ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

‘বাপ-দাদার ভিটা ছাইড়তে অইবো মাগনা!’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৫৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩, ২০১৭
‘বাপ-দাদার ভিটা ছাইড়তে অইবো মাগনা!’ বাপ-দাদার রেখে যাওয়া জমি হারানোর আশঙ্কায় প্রায় ৪ হাজার কৃষক পরিবার। ছবি: বাংলানিউজ

সিরাজগঞ্জ: ‘বাপ-দাদার রাইহ্যা যাওয়া জমি চাষ কইরে চলে আমাগোরে সংসার। বাপের ভিটাতেই সন্তানাদি নিয়্যা বসবাস কইরত্যাছি। এইসব জমিতে কল-কারখানা বানাইবো। হুনতাছি, সরকার আমাগোরে জমি দাম ছাড়াই দহল নিবো। এব্যা অইলে আমরা থাকমু কোনে, কি কইর‌্যা খামু?’

এমন প্রশ্ন করেই ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার বড় বেড়া খারুয়া গ্রামের বৃদ্ধ কৃষক জেলহক সরকার।

নিজের সবজি বাগান থেকে শাক তুলতে তুলতে তিনি বলেন, ‘এহানকার জমি খুউব উর্বর।

ধান-সরিষা, সব রহমের সবজির ভালো আবাদ হয় এই ক্ষেতে। এ জমি গেলে আমরা নি:স্ব অইয়া যামু’।

উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের বড় বেড়া খারুয়া, বয়ড়া মাসুম চক ও খাস বড় শিমুল এলাকায় গেলে ক্ষোভের কথা জানান জেলহক সরকারের মতো অসংখ্য কৃষক। বিভিন্ন স্থানে খুঁটি পুতে লাল নিশান লাগানো হয়েছে।  ছবি: বাংলানিউজআশি বছর বয়সী আনোয়ার হোসেন জানান,  দাদা-পরদাদার আমল থেকে এই জমি এলাকাবাসীই চাষাবাদ করে আসছেন। ৩০/৩৫ বছর আগে নদীগর্ভে বিলীন হলেও ১৯৮৮ সালের বন্যার পর চর জেগে উঠলে জমি ফিরে পান তারা। আবারও বাড়ি-ঘর নির্মাণ ও গাছপালা রোপণ করেন’।

বয়ড়া মাসুম গ্রামের আমিনা, চন্দ্রবানু ও মেরিনা, বড় বেড়া খারুয়া গ্রামের হামিদ, বেলাল হোসেন, নুরুজ্জামান ও ছাইদসহ অনেক কৃষক বলেন,  হঠাৎ করে বিভিন্ন স্থানে খুঁটি পুতে লাল নিশান লাগানো হয়েছে। শোনা যায়, বেসরকারি উদ্যোগে ‘সিরাজগঞ্জ অর্থনৈতিক অঞ্চল’ গড়ে উঠবে এখানে।

স্থানীয়দের তথ্যমতে এখানকার ৪টি গ্রামের প্রায় ৪ হাজার কৃষক পরিবার পূর্বপুরুষদের নামে সিএস ও এসএ রেকর্ডকৃত জমিতে চাষাবাদ করে আসছেন। প্রায় ৩০ বছর আগে ওইসব জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। ৪/৫ বছর পর চর জেগে উঠলে ফিরে আসেন তারা। কিন্তু ১৯৮৫-১৯৯০ সালের মধ্যে শেষ হওয়া আরএস রেকর্ডভুক্ত হতে না পারায় সেগুলো নদী পয়োস্তির আওতায় পড়ে যায়।
আরএস রেকর্ডভুক্ত না হলেও দীর্ঘ ৩০ বছর ধরেই এসব সম্পত্তি কেনা-বেচা করে আসছিলেন চাষিরাই। গত সেপ্টেম্বর মাসে জেলা প্রশাসন ৩০০ কোটি টাকা মূল্যে বেসরকারি ইকোনমিক জোন কর্তৃপক্ষের নামে রেজিস্ট্রি করে দেওয়ায় তাদের মাঝে হতাশা নেমে এসেছে।

স্থানীয় মাতবর শহীদুল ইসলাম ও আওয়ামী লীগ নেতা শরীফুল ইসলাম বদর জানান, ১ হাজার ৩৫.৯৩ একর জমিতে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠবে। এর মধ্যে রয়েছে বেলকুচি উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের চারটি মৌজার ৯৮০.৪০ একর ও সদর উপজেলার সয়দাবাদ ইউনিয়নের দুই মৌজার ৫৫.৫০ একর জমি। ইতোমধ্যে সদর উপজেলার ওই ৫৫.৫০ একর জমির মূল্য পরিশোধের ব্যবস্থা করে ৭ ধারা জারি করা হলেও বেলকুচি উপজেলার ৯৮০.৪০ একর জমির মূল্য পরিশোধে সরকার নির্বিকার রয়েছে।

সিরাজগঞ্জ ইকোনমিক জোনের পরিচালক শেখ মনোয়ার হোসেন বলেন,  ‘উত্তরবঙ্গের মানুষের কর্মস্থল তৈরির লক্ষ্যেই এখানে ইকোনমিক জোন তৈরি করা হচ্ছে। এটি একটি বৃহৎ প্রকল্প। বেসরকারি হলেও এটি প্রধানমন্ত্রীর প্রকল্প। তিনি নিজ উদ্যোগে আমাদেরকে ডেকে নিয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছেন। ভূমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ প্রদান ও ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসিত করারও নির্দেশ দিয়েছেন। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে’।

‘ ইতোমধ্যে ১০০ বিঘা জমি স্থানীয়দের পুনর্বাসনে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সেখানে ক্ষতিগ্রস্তদের আবাসনের পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও রাস্তাঘাট গড়ে তোলা হবে’।

সিরাজগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মুহাম্মদ কামরুল হাসান জানান, বর্তমান সরকারের রুপকল্প-২০২১ ভিশনে মানুষের কর্মসংস্থানও রয়েছে। এ লক্ষ্যে সারাদেশে বেশ কিছু সরকারি-বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে। সিরাজগঞ্জেও বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠছে অর্থনৈতিক অঞ্চল। এ প্রকল্পে এলাকার ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া ও পুনর্বাসিত করার চিন্তাও সরকারের রয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ০১৫৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৪, ২০১৭
এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।