ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

‘আমি কিন্তু এখনো জেলা পরিষদের প্রশাসক!’

জাহিদুর রহমান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০১৭
‘আমি কিন্তু এখনো জেলা পরিষদের প্রশাসক!’ ঢাকা জেলা পরিষদের প্রশাসক হাসিনা দৌলা/ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: বাড়ির উঠোনে ফুটেছে কতো শত ফুল। ডালিয়া, হাসনাহেনা, কদমসহ নানা জাতের বাহারি ফুলের মুগ্ধ করা পরিবেশ। অথচ প্রকৃতির এক নিষ্ঠুর বৈপরীত্য বাড়ির মালিককেই ঘিরে।

একদিকে যখন ফুল ফুটছে, অন্যদিকে তখন তার ‘ক্ষমতার’ ফুল ঝরে পড়ছে এক একটি করে। কেবল ফুলই নয়, লতা-পাতা যেন ডালশুদ্ধই ঝরে যাওয়ার অপেক্ষায়।

তিনি হাসিনা দৌলা। সদ্য সাবেক হওয়ার পথে থাকা ঢাকা জেলা পরিষদের প্রশাসক ও সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি।

দীর্ঘ ৫ বছর জেলা পরিষদের প্রশাসকের দায়িত্ব পালনের পর আগামী ১৫ জানুয়ারি এ পদ ছাড়তে হচ্ছে হাসিনা দৌলাকে।

প্রকৃতি আর পরিবেশের বৈপরীত্যের মাঝে বসেই পান চিবুতে চিবুতে হাসিনা দৌলা বললেন, ‘আমি কিন্তু এখনো ঢাকা জেলা পরিষদের প্রশাসক। আরো ৫ দিন বাকি রয়েছে। তখন আমাকে সাবেক বলা যাবে। তার আগে নয়’।

বাড়ির দাওয়ায় বসে হাসিনা দৌলা, সামনে পানের কৌটা। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে সেখান থেকে পান তুলে চিবুচ্ছিলেন একটার পর একটা।

ক্ষমতা যে চিরস্থায়ী নয়, সেটি এক অদৃশ্য যাদুর চশমার অন্ধকারে রাখে ক্ষমতাসীন অনেককে। কেউ কেউ আবার ব্যতিক্রম।
 
কেমন হয় ‘ক্ষমতা’ ছেড়ে আসার মুহূর্তগুলো? চেনা মানুষগুলোর ভূমিকাই বা কি হয়? চারপাশের পরিবেশ? কিংবা নিজের উপলব্ধি?

এসব জানতেই বাংলানিউজ মুখোমুখি হয় হাসিনা দৌলার সঙ্গে।
ঢাকা জেলা পরিষদের প্রশাসকের রাড়ির সামনে ফুলেল বাগানপেছনে পিতলের বাঘের মূর্তি। এখানেও বৈপরীত্য। সেটিও যেন ক্ষমতার ছিন্নতার পরিহাস!

একটি দীর্ঘশ্বাস। সেটি কোনোমতে আড়াল করতেই মুখজুড়ে হতাশা। সেটিকে শুকনো হাসি দিয়ে ঢেকে ফেলার নিষ্ফল চেষ্টার মাঝেই হাসিনা দৌলা বললেন, ‘আগে একটি নিয়মের মধ্যে চলতে হতো। নয়টা-পাঁচটা অফিস। মিটিং ফিটিং। কতো কি! এখন তো আর অফিস-টফিস থাকবে না। নেই সেসব ব্যস্ততাও’।
‘আজ তো অফিস আছে। যাননি?’

‘না যাইনি। গিয়েই বা কি লাভ? বাসাতেই বসে থাকি’।

হাসিনা দৌলা বলেন, ‘বুধবার (১১ জানুয়ারি) শপথ নেবেন ঢাকা জেলা পরিষদের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান। আগামী ১৫ জানুয়ারি দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েই সাঙ্গ হবে আমার এ পদের আনুষ্ঠানিকতা’।

‘সে হিসেবে আমি কিন্তু এখনো জেলা পরিষদের প্রশাসক’।

কোথা থেকে যেন একরাশ শক্তি এনে কথাগুলো বলতেই আবার দম নেন।

‘খারাপ লাগছে না? সরকারি সুযোগ-সুবিধা, গাড়ি, ড্রাইভার। কোটি কোটি টাকার চেক সই করা, সরকারি আয়োজনে দাওয়াত। এসব মিস করবেন না?’

সবকিছুরই উত্তর মাত্র কয়েকটি শব্দে- ‘আমি কি গাড়িতে আগে চড়িনি! তবে হ্যাঁ, আমার এখন একজন ড্রাইভার নিতে হবে’।
‘মাইনে কতো দেবেন?

‘কতো আবার, তিনবেলা খাবে, থাকবে। মাস গেলে পাবে ৮ হাজার টাকা। এর বেশি দেওয়ার অবস্থা নেই। আছে নাকি জানা-শোনা এমন কেউ?’- উল্টো প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন হাসিনা দৌলা।

চারপাশে প্রস্ফূটিত ফুলের মাঝেও যেন ভিন্ন এক ধরনের বিষন্নতা গ্রাস করে নেয় গোটা পরিবেশ।
ঢাকা জেলা পরিষদের প্রশাসকের রাড়ির সামনে ফুলেল বাগানমাথার ওপরে থাকা গাছে বসা কাকের কা কা রব। সব মিলিয়ে যেন কুসংস্কারের অলুক্ষণে পরিবেশ।

‘ক্ষমতা চলে যাচ্ছে। খারাপ লাগে নি?’

‘খারাপ তো লেগেছেই। তবে সামলে নিয়েছি। একটু কষ্ট হলেও এখন আর তা নেই। নিজেকে মানিয়ে নিয়েছি বেশ’।

‘তবে হ্যাঁ, এখন বেশ সময় দিতে পারবো। আমার মেয়েটি মৃত্যুশয্যায়, ক্যান্সারে আক্রান্ত। ওর শেষ দিনগুলোতে মেয়েটার পাশে থাকতে চাই’- এক স্নেহময়ী মায়ের হাহাকার হাসিনা দৌলার কণ্ঠে।

‘আর কোনো পরিকল্পনা?’

‘আছে। দলটাকে গোছাতে চাই’।
ঢাকা জেলা পরিষদের প্রশাসকের বাসভবন
তবে কি এখন এলোমেলো? তা তো কিছুটা আছেই। সাভারে আওয়ামী লীগের সভাপতি হাসিনা দৌলা আর সাধারণ সম্পাদক আলী হায়দার যে দুই মেরুতে- সেটাও তো সবারই জানা।

‘সেটাকে এক মেরুতে আনার কোনো চেষ্টা করবেন কি?’

‘সেটা তো করে করেই ব্যর্থ’। ‘ফ’ আদ্যাক্ষরের এক নেতার নাম উচ্চারণ করে বললেন, ‘তার কারণেই সম্ভব হচ্ছে না’।
‘সংসদ সদস্যের সঙ্গে দূরত্ব! সেটার কি হবে?’

‘তিনি ভালো মানুষ। আমার এখন অবলম্বন একমাত্র নেত্রী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’।

জেলা পরিষদের প্রশাসকের দায়িত্বে থাকার সময় তো কোটি কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ উঠেছে। গ্রেফতারও হয়েছেন অনেকে। বেশ কয়েকটি মামলাও করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন।

‘তো এসব নিয়ে কোনো ভয় বা শঙ্কা কাজ করে কি-না?’

উত্তরে রেগে-মেগে বললেন, ‘কেন করবে? আমি কি দুর্নীতি করেছি? যা পারে করুক দুদক। আমি ওতে ভয় পাই না’।
ঢাকা জেলা পরিষদের প্রশাসকের বাসভবনক্ষমতার দিনগুলোতে বাড়ি জুড়েই থাকতো নানা শ্রেণী-পেশার মানুষের ভিড়। দলের নেতাকর্মীরাও আসতেন নানা তদবিরে।

তবে এখন গৃহকর্মী ছাড়া গোটা বাড়িটাই যেন খাঁ খাঁ করে। তার মাঝে কাকের কর্কশ ডাক ম্লান করে দেয় ফুল ফোটা বাগানের পরিবেশ।

বের হতেই গার্ডরুমে দেখা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের সরকারি গাড়িচালক মিজানুর রহমানের সঙ্গে।

‘৫টি বছর একসঙ্গে থাকার পর ছেড়ে যেতে কি কোনো কষ্ট হচ্ছে?’- প্রশ্নের জবাবে মিজানের সাফ জবাব, ‘কষ্ট হবে কেন? আমাদের ওসব ভাবলে চলে?। যিনি আসবেন, তাকে গাড়িতে নিয়েই তো চলতে হবে’।

‘মজার কথা হলো, নতুন চেয়ারম্যান আমার এলাকার। আর বর্তমানে আমার বাসা থেকে তার বেইলি রোডের বাসার দূরত্বও পায়ে হাঁটা পথ’।

বাড়ির বাইরে জেলা পরিষদের প্রশাসক হিসেবে হাসিনা দৌলার সাইনবোর্ডটিও যেন পাল্টে নিয়েছে নিজেকে। চকচকে সাইনবোর্ডটিও কেমন যেন ধূসর, বির্বণ। প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে বুঝি এভাবেই সবকিছুই পাল্টে যায়। ক্ষমতার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ তো বটেই, জড়বস্তুরও পাল্টে যাওয়াটিই যেন নিয়তি।

ক্ষমতার মোহে ক’জনই বা মনে রাখেন এ নিয়তির কথা!

বাংলাদেশ সময়: ১৬৪২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০১৭
জেডআর/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।