শুধু যে বাংলাদেশ তা নয়, এ ঘূর্ণিঝড় গোটা বিশ্বকেই কাঁপিয়ে দিয়েছিলো। ৩ মাত্রার ঘূর্ণিঝড়টি ওই বছরের ৮ নভেম্বর বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট হয়ে ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উত্তর দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
জলোচ্ছ্বাসের কারণে উপকূলীয় অঞ্চল ও দ্বীপসমূহ প্লাবিত হয়। ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় পাঁচ লাখ লোকের প্রাণহানি ঘটেছে বলে বলা হলেও বেসরকারি হিসাবে মারা যায় প্রায় ১০ লাখ লোকেরও বেশি। জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) বিশ্বের পাঁচ ধরনের ভয়াবহ প্রাণঘাতি আবহাওয়া ঘটনার শীর্ষ তালিকা প্রকাশ করে। ওই তালিকায় বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়টিকে পৃথিবীর সর্বকালের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণঘাতি ঝড় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে বলা হয়, ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর সন্ধ্যা থেকে ১৩ নভেম্বর ভোর পর্যন্ত বাংলাদেশের (তৎকালীণ পূর্ব পাকিস্তান) উপকূল অঞ্চলে সর্বকালের প্রাণঘাতি ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হানে। এ ঝড়ে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটেছে বাংলাদেশের ভোলা, নোয়াখালী-লক্ষ্মীপুর ও চট্টগ্রামের সন্দীপ উপকূলে।
এ মহাপ্রলয়ের সেদিনটিকেই উপকূল দিবস হিসেবে পেতে চায় বাংলাদেশের উপকূলীয় ৭১০ কিলোমিটার তটরেখার মানুষ। এতো শত দিবসের ভিড়ে এ একটি দিবসের বিশেষ যৌক্তিকতা আছে বলেও মনে করেন উপকূলের মানুষ।
তারা মনে করছে একটি ঘোষিত দিবস কোনো সুনির্দিষ্ট বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে পারে, দিবস অধিকার আদায়ের কথা বলতে পারে, দিবস পারে জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর জোরালো করতে। প্রতিবছর একটি সুনির্দিষ্ট দিনে উপকূল দিবস পালিত হলে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে সচেতনতা বাড়বে। তথ্য আদান-প্রদান, তথ্য অধিকারের বিষয়গুলো নিশ্চিত হবে। কেন্দ্রের কাছে পৌঁছাবে উপকূলের সুখ-দুঃখের কথা।
উপকূলের প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ প্রতিনিয়ত দুর্যোগের সঙ্গে বাস করেন। উপকূলের নীতিনির্ধারকদের নজর বাড়িয়ে উপকূলবাসীর জীবনমান উন্নয়ন ঘটানোই উপকূলের জন্য একটি দিবস প্রস্তাবের মূল লক্ষ্য। উপকূলের প্রান্তিকের তথ্য যেমন কেন্দ্রে পৌঁছায় না, ঠিক তেমনি কেন্দ্র মাঠে পৌঁছাচ্ছে না নানাবিদ কারণে। তাই ৭০’র মহাপ্রলয় স্মরণে উপকূলের মানুষ চায় ১২ নভেম্বর দিনটিকে উপকূল দিবস ঘোষণা করা হোক।
১৯৭০ সালের মহাপ্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের কথা স্মরণ করে তৎকালীণ নোয়াখালী অঞ্চলের রেডক্রসের প্রধান ও নোয়াখালী দ্বীপ উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক মো. রফিকুল আলম বলেন, সেদিন ছিলো চারিদিকে মরদেহ আর মরদেহ, বাতাসেও ভেসেছিলো পঁচা মরদেহের গন্ধ। যেভাবে গণহারে মরেছিলো মানুষ, ঠিক তেমনিভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়েছিলো উপকূলের জীব বৈচিত্র।
তিনি বাংলানিউজকে জানান, সেদিন হাতিয়া, চর আবদুল্লাহ, রামগতি, সন্দীপ, ঢালচর, চর জব্বার, তজুমুদ্দিন, চর কচ্ছপিয়া, চর পাতিলা, কুকরী কুমড়ী, মনপুরা, চরফ্যাশন, ভোলা, দৌলতখান, বরগুনা, পটুয়াখালী, চট্টগ্রাম ও ফেনীর সোনাগাজীসহ পুরো উপকূলে প্রায় ১০ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলো। ওইদিনের ঘূর্ণিঝড়ে নোয়াখালীর বিভিন্ন এলাকায় প্রাণ হারিয়েছিলো প্রায় ১০ হাজার লোক, নিখোঁজ ছিলো আরো ২০ হাজারের মতো। জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গিয়েছিলো লাখ লাখ গরু, ছাগল, মহিষ ও কোটি কোটি টাকার ফসল।
দিনটির কথা স্মরণ করে নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মাহবুব মোর্শেদ বাংলানিউজকে জানান, এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে সেদিনের ভয়াবহতার চিত্র। ওই একদিনের দুর্যোগেই প্রাণ হারায় নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার জনসংখ্যার চার ভাগের একভাগ। এর মধ্যে নিঝুম দ্বীপের সব মানুষকেই ভাসিয়ে নিয়ে যায় জলোচ্ছ্বাস। শুধু বেঁচে ছিলেন কেরফা বুড়ি।
কথা হয় চট্টগ্রামের সদ্বীপ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এবিএম সিদ্দিকুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ৭০ সালের ১১ নভেম্বর (বুধবার) থেকেই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হতে থাকে। পরদিন ১২ নভেম্বর (বৃহস্পতিবার) আবহাওয়া আরো খারাপ হতে থাকে এবং মধ্যরাত থেকেই ফুঁসে উঠতে থাকে সমুদ্র। তীব্র বেগে লোকালয়ের দিকে ধেয়ে এলো পাহাড়সমান উঁচু ঢেউ। পুরো সন্দ্বীপ তছনছ হয়ে যায়। বাড়িঘর হারা হয় হাজারো পরিবার।
১২ নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়ের ব্যাপারে কথা হয় ফেনীর সোনাগাজী উপকূলীয় অঞ্চলের জেলে পাড়ার বাসিন্দা প্রবীর কুমারের সঙ্গে। তিনি বলেন, সেদিন নদীতে দেখা গেছে হাজার হাজার মরদেহ। মানুষের মরদেহ পচে নদীর পানিও খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। গরু, ভেড়া ও মহিষের মরদেহও ছিলো অগণিত।
উপকূলের বিভিন্ন এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরকারি হিসাবে প্রায় পাঁচ লাখ এবং বেসরকারি হিসাবে প্রায় ১০ লাখ মানুষ স্রোতের টানে নদী-সমুদ্রগর্ভে, তীরে-ঢালে, ডালে-জলে-ঝোপে, চরে প্রাণ হারায়। সেই স্মৃতি বয়ে আজও যারা বেঁচে রয়েছেন কিংবা স্বজনদের হারিয়েছেন, কেবল তারাই অনুভব করেন সেদিনের ভয়াবহতা।
নোয়াখালী দ্বীপ উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক মো. রফিকুল আলম এ ধরনের দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে ১২ নভেম্বরকে উপকূল দিবস দাবি করে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করেন। তা হলো- দ্রুত তথ্য পৌঁছানো, উপকূলের মানুষদের সিগনাল দিতে আরো আপডেট হতে হবে, শুধু সমুদ্র বন্দর নয়, প্রতিটি উপকূলীয় এলাকায় কখন কি অবস্থা তা মানুষকে জানাতে হবে। বছরের অক্টোবর-নভেম্বরে উপকূলীয় এলাকায় দক্ষ প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবকদের আধুনিক যন্ত্রপাতি নিয়ে তৈরি থাকতে হবে। কারণ এ সময়টাতে আঘাত হানে প্রকৃতি।
তিনি আরো বলেন, প্রতিটি উপকূলীয় এলাকায় রেডিও থাকতে হবে। তিনি জানান, ৭০ এর মতো যদি আরেকটি ঘূর্ণিঝড় হয় তাহলে বাংলাদেশের প্রতিটি উপকূলীয় এলাকা লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে। এ থেকে রক্ষা পেতে হলে বেড়িবাঁধ এবং আউটার বেড়িবাঁধগুলো আরো মজবুত করে তৈরি করতে হবে। তাহলে হয়তো উপকূলের মানুষ রেহায় পাবে।
উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ওইসব এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় উপকূলীয় জনপদের উন্নয়ন, সংকটের উত্তরণ, সম্ভাবনা বিকাশসহ উপকূলের অন্ধকারকে প্রকাশের আলোয় আনতে ‘উপকূল দিবস’ প্রবর্তন এখন সময়ের দাবি।
উপকূলবাসীর দিকে বছরে অন্তত একটি দিন বিশেষভাবে নজর ফেলার জন্য, উপকূলের সংকট-সম্ভাবনার কথা বছরে অন্তত একটিবার সবাই মিলে বলার জন্য একটি বিশেষ দিন চাই। যেদিন সবাই মিলে একযোগে উপকূলের কথা বলবে।
উপকূলবাসীর জন্য সবচেয়ে শোকের দিন হিসাবে পরিচিত ১২ নভেম্বরই হতে পারে ‘উপকূল দিবস’। শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, গোটা বিশ্বের জন্যই এ দিনটি ‘ওয়ার্ল্ড কোস্টাল ডে’ হওয়া উচিত। এ দিবসটি উপকূল সুরক্ষার কথা বলবে, উপকূলের সংকট-সম্ভাবনার কথা বলবে, উপকূলকে এগিয়ে নেওয়ার কথা বলবে। যে দিবস উপকূলবাসীর কণ্ঠস্বরে ধ্বনিত হবে। আর এভাবেই উপকূল এগিয়ে যাবে।
বাংলাদেশ সময়: ০২২০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১১, ২০১৮
এসএইচডি/আরবি