ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হারানোর দিন 

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৩, ২০১৬
শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হারানোর দিন  প্রতীকী

১৯৭১ সালের ডিসেম্বর। মহান মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের আকাশে উদিত হচ্ছিলো স্বাধীনতার নতুন সূর্য। বিজয়ের সেই উষালগ্নে এ জাতিকে মেধাশূন্য করতে নারকীয় বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের এদেশীয় দোসররা।

ঢাকা: ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর। মহান মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের আকাশে উদিত হচ্ছিলো স্বাধীনতার নতুন সূর্য।

বিজয়ের সেই উষালগ্নে এ জাতিকে মেধাশূন্য করতে নারকীয় বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের এদেশীয় দোসররা।

মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয়মাসেই পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের জ্ঞানী-গুণি ও মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের হত্যা করেছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। তবে ডিসেম্বরে যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এসে পাকিস্তানি বাহিনী যখন বুঝে ফেলে যে, তাদের পক্ষে যুদ্ধে জেতা সম্ভব নয়, তখনই তারা নবগঠিত দেশকে সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও শিক্ষাগত দিক থেকে দুর্বল ও পঙ্গু করে দেওয়ার নীলনকশা করে।  

সে পরিকল্পনা অনুসারে ১০ ডিসেম্বর থেকে ১৪ ডিসেম্বর রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর ও আল শামস বাহিনীর সদস্যরা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নিজ নিজ বাড়ি থেকে তুলে এনে নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করে। রাজধানী ঢাকায় কবি-সাহিত্যিক, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, গবেষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক ও বরেণ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের বেছে বেছে হত্যা করে জামায়াতের ঘাতক স্কোয়াড ইসলামী ছাত্রসংঘের রূপান্তরিত আলবদর বাহিনী।
  
স্বাধীন জাতি হিসেবে যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ যেন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, সেজন্যই ছিলো এই ঘৃণ্য পৈশাচিকতা।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের ক্ষত-বিক্ষত ও বিকৃত মরদেহ রায়েরবাজারের পরিত্যক্ত ইটখোলা ও মিরপুর বধ্যভূমিতে পাওয়া যায়। মরদেহে ছিলো নিষ্ঠুর নির্যাতনের চিহ্ন। অনেকের চোখ, হাত-পা বাঁধা ছিলো। কারো শরীর গুলিতে ঝাঁঝরা, কাউকে হত্যা করা হয় ধারালো অস্ত্র দিয়ে। অনেকের মরদেহ শনাক্তও করা যায়নি, পাওয়াও যায়নি বহু বুদ্ধিজীবীকে।  

বধ্যভূমিগুলোর সন্ধান পাওয়ায় উন্মোচিত হয় পরাজিত শক্তি ও দোসরদের বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা। হানাদারদের পৈশাচিকতায় স্তম্ভিত হয়ে পড়ে গোটা বিশ্ব।
 
নির্মম সে হত্যাকাণ্ড ও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ করে প্রতি বছর ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশে পালিত হয় শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস।  
 
বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিশনের দলিল থেকে জানা গেছে, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা ও নেতৃত্ব দেন পাকিস্তানি মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। তাকে সহযোগিতা করেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার বশীর আহমেদ, ব্রিগেডিয়ার রাজা, ব্রিগেডিয়ার আসলাম, ক্যাপ্টেন তারেক, কর্নেল তাজ ও কর্নেল তাহের।  

তালিকা প্রস্তুত, পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে তুলে দেওয়া ও হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নে ছিল কুখ্যাত আলবদর বাহিনী। এ বাহিনীর দুই শীর্ষনেতা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের নির্দেশনায় বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রধান ঘাতক ছিলেন চৌধুরী মঈনুদ্দীন (অপারেশন ইনচার্জ) ও আশরাফুজ্জামান খান (প্রধান জল্লাদ)। এছাড়া আরো ছিলেন এ বি এম খালেক মজুমদার, মাওলানা আবদুল মান্নান, আবদুল কাদের মোল্লা, ভিসি প্রফেসর ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইন, ড. মোহর আলী। চট্টগ্রামে প্রধান হত্যাকারী ছিলেন ফজলুল কাদের চৌধুরী ও তার দুই ছেলে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও গিয়াস কাদের চৌধুরী।
 
তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়, এদেশের ২০ হাজার বুদ্ধিজীবীকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন রাও ফরমান আলী। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ায় পরিকল্পনা অনুসারে নিধনযজ্ঞ চালাতে পারেনি হানাদাররা।
 
স্বাধীনতা পরবর্তী পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ, ১৯৭২ সালে জাতীয়ভাবে প্রকাশিত বুদ্ধিজীবী দিবসের সঙ্কলন ও  আন্তর্জাতিক নিউজ ম্যাগাজিন ‘নিউজ উইক’র সাংবাদিক নিকোলাস টমালিনের লেখায় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যা ১ হাজার ১১১ জন বলে উল্লেখ করা হয়।    তাদের মধ্যে শিক্ষাবিদ ৯৯১ জন, সাংবাদিক ১৩ জন, চিকিৎসক ৪৯ জন, আইনজীবী ৪২ জন এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিল্পী ও প্রকৌশলী ১৬ জন।
 
বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিশনের আহ্বায়ক চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান বলেছিলেন, এরা নির্ভুলভাবে বাংলাদেশের গণতন্ত্রমনা বুদ্ধিজীবীদেরকে বাছাই করে আঘাত হেনেছে। তদন্ত সম্পন্নের আগে ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি নিখোঁজ হন জহির রায়হানও। পরবর্তীতে তিনিও শহীদ তালিকাভুক্ত হন।
 
পরবর্তীতে বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ফের তদন্ত কমিটির উদ্যোগ নিলেও তা হয়ে ওঠেনি।
 
রাজাকার, আলবদর, আল শামসসহ এদেশীয় দোসরদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে শহীদ অগণিত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে কয়েকজন হলেন- অধ্যাপক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, অধ্যাপক ড. মুনির চৌধুরী, অধ্যাপক ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক ড. আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক ড. আবুল খায়ের, অধ্যাপক ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, অধ্যাপক ড. সিরাজুল হক খান, অধ্যাপক ড. এ এন এম ফাইজুল মাহী, হুমায়ূন কবীর, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, সাজিদুল হাসান, ফজলুর রহমান খান, এন এম মনিরুজ্জামান, এ মুকতাদির, শরাফত আলী, এ আর কে খাদেম, অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য, এম এ সাদেক, এম সাদত আলী, সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য, গিয়াসউদ্দিন আহমদ, ডা. এম মর্তুজা, ড. হবিবুর রহমান, ড. সুখারঞ্জন সমাদ্দার, মীর আবদুল কাইউম, অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ফজলে রাব্বি, অধ্যাপক ডা. আলিম চৌধুরী, অধ্যাপক ডা. শামসুদ্দীন আহমেদ, অধ্যাপক ডা. আব্দুল আলিম চৌধুরী, ডা. হুমায়ুন কবীর, ডা. আজহারুল হক, ডা. সোলায়মান খান, ডা. আয়েশা বদেরা চৌধুরী, ডা. কসির উদ্দিন তালুকদার, ডা. মনসুর আলী, ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা, ডা. মফিজউদ্দীন খান, ডা. জাহাঙ্গীর, ডা. নুরুল ইমাম, ডা. এস কে লালা, ডা. হেমচন্দ্র বসাক, ডা. ওবায়দুল হক, ডা. আসাদুল হক, ডা. মোসাব্বের আহমেদ, ডা. আজহারুল হক, ডা. মোহাম্মদ শফী, সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সার, সাংবাদিক নিজামুদ্দীন আহমেদ, সাংবাদিক সেলিনা পারভীন, সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, সাংবাদিক আ ন ম গোলাম মুস্তফা, সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেব, সাংবাদিক শহীদ সাবের, সৈয়দ নাজমুল হক, গীতিকার ও সুরকার আলতাফ মাহমুদ, রাজনীতিবিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত,  সমাজসেবক ও দানবীর রণদাপ্রসাদ সাহা, শিক্ষাবিদ ও আয়ূর্বেদিক চিকিৎসক যোগেশ চন্দ্র ঘোষ,     লেখক ও চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান, কবি মেহেরুন্নেসা, শিক্ষাবিদ ও গণিতজ্ঞ ড. আবুল কালাম আজাদ, আইনজীবী নজমুল হক সরকার, সমাজসেবক ও আয়ূর্বেদিক চিকিৎসক নূতন চন্দ্র সিংহসহ আরও অনেকে।  

বুধবার (১৪ ডিসেম্বর) গোটা জাতি যথাযোগ্য মর্যাদা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করবে হারানো শ্রেষ্ঠ সন্তানদের।
 
সূর্যোদয়ের ক্ষণে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ ও কালো পতাকা উত্তোলনের মধ্যে দিয়ে শুরু হবে জাতীয় শোকাবহ এ দিবসের কর্মসূচি।
 
সকাল ৭টা ০৫ মিনিটে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ ও ৭টা ১০ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মধ্যে শুরু হবে শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন।
 
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদনের পর সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।

জাতীয় সংসদের স্পিকার, প্রধান বিচারপতি, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে মিরপুর ও রায়েরবাজার বধ্যভূমির বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানানো হবে।  
 
সারাদেশের সব বধ্যভূমি ও বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে জনতার ঢল নামবে। ফুলে ফুলে ছেয়ে যাবে স্মৃতিসৌধ, শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় স্মরণ করা হবে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের।
 
দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন স্মরণসভা, আলোচনা সভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে।
 
সকালে মিরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর ধানমণ্ডির বঙ্গবন্ধু ভবনে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিকেলে তিনি খামারবাড়ির কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় যোগ দেবেন।
 
বাংলাদেশ সময়: ০০০৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৬
এমইউএম/এএসআর


 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।