার মুক্তা। ফরিদপুরের নারী আন্দোলনের অগ্রগামী।

নারীর অধিকার রক্ষায় যুগের পর যুগ কাজ করে যাচ্ছেন এই নারীনেত্রী। কোনো বাধাই তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। জীবন সংগ্রামেও এক অকুতোভয় সৈনিক তিনি।

আজও নারীর অধিকার রক্ষায় ও নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে নিজেকে উজাড় করে কাজ করে যাচ্ছেন। সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখায় এক জয়িতার নাম এখন আসমা আক্তার মুক্তা।  

ফরিদপুর শহরের কুঠিবাড়ী কমলাপুর সরকার পাড়া সড়কের মৃত নূর মোহাম্মদ মিয়া ও হালিমা আক্তার দম্পতির ১০ সন্তানের মধ্যে মেজ তিনি।

মুক্তা বাংলানিউজকে বলেন, ‘মানুষের জন্য কাজ করেছি না, এখনো করছি নিজের জন্যই। কাজইতো জীবন, কাজ না করলে কোনো কিছুই ভালো লাগে না। মানুষের জন্য কাজ করে আনন্দ পাই। জীবনে চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। শুধু চেষ্টা করছি, যতোটুকু পারি, অধিকার বঞ্চিত মানুষকে তাদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে’।

তিনি বলেন, ‘এ কাজ করতে গিয়ে আমি নয়, সবচেয়ে বেশি নিগ্রেহের শিকার হয়েছেন আমার জন্মদাতা বাবা-মা। ছাত্রী জীবন থেকে কাজ করতে গিয়ে সময় তো বাড়ি আসতে পারিনি। আরো তিন যুগ আগে ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে মানুষের জন্য কাজ করেছি। সে সময়ের সমাজ এগুলো মেনে নেয়নি। যে কারণে মৌলবাদদের চক্ষুশুল হয়েছি’।

মুক্তা বলেন, ‘মা-বাবাকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে আমার জন্য। প্রথমদিকে মা-বাবাও হতাশ হয়েছিলেন আমার চলাফেরায়। কিন্তু আস্তে আস্তে যখন বুঝতে শুরু করলেন, নিজের জন্য নয়, সমাজের অবহেলিত অধিকার বঞ্চিতদের জন্য কাজ করছে তাদের সন্তান। তখন আর মা-বাবাও কিছু বলতেন না’।

‘বিয়ের পর স্বামী সিরাজ-ই-কবির খোকনের ঐকান্তিক চেষ্টায় কাজ করতে আর কোনো সমস্যা হয়নি। তিনিও পাশে থেকেছেন সমান তালে’।

মুক্তা জানান, সময়টা ২০০২ সাল। কথা কৃষ্ণকলি নামের একটি নাটকের মধ্য দিয়ে ফরিদপুরে সংস্কৃতিকর্মীদের জীবনে নেমে আসে এক কালো সময়। সে সময় ওই কর্মীদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য তাকে মৌলবাদদের রোষানলে পড়তে হয়।  

সে সময় তার কন্ঠ স্তব্ধ করে দেওয়ার লক্ষ্যে প্রগতি বিরোধী বিভিন্ন পত্রিকায় উস্কানিমূলক অপপ্রচার চালানো এবং ধর্মান্ধদের সমাবেশ থেকে জীবন সংহারি হুমকি দেওয়া হয়। ফজলুল হক আমিনী, চরমোনাই পীর ও নেতাদের মুরতাদ ঘোষণা ও ফাঁসির দাবির শিকার হন।

আসমা আক্তার মুক্তা বিএসএস (অনার্স), এমএসএস (রাষ্ট্রবিজ্ঞান) শেষ করে এক বছর ফরিদপুরের সরকারি ইয়াছিন কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। পরে মানুষের পাশে দাড়াতে এনজিও সংস্থার সঙ্গে জড়ান। বর্তমানে তার হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান ফরিদপুরের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা রাসিন এর নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন।

রাসিন সূত্রে জানা গেছে, বাল্যবিবাহ বন্ধ, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ ও নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে (মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান) নানাবিধ কার্যক্রম (প্রশিক্ষণ, সংগঠন নির্মাণ, আইনি সহায়তা, স্বাস্থ্যসেবা) পরিচালনা করতে গিয়ে সমাজের কূপমণ্ডুকদের বিরাগভাজন হয়েছেন মুক্তা ও তার কর্মীরা।

ফরিদপুর পৌরসভার ২৪টি বস্তিতে বসবাসকারীদের জীবন-মান উন্নয়নে কর্মরত ১৩টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কোয়ালিশনের নির্বাচিত চেয়ারপার্সন আসমা আক্তার মুক্তা।

নিজ উদ্যোগে গড়ে তোলা সংগঠনে এ পর্যন্ত দুই শতাধিক মানুষের কর্মসংস্থান করেছেন তিনি। ১০০ জন নারীকে উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পেছনে প্রশিক্ষণ, কারিগরি সহায়তা এবং ব্যাংকঋণের মাধ্যমে পুঁজি গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।

এসব নারীদের অনেকেই আজ সুপ্রতিষ্ঠিত। সংগঠনের প্রাথমিক পর্যায় থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ২৫০০ জন তৃণমূলের সুবিধা বঞ্চিত মানুষকে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতার লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ, গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি, শস্যবীজ, সেলাই মেশিন, হুইল চেয়ার, শীতবস্ত্র এবং অফেরতযোগ্য পুঁজি প্রদান করেছেন তার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে।

সমাজের দলিত শ্রেণীর বাসস্থান, কর্মপরিবেশ এবং শিশু শিক্ষার উন্নয়ন তথা সার্বিক জীবন-মানের ইতিবাচক পরিবর্তনে ফরিদপুরের আলীপুরে প্রধান সুইপার কলোনিতে সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম শুরু করেন তিনি। পরবর্তীতে ‘শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের আনন্দ ভবন’ নামে শিক্ষা ও বিনোদন কেন্দ্র নির্মাণ করেন।

মাদকের বিস্তার প্রতিরোধ ও মাদকাশক্তি নির্মূলে নিরলস কাজ করেছেন তিনি। তার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ঢাকার শ্রী অতীশ দীপঙ্কর মাদকবিরোধী সম্মাননা’২০১৪,  ঢাকার নবাব সিরাজউদ্দৌলা স্বর্ণপদক’২০১১ ও ফরিদপুরের নির্ণয় স্বর্ণ পদক’২০০৮ অর্জন করেন।

পিছিয়ে পড়া সুবিধা বঞ্চিত মানুষ বিশেষতঃ নারীদের জীবন-মানের উন্নয়নের লক্ষ্যে পরিচালিত কর্মপদ্ধতি সম্পর্কিত অভিজ্ঞতা বিনিময় এবং প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় তিনি নেপাল, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, সিংগাপুর ও ভারত সফর করেছেন।

তিনি একজন সঙ্গীতশিল্পী, অভিনেত্রী এবং সাংস্কৃতিক সংগঠক। ২০০৫ সালে তার গণসঙ্গীতের অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। মঞ্চ নাটকে ১০০তম অভিনয়ের জন্য তিনি সংবর্ধনা পেয়েছেন। এছাড়াও তিনি বেশ কয়েকটি টেলিভিশন নাটকে অভিনয় করেছেন। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট পরিচালনা পর্ষদের তিনি সদস্য।

তিনি একজন লেখক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক। ‘নারী আলেখ্য: ফরিদপুর’ শিরোনামে তার একটি গবেষণাধর্মী প্রকাশনা রয়েছে। জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি আয়োজিত সেমিনারে ‘সংস্কৃতি চর্চায় বৃহত্তর ফরিদপুরের নারী: একটি প্রয়াস’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করে তিনি প্রশংসা অর্জন করেন।

নির্যাতিত নারীর ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে পাশে থেকে লড়াই  করেন মুক্তা। যৌনকর্মীদের অধিকার রক্ষায় সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে তিনি কাজ করেন। এ পর্যন্ত ১১টি নির্যাতিত নারী ও শিশুর মামলায় ন্যায়বিচার হিসেবে আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রাপ্তিতে আইনগত সকল সহায়তা এবং অভিভাবকদের যাতায়াত ও থাকা-খাওয়ার যাবতীয় ব্যয় গ্রহণ করেছেন।

তার কাজের প্রেক্ষিত বিবেচনায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সরকারি কমিটিতে তাকে সদস্য করা হয়েছে। জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটি, জেলা নারী ও শিশু কল্যাণ কমিটি, জেলা আইনগত সহায়তা কমিটি, জেলা অ্যাসিড মামলা মনিটরিং কমিটি, জেলা একটি বাড়ি একটি খামার কমিটি, জেলা কমিউনিটি পুলিশিং কমিটি, কারাগারে আটক শিশু কিশোর-কিশোরীদের অবস্থা উন্নয়নের লক্ষ্যে টাস্কফোর্স কমিটি, সামাজিক প্রতিবন্ধী কেন্দ্র পরিচালনা কমিটি, টাউন লেভেল কো-অর্ডিনেটশন কমিটি (টিএলসিসি), স্কুল এবং কলেজগুলোর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। তিনি দুই মেয়াদে ফরিদপুর জেলা কারাগারের ভিজিটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

এছাড়া ফরিদপুর ডায়াবেটিক সমিতি, জেলা রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি, সন্ধানী ডোনার ক্লাব, ডা. জাহেদ মোমোরিয়াল শিশু হাসপাতালের আজীবন সদস্য আসমা আক্তার মুক্তা।

সরকারী রাজেন্দ্র কলেজে ১৯৮৯-৯০ সালের ছাত্র-ছাত্রী সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগ থেকে মহিলা সম্পাদক হিসেবে জয়লাভ করেন।

জাতীয় পর্যায়েও রয়েছে তার সবল পদচারণা। তিনি ঢাকায় জাতীয় নারী নির্যাতন প্রতিরোধ ফোরামের সদস্য সচিব, গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী কমিটির সাবেক বোর্ড সদস্য, কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল ফর হিউম্যান রাইটস ইন বাংলাদেশের (সিসিএইচআরবি) নির্বাহী কমিটির সদস্য, কর্মজীবী নারী’র সদস্য, বাংলাদেশ জেন্ডার অ্যান্ড ট্রেড নেটওয়ার্কের (বিজিটিএন) সদস্য, গ্রামীণ জীবনযাত্রার স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের জন্য প্রচারাভিযানের ঢাকা (সিএসআরএল) নারী দলের নির্বাচিত দলনেতা।

জীবনের প্রায় ৫০টি বছর পার করেছেন মুক্তা। তার মধ্যে আন্দোলন-সংগ্রামেই কেটেছে তিন যুগ। বয়সের ছাপ নেই চোখে মুখে আর আচরণে তা বোঝার জো নেই। সর্বদা হাসি-খুশি চিরসবুজ এই নারী জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সমাজ বির্নিমাণে কাজ করে যাবেন বলে পণ করেছেন।

বাংলাদেশ সময়: ২১৫০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৬, ২০১৫
আরকেবি/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।