ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

জলাবদ্ধতায়ও টিকে থাকবে দিলীপের ‘চারুলতা’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩০৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৬, ২০১৭
জলাবদ্ধতায়ও টিকে থাকবে দিলীপের ‘চারুলতা’ চারুলতা ধান খেতে দিলীপ। ছবি: বাংলানিউজ

সাতক্ষীরা: সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলায় জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততা সহনশীল নতুন এক ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন কৃষক দিলীপ তরফদার। স্থানীয় খেঁজুরছড়ি ও কুটে পাটনাই জাতের ধান সংকরায়নের মাধ্যমে এই জাত উদ্ভাবন করেছেন তিনি।

মা মারা যাওয়ার পর চারুলতা নামে এক নারী দিলীপ তরফদারকে কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছেন। তাই দিলীপ এই নতুন ধানের নাম দিয়েছেন ‘চারুলতা’।

কৃষক দিলীপ তরফদারের চারুলতা ধান খেঁজুরছড়ি ও কুটে পাটনাইয়ের চেয়ে দ্বিগুণ উৎপাদনে সক্ষম। এমনকি বিআর ২২ ধানের চেয়েও বেশি ফলন দেয়। এর উৎপাদন খরচও তুলনামূলক কম। গাছ তুলনামূলক শক্ত, তাই সহজেই হেলে পড়ে না।

সংকরায়নের পর চলতি আমন মৌসুমে সাত বছর পেরিয়েছে চারুলতা ধান। এই ধান জলাবদ্ধ এলাকায় চাষ করে উপকার পেতে পারেন সাধারণ মানুষ।

শ্যামনগর উপজেলার মিঠা চন্ডিপুর গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, চলতি মৌসুমে দিলীপ এক বিঘা জমিতে চারুলতা ধানের (সপ্তম জেনারেশন) গবেষণা প্লট করেছেন। লম্বা শীষে শীষে ভরে উঠেছে তার ধান খেত। আশপাশের প্লটের ধান নুইয়ে পড়লেও চারুলতা রয়েছে শীষ উঁচিয়ে।

দিলীপ বাংলানিউজকে জানান, রোপা আমন মৌসুমে চাষাবাদের উপযোগী ধানের জাত চারুলতা। আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি সময়ে বীজতলা তৈরির মাধ্যমে এর আবাদ শুরু হয়। আর শেষ হয় অগ্রহায়ণ মাসে ধান কাটার মাধ্যমে। চাষাবাদের সময়কাল বিআর ২২ ও কুটে পাটনাইয়ের সমান হলেও খেঁজুরছড়ি থেকে ১৫ দিন কম।  

খেঁজুরছড়ি, কুটে পাটনাই বা বিআর ২২ উৎপাদনে যে পরিমাণ সার ও কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়, চারুলতা উৎপাদনে লাগে তার অর্ধেক। তাই খরচ কম হয়।

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো, খেঁজুরছড়িতে যেখানে বিঘা প্রতি ৮ থেকে ১০ মণ, কুটে পাটনাইয়ে ১২ থেকে ১৩ মণ এবং বিআর ২২-এ ১৮ মণ ধান পাওয়া যায়, সেখানে চারুলতার উৎপাদন ২০ থেকে ২২ মণ।

সংকরায়নে মায়ের ভূমিকা পালনকারী খেঁজুরছড়ির গাছ বেশ বড় এবং বাবার ভূমিকা পালনকারী কুটে পাটনাই তার থেকে আকারে কিছুটা ছোট হলেও তাদের থেকে উদ্ভাবনকৃত নতুন জাত চারুলতার আকার আরও ছোট। এর গাছ বেশ শক্ত হওয়ায় সহজে হেলে পড়ে না। শীষের গাথুনি খুব ঘন, শীষ অনেক লম্বা, শীষে ধানও বেশি হয়।

চারুলতা ধানের শেষাংশে কালো দাগ থাকে। যা দেখে বিআর ২২ থেকে সহজেই চারুলতাকে পার্থক্য করা যায়। এছাড়া শীষের বৈশিষ্ট্য বিআর ২২ ও অন্যান্য যে কোনো জাতের চেয়ে আলাদা। স্থানীয় অনেকেই দিলীপ তরফদারের কাছ থেকে চারুলতার বীজ নিয়ে জলাবদ্ধ জমিতে চাষাবাদ করে পেয়েছেন সফলতা।

আর তার এই কাজের স্বীকৃতি সরূপ স্থায়িত্বশীল কৃষি চর্চায় বিশেষ অবদান রাখায় দিলীপ তরফদারকে শ্যামনগর উপজেলা প্রশাসন দিয়েছে স্বাধীনতা সম্মাননা-২০১৬।

ধান জাত উদ্ভাবন নিয়ে কৃষক দিলীপ তরফদার বাংলানিউজকে জানান, ২০০৯ সালে বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজেনাস নলেজ (বারসিক) থেকে সংকরায়নের প্রশিক্ষণ নেন তিনি। এরপর ২০১০ সাল থেকেই শুরু করেন ধান জাত উদ্ভাবনের কাজ। এজন্য বেছে নেন স্থানীয় জাতের ধান খেঁজুরছড়ি এবং কুটে পাটনাই।

সংকরায়ন পদ্ধতি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, প্রথমে লবণাক্ত এলাকার জমিতে চাষ করা দু’টি জাতের দু’গোছা ধান তুলে এনে মাটিসহ বালতির ভেতরে রাখি। এরপর মা গাছের শীষ তিন ভাগের এক ভাগ বের হওয়ার পর শীষটি পুরো বের করা হয়। পরে শীষের মাঝামাঝি স্থানের ১৫-২০টি ধানের ভেতর থেকে পুরুষ অংশ বের করি। এ কাজে ছোট কাস্তে ও সুচ ব্যবহার করা হয়। এরপর শীষটি কাগজের প্যাকেট দিয়ে ঢেকে দেই। পরদিন পুরুষ জাতের শীষ নিয়ে আগের দিনের মা গাছের কাটা শীষের ওপর ঝাকিয়ে পরাগায়ন করি। পরপর দু’দিন একই কাজ করা হয়। পরাগায়নের পরই কাগজের প্যাকেট দিয়ে শীষটি ঢেকে দেই। এর ছয় সাতদিন পর প্যাকেট খুলে দেখি ধানের মধ্যে সবুজ চাল হচ্ছে। এরপর আবারো কাগজের প্যাকেট দিয়ে ঢেকে সাবধানতার সঙ্গে রাখি। চাল পুষ্ট হলে সাবধানে তা সংগ্রহ করে হালকা রোদে শুকিয়ে কৌটায় রেখে দেই। পরবর্তী মৌসুমে ভেজা টিস্যু পেপারের ওপর রেখে দিলে ধান গজিয়ে চারা হয়। যা পরে প্লাস্টিকের পাত্রে কাদামাটিতে রোপন করি। এ থেকে যে গাছ হয় এবং তা থেকে যে ধান সংগ্রহ করি তা পরের বছরের জন্য রেখে দেই। পরের বছর ওই বীজে গাছ হলে দেখি বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের গাছ ও ধান হয়েছে। এর ভেতর থেকে বৈশিষ্ট্য দেখে পছন্দ অনুযায়ী গাছ থেকে বীজ বাছাই করি ও পরের মৌসুমে চাষের জন্য রেখে দেই। এভাবেই চারুলতার সংকরায়ন সম্পন্ন হয়েছে। যার উৎপাদন আমন মৌসুমে চাষকৃত অন্যান্য ধানের চেয়ে বেশি, জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততা সহনশীল।

অন্যান্য কৃষকদের উদ্দেশে দিলীপ তরফদার বলেন, আমরা বাজারের বীজ কিনে লাগাই। কিন্তু সেই বীজের মান ভালো না। বাজারের বীজ চাষে সার-কীটনাশক বেশি লাগে। দু’তিন বছর চাষ করার পর বীজের মান ভালো থাকে না। এর চেয়ে নিজেরা বীজ তৈরি করে চাষ করলে প্রতিবছর ভালো বীজ পাওয়া সম্ভব। সার-কীটনাশকও কম লাগে, এমন জাত তৈরি করতে পারলে অনেক লাভ হবে।

এজন্য মাঠ দিবস করে কৃষকদের বীজ উদ্ভাবনে উদ্বুদ্ধ করার আহ্বান জানান তিনি।

বারসিক এর কৃষিবিদ পার্থ সারথী পাল বাংলানিউজকে বলেন, চারুলতা ধান সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী একটি জাত। তার উদ্ভাবন সত্যিই বিস্ময়কর। কিন্তু আমাদের দেশে কৃষক পর্যায়ে এ ধরনের গবেষণার স্বীকৃতি দেওয়ার রেওয়াজ নেই। অথচ দিলীপ তরফদারের কাজের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া উচিত, যাতে দেশের কৃষক সমাজ নিজেদের জ্ঞান ও চিন্তা শক্তিকে কাজে লাগিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।

শ্যামনগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আলী হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, দিলীপ তরফদার একজন দক্ষ কৃষক। এর আগে তার কাজের স্বীকৃতি সরূপ উপজেলা প্রশাসন তাকে সম্মাননা দিয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৯০৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৬, ২০১৭
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।