ঢাকা, শনিবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

সেদিনের কথা মনে হলেই আঁতকে ওঠেন তারা

সোলায়মান হাজারী ডালিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৫১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০১৬
সেদিনের কথা মনে হলেই আঁতকে ওঠেন তারা ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার মুন্সীরহাটের জামমুড়া গ্রামে হানাদারের আর্টিলারী হামলায় ৩১ জন শহীদ হয়েছিলেন।

ফেনী: ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার মুন্সীরহাটের জামমুড়া গ্রামে হানাদারের আর্টিলারী হামলায় ৩১ জন শহীদ হয়েছিলেন।

 

যুদ্ধের ৪৫ বছর পেরিয়ে গেলেও সেই দিনের কথা আজো ভুলতে পারেননি স্বজনরা।

এখনো সেদিনের কথা মনে হলেই আতঁকে ওঠেন তারা।
 

ষাটোর্ধ্ব করিমুল হক বাংলানিউজের কাছে বর্ণনা করেন সেদিনের কথা।

তিনি বলেন, বোমার সে শব্দ এখনও স্পষ্ট। বোমার আঘাতে কারো হাত নেই, কারো পা, কারো বা দেহ থেকে মাথা আলাদা, সে এক বীভৎস চিত্র, কেউ না দেখলে তা বুঝবার নয়। এসময় ডুকরে কেঁদে ওঠেন তিনি।
 
যুদ্ধ চলাকালে ফেনী জেলার ফুলগাজী উপজেলার মুন্সীরহাটের জামমুড়া গ্রামে হানাদারের আর্টিলারী হামলায় তার পরিবারের ২৭ জনসহ মোট ৩১ জন শহীদ হয়। ওই দিন কাছারি ঘরে রাত যাপন করায় বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি। সেসময় তার বয়স ছিল ২৪ বছর। তিনি সেদিনের শহীদ অলি আহমদের ছেলে। ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

করিমুল হক বাংলানিউজকে বলেন, দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ১৭ই জুন। সারাদেশে চলছে তুমুল যুদ্ধ, জেলার পরশুরাম উপজেলার বিলোনীয়া সীমান্ত দিয়ে চলছিল মুক্তিবাহিনী ও হানাদার বাহিনীর পাল্টা-পাল্টি আক্রমণ।

তার দাদা আনা মিয়া চারদিন আগে মারা যান, পঞ্চম দিন ছিল কুলখানি। এ কুলখানিকে কেন্দ্র করে দূর-দূরান্ত থেকে আত্মীয় স্বজন আসে বাড়িতে। এশার নামাজের পর যথারীতি সবাই খাওয়া দাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়েন। এর কিছুক্ষণ পর শোনা যায় বোমার বিকট শব্দ সঙ্গে সঙ্গে উড়ে যায় দু’টি ঘর। নিহত হয় ৩১টি তাজা প্রাণ, কারো হাত নেই, কারো পা, কারো বা আবার দেহ থেকে আলাদা মাথা। করিমুল হক বলেন, বাড়ির বাইরে থাকাতে, বেঁচে গিয়েছিলাম, না হয় আমিও সেদিন শহীদ হতাম।
 
গ্রামের বাসিন্দা আরেক ষাটোর্ধ্ব শামছুল আলম চৌধুরী বলেন, কুলখানি উপলক্ষে ওই বাড়িতে অনেক মেহমান ছিল। বাড়ির পাশেই ছিল উত্তর জামমুড়া স্কুল। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাসহ চার শতাধিক মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল। পাকিস্তানী বাহিনী গভীর রাতে ওই স্কুলটিকে লক্ষ্য করে তিনটি বোমা নিক্ষেপ করে। বোমাগুলো লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে গিয়ে পড়ে আনা মিয়ার টিনশেড ঘরের চালায়। সঙ্গে সঙ্গে ৩১ জন অঙ্গার হয়ে যায়। পরে তাদের কবর দেওয়া হয়, যা এখন জামমুড়া গণকবর নামে পরিচিত।

গ্রামের আরেক বাসিন্দা সলিম উল্লাহ জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল ১৪ বছর। সেদিনের কথা আজো তার স্পষ্ট মনে পড়ে। ক্ষত-বিক্ষত মরদেহগুলোকে নিয়ে বাঁশের খাচি (এক ধরনের পাত্র) করে ৬টি কবরে শায়িত করা হয়েছিল।
 
সেদিনের কথা মনে হলে ভয়ে এখনো বুকটা কেঁপে ওঠে তার। তিনি জানান, বেশির ভাগ মরদেহই ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। তারা কয়েকজন গ্রামবাসী সেগুলোকে বাইরে বের করে আনেন। এরপর কোনোমতে গোসল দিয়ে বাড়ি থেকে কয়েকশ’ গজ পশ্চিমে আনা মিয়ার মালিকানাধীন একটি জমিতে দাফন করেন।

সেদিনের ঘটনায় শহীদ অলি আহম্মদের নাতনি তানিয়া তাবাচ্ছুম ক্ষোভের সঙ্গে জানান, মুক্তিযুদ্ধে তার পরিবারের অনেক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, নষ্ট হয়েছে সম্পত্তি কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ৪৫ বছর পেরিয়ে গেলেও শহীদ পরিবার হিসেবে আজো তারা পাইনি সে সম্মান আর রাষ্ট্রের থেকে সুযোগ সুবিধা। সহায় সম্পদ হারিয়ে বিরান হওয়া পরিবারগুলোর প্রতি সাহায্যের হাত বাড়ায়নি কেউ। এমনকি সরকারিভাবে সংরক্ষণও করা হয়নি এ গণকবর। অথচ এ গণকবরে শুয়ে আছেন ৩১ জন শহীদ।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তৎকালীন মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক সাবেক ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্য ভিপি জয়নাল বাংলানিউউজকে জানান, যুদ্ধের সময় এ পরিবারের উপর যে হামলা করা হয়েছিল তা গণহত্যাগুলোর অন্যতম। যুদ্ধের এতো বছর পার হয়ে গেলেও শহীদ পরিবার ও গণকবর রাষ্ট্রীয়ভাবে সংরক্ষণ না হওয়া দুঃখজনক ব্যাপার।

ফেনী জেলা পরিষদ প্রশাসক আজিজ আহম্মদ জানান, ইতোমধ্যেই ওই স্থানে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের কাজ শুরু করে দিয়েছে জেলা প্রশাসন। আশা করা যাচ্ছে, কয়েক মাসের মধ্যেই নির্মাণকাজ সম্পন্ন হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০১৬
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।