ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

বাস্তুহারা মুক্তিযোদ্ধার আশ্রয়ই ভাঙলো ৩ বার

হুসাইন আজাদ, সিনিয়র নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮২৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০১৬
বাস্তুহারা মুক্তিযোদ্ধার আশ্রয়ই ভাঙলো ৩ বার ছবি: জি এম মুজিবুর / বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

শায়েস্তাগঞ্জ, হবিগঞ্জ থেকে ফিরে: একাত্তরের রণাঙ্গণে যার হুংকারে হানাদার শিবির কেঁপেছিল, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তারই চোখে-মুখে জগতের নীরবতা-অসহায়ত্ব। দেশকে স্বাধীন করতে যিনি জীবনবাজি করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে, সেই তিনি স্বাধীনতার পর পাননি নিজেরই ঘুমোনোর ঘর।

অসহায় হয়ে শায়েস্তাগঞ্জের রেলওয়ে স্টেশনের পাশে গড়ে ওঠা বস্তিতে আশ্রয় নিলেও তার সেই আশ্রয়টাও ভেঙেছে তিন তিনবার।

হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা মাহতাব আলীর জীবনের গল্প বলতে এভাবে ক্ষোভ-অভিমান প্রকাশ করছিলেন স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সেনাবাহিনীতে চাকরি করলেও ৩ নম্বর সেক্টরের এ ‘নির্বোধ’ বীরযোদ্ধা জীবনে চলার কোনো নিশ্চয়তা গড়তে পারেননি। এ কারণে ১৯৭৯ সালে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়ার পর এখানে-সেখানে কাটাতে হয়েছে তাকে। পরে রেলওয়ে স্টেশনের পাশে বস্তিটাতে আশ্রয় বাঁধলেও তার এই ‘ভাঙা-ঘর’টাও ভেঙেছে তিনবার।

শীতের সকাল। শায়েস্তাগঞ্জ স্টেশন রোড থেকে মিনিট পাঁচেক হেঁটে বাংলানিউজ যখন ওই বস্তির পথে এগোচ্ছিল, তার সামনে ট্রেনের পরিত্যক্ত পাতে বসে রোদ পোহাচ্ছিলেন আবদুল গফুর, শাহ মোস্তফা কামাল, রোকেয়া খাতুনসহ কয়েকজন। তাদের মাঝখানটায় বসে পুরনো লুঙ্গি ও হলুদ পাঞ্জাবি পরিহিত মুক্তিযোদ্ধা মাহতাব আলী। বিড়ি ফুঁকছিলেন তিনি। ফুঁকছিলেন গফুর আলীও। আর পান চিবোচ্ছিলেন রোকেয়া।

খোঁজখবর জানতে চাইলে প্রথমে কথা বললেন না মাহতাব আলী। তারপর খানিকটা অভিমানের সুরেই অন্যদিকে ফিরে শব্দ তুললেন, ‘আমরা নিরীহ মানুষ, আমরার খবর কে নিত?’

ঢাকার সংবাদকর্মী পরিচয় পেয়ে ঘুরে বসলেন। বিচার দেওয়ার জন্য কাউকে পাওয়া গেল-এমন একটা ভঙ্গিতে আগ্রহী হয়ে উঠলেন। নিজের পরিচয় জানালেন, ৩ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা। লড়েছেন চুনারুঘাটের বালা সীমান্ত এলাকার রণাঙ্গণে। হানাদারদের শায়েস্তা করে বিজয়ের ক’দিন আগে ৮ ডিসেম্বর এখানকার অস্ত্র জমা নেওয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত ৩ নম্বর সেক্টরের সাবসেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন এজাজের কাছে ৩৬৫টি অস্ত্র জমা দিয়েছেন তিনি।

দিনকাল কেমন চলছে জানতে চাইলে প্রথমে তিনি কিছু বললেন না। বললেন সঙ্গে থাকা স্থানীয় সাংবাদিক শাহ মোস্তফা কামাল, ‘দাঁড়ানোর জায়গাই নেই। দিনকাল আর চলবে কেমন!’

মাহতাব আলীর গ্রামের বাড়ি শায়েস্তাগঞ্জের লেঞ্জাপাড়ার নিজগাঁওয়ে। বাবার এ দুরন্ত ছেলে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর অর্থ-সম্পত্তির হিসাবের ধার ধারেননি, ঝাঁপিয়ে পড়েছেন দেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ে। মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু সেখানে প্রায় আট বছর চাকরি করেও পরবর্তী জীবনে চলার জন্য ‘কিছু’ যোগাড় করতে পারেননি। এ কারণে দশকের পর দশক তাকে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে রেলওয়ের বস্তিতে, ভাঙা-গড়ার সংগ্রামে।

মাহতাব আলী বিয়ে করেছেন তিনটি। প্রথম স্ত্রী পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন অনেক আগে। দ্বিতীয় স্ত্রীও অসুস্থ। তৃতীয় স্ত্রীই এখন সংসার সামলানোর ঝক্কি পোহাচ্ছেন। এই তিন স্ত্রীর ঘরে তিন ছেলে ও ছয় মেয়ে। তিন ছেলের মধ্যে বড়জনের নাম শহীদ মিয়া, বাসের হেলপারের কাজ করছেন তিনি। মেঝোজনের নাম শফিক মিয়া, মেট্রিক পর্যন্ত পড়ার পর তার মেমোরি লস হয়ে যায়। আর কনিষ্ঠ ছেলের নাম আবুল কালাম, ক্লাস ওয়ানে পড়ছে সে।

ছয় মেয়ের মধ্যে বড় চারজন যথাক্রমে সুফিয়া আক্তার, রোকেয়া আক্তার, রোমানা আক্তার ও আসমা আক্তারের বিয়ে হয়েছে। কিন্তু যৌতুক দিতে না পারায় রোকেয়াকে তাড়িয়ে দিয়ে আরেকটি বিয়ে করেছে তার স্বামী। আর ছোট দুই মেয়ে সুমনা ও শাবানা আক্তার স্কুলে পড়ছে।

মোস্তফা কামাল যখন বলছিলেন ‘দাঁড়ানোর জায়গাই নেই’, তখনই মুখ ফেরান মাহতাব আলী। তার কথা থামতেই বলে ওঠেন, ‘মুক্তির জন্য যুদ্ধ করি অখন থাকার জায়গা নাই। ’

মাহতাব আলী বলতে থাকেন, ‘আমারে মাসে ৮ হাজার টেকা ভাতা দেয়। এই বড় সংসার ৮ হাজার টেকায় চলে? আমার থাকার ঘরই নাই। ’

কথা বলতে বলতে বলতে ট্রেনের পাত থেকে উঠে বস্তির দিকে পা বাড়ান, ‘এই বস্তি-ঘরটায় সন্তান-পরিবার লই থাকি। এই আশ্রয় ৩ বার ভাঙছে। কী জানি কী করতে। ’ ভাঙাচোরা টিনশেডের ঘরটার ভেতরে এলোমেলো পুরনো কাঁথা-বালিসসহ জিনিসপত্র। পুরনো টেবিল-চেয়ার-চৌকিগুলো দাঁড়িয়ে আছে বারবার পৃথকভাবে লাগানো খুঁটির ওপর।

রেলের জায়গা বলে কর্তৃপক্ষই ভেঙেছে বলে জানেন মাহতাব আলীও। কিন্তু তবু তার আবদার-ক্ষোভ, ‘আমি মুক্তিযুদ্ধ করি নাই? আমার ঘর নাই কেন? আমার বাসস্থান নাই কেন? কত জনেরে বলছি, কেউ দেখতে আসে নাই। এখন আমি অসহায়। এখান থেকে সরাই দিলে আমি কই যাইতাম?’

আবদারটা বলেই ফেলেন মাহতাব আলী, ‘আমার এখন বাসস্থান দরকার। সরকারের কাছে আমার দাবি। একবার ভাঙবো, আবার বানাইতাম, আবার ভাঙবো, আবার বানাইতাম পারতাম না। একটা শক্ত বাসস্থান চাই। ’

তার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে যখন আলাপ হচ্ছিল, তখন অন্য বস্তি ঘর  এবং এর আশপাশ থেকেও লোক এসে জড়ো। গফুর আলী-মোস্তফা কামালদের সঙ্গে তারাও বলছিলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ কইরা লোকটা এখন বস্তিতে পড়ে আছে। নির্বাচন অইলে লোকজন মাঝে-মধ্যে এদিকে আসে। কিন্তু তার খোঁজ নেয় না কেউ!’

বাংলাদেশ সময়: ০৮২৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০১৬
এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।