ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

মুক্তিযুদ্ধকালীন কূটনীতি ও বিশ্ব গণমাধ্যম

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১০২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১২, ২০১৬
মুক্তিযুদ্ধকালীন কূটনীতি ও বিশ্ব গণমাধ্যম ছবি: সংগৃহীত

১২ ডিসেম্বর ১৯৭১। সর্বাত্মক যুদ্ধের নবম দিন। এর আগে ডিসেম্বরের ৩ তারিখ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কলকাতায় এক জনসভায় বক্তৃতা করছিলেন।

১.
১২ ডিসেম্বর ১৯৭১। সর্বাত্মক যুদ্ধের নবম দিন।

এর আগে ডিসেম্বরের ৩ তারিখ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কলকাতায় এক জনসভায় বক্তৃতা করছিলেন। সভাতে বসেই তিনি খবর পেলেন ইয়াহিয়া খান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। শুধু তা-ই নয, পাকিস্তান ভারতের কয়েকটি জায়গায় বিমান হামলাও চালিয়েছে।

আসলে ২৫ মার্চ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগ করার মধ্য দিয়েই পাকিস্তানিদের নৈতিক পরাজয় ঘটে যায়। ডিসেম্বরের প্রথম থেকেই মূলত সামরিক পরাজয়ের লক্ষণ স্পষ্ট হতে থাকে। ‘নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল’-এ পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণ করার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

ডিসেম্বরের ১২ তারিখের আগেও পাকিস্তানি বাহিনী রণাঙ্গন থেকে যুদ্ধ বিরতির ঘোষণা করার জন্য রাওয়ানপিন্ডির কাছে আহবান জানিয়েছিল। কিন্তু রাওয়ালপিন্ডি সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।  

ডিসেম্বরের ১২ তারিখ জেনারেল রাও ফরমান আলী আগের মতোই গভর্নরের কাছে যুদ্ধবিরতির একটি খসড়া পেশ করেন। রাও ফরমান আলীর সে খসড়া প্রস্তাবটি গভর্নর পাঠিয়ে দিলেন ইয়াহিয়া খানের কাছে।

এখানে স্মর্তব্য, রাও ফরমান আলী হচ্ছেন সেই ব্যৌক্তি ইয়াহিয়া খান যাকে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ বাস্তবায়নের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। মাত্র নয় মাসের ব্যাবধানে সেই রাও ফরমান আলীই যুদ্ধবিরতি তথা আত্মসমর্পণের অনুমতি চেয়ে প্রস্তাব পেশ করেন ইয়াহিয়ার কাছে।

পরাজয় নিশ্চিত জেনেই ইয়াহিয়া খানের কাছে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবটি পাঠানো হয়। এই প্রস্তাবে রাও ফরমান আলী ‘নিরাপরাধ (!)মানুষের  জীবন রক্ষার জন্য সম্ভাব্য সবকিছু করতে ইয়াহিয়া খানের প্রতি সর্নিবন্ধ অনুরোধ করেন’।   

২.
যুদ্ধ কেবল অস্ত্রের কারবার নয়। পাকিস্তানিদের ছিল আধুনিক মারণাস্ত্র আর আমাদের ছিল লাঠি-বাঁশ, তীর-ধনুক, সড়কি-বল্লম, লগি-বৈঠা আর সেই সঙ্গে ন্যায্য নৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থান। ন্যায়সঙ্গত নৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থান থাকার কারণেই বিশ্বের অপরাপর দেশগুলোর নৈতিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সহায়তা ও অনুমোদন পেতে আমাদের খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। মার্চ থেকে যতোই দিন গড়িয়েছে, ততোই আমাদের পক্ষে বেশিরভাগ প্রভাবশালী রাষ্ট্র কূটনৈতিক সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। অনেক রাষ্ট্র অস্ত্র দিয়ে না হোক, আমাদের দিকে নৈতিক ও মানবিক সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। একাত্তরে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তের শান্তিকামী মানুষ, রাষ্ট্র, সংগঠন যারা কোনো না কোনোভাবে আমাদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল, আমাদের পক্ষে সোচ্চার হয়েছিল তাদের কাছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বা আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ চিরঋণী।

মু্ক্তিযুদ্ধে ভারত আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। আবার অনেকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দেয়নি। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে উপস্থিত ১১৭টি দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে ৫৫ জন প্রতিনিধি বাংলাদেশ-ইস্যুতে এক বিতর্কে অংশ নেন। তাদের মধ্যে অনেকে শুধু মানবিক বিষয়টির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। অনেকে আবার রাজনৈতিক সমাধানের পক্ষে মত দেন। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মতো দুই-দুইটি ভেটো ক্ষমতাধর দেশ সুস্পষ্টভাবেই আমাদের বিরোধিতা করে। ভেটো ক্ষমতাধর পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন ছাড়া অন্য ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর অবস্থান তখনও পরিষ্কার ছিলো না।

তবে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের অবস্থান বরাবরই আমাদের পক্ষে ছিল। এ অঞ্চলে চীন আমাদের বিপক্ষে ছিল। তারপরও নানাবিধ ঝুঁকি মাথায় নিয়ে ভারত আমাদের পক্ষে জোরালো অবস্থান নেয়। ১৯৭১-এর ১৪ এপ্রিলের একটি খবর। ভারতের প্র্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী এক সংবাদ সম্মেলনে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে জানিয়ে দেন:“পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তার প্রতি চীনের প্রকাশ্য সমর্থন সত্ত্বেও  আমাদের অবস্থানে কোনো পরিবর্তন হবে না”।

৩.
তবে আন্তর্জাতিক বিশ্বের কূটনৈতিক টানাপোড়েন থাকলেও বিশ্বের বেশিরভাগ গণমাধ্যমই আমাদের পক্ষে ছিল। তাদের ইতিবাচক প্রতিবেদন ও মানবিক অবস্থান আমাদের জন্য ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। বিশ্বের প্রায় সব প্রধান সংবাদপত্রই বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট, পাকিস্তানি বাহিনীর সীমাহীন হত্যাযজ্ঞ ও চলমান চরম মানবিক বিপর্যয়কে বিশেষ গুরুত্বের সাথে তুলে ধরে। এসবের ওপর তারা ক্রমাগত সংবাদ ও সম্পাদকীয় ছাপিয়ে গেছে।

নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, দ্য গার্ডিয়ান, ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটরসহ বহু প্রথম সারির দৈনিক পত্রিকাই বাংলাদেশে চলমান হত্যাযজ্ঞকে বিশ্ব বিবেকের কাছে তুলে ধরেছে। যদিও মার্কিন সরকারের ভূমিকা ছিল এর পুরো বিপরীত।

যুদ্ধের একদম শুরুর দিকেই নিউইয়র্ক টাইমস মন্তব্য করেছিল: ‘এই গৃহযুদ্ধ পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হলেও গেরিলাযুদ্ধের রূপ পরিগ্রহ করলে তা বিপজ্জনক আন্তর্জাতিক পরিণতি সৃষ্টি করবে। এই পরিস্থিতিতে বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহের উচিৎ এই মর্মে চাপ দেওয়া যাতে রক্তপাত বন্ধ করে জনগণের নির্বাচিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া হয়। ’

যুক্তরাষ্ট্র সরকারের রাজনৈতিক অবস্থান যতো বৈরী ও বিপরীতই হোক হোক, তাদের গণমাধ্যম কিন্তু আমাদের ন্যায্য দাবি ও অবস্থানের পক্ষেই কথা বলেছে।

ওয়াশিংটন পোস্ট ও নিউইয়র্ক টাইমস সহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা একই সুরে আমাদের পক্ষে কথা বলেছে। স্বদেশের নাগরিকদের হত্যার জন্য তারা ইয়াহিয়াকে দায়ী করেছে।  

মার্কিন বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিকসহ সাধারণ নাগরিকরা পূর্ব-পাকিস্তান সংকটের রাজনৈতিক সমাধান চেয়েছিলেন। তারা পূর্ব-পাকিস্তানে জরুরি ত্রাণ সামগ্রী পাঠানোরও দাবি জানিয়েছিলেন। মার্কিন সিনেটর ও কংগ্রেস সদস্যরাও মার্কিন সরকারের নির্লিপ্ততা ও পক্ষপাতদুষ্টতার কঠোর সমালোচনা করেছিলেন।

সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে যুদ্ধ করেই বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহ স্বাধীনতা লাভ করেছে। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর বিশিষ্ট রাজনৈতিক চিন্তাবিদ কৌটিল্য বা চাণক্য বলেছিলেন: ‘রাষ্ট্রের জন্ম হয় যুদ্ধ থেকে’(“the origin of state is through war”)। যু্দ্ধ ছাড়া স্বাধীনতা অর্জনের আর কোনো সহজ পথ নেই। একাত্তরে আমাদেরও সে পথেই হাঁটতে হয়েছিল। আমাদের মরণপণ লড়াই, অপরিসীম আত্মত্যাগই আমাদের রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও নৈতিক বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছিল।

বাংলাদেশ সময়: ১৭০২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১২, ২০১৬
জেএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।