ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

‘আঁরারে বিড়া-বাড়ি দিলে আঁরা আজিয়াই যাইয়ুম গই’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২০৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২০, ২০১৮
‘আঁরারে বিড়া-বাড়ি দিলে আঁরা আজিয়াই যাইয়ুম গই’ উখিয়ার উপজেলার জামতলী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ‘এফ’ ব্লকের আলী হোসেন। ছবি: বাংলানিউজ

কক্সবাজার: ‘আঁরারে আজিয়া রোহিঙ্গা (ন্যাশনালিটি) ও বিড়া-বাড়ি দিলে আঁরা আজিয়াই যাইয়ুম গই। গারিও দেওয়া ন ফরিব, আঁরা বেগগুন আঁড়ি আঁড়ি হ্যাড়ে (বার্মা) পারাই যাইয়ুম গই। ইতারা চাদ্দে আঁরারে হ্যাড়ে লই যাই ক্যাম্পত বান্দি রাখি আবার নির্যাতন গরিবাল্লাই। আঁরা হ্যাড়ে ন যাইয়ুম।’

(আমাদের আজকে নাগরিকত্ব ও ভিটে-বাড়ি ফেরত দিলে আমরা আজই বার্মা চলে যাবো। গাড়িও দিতে হবে না।

আমরা সবাই হেঁটে হেঁটে চলে যাবো। কিন্তু  তারা চাইছে আমাদের সেখানে নিয়ে ক্যাম্পে আটকে রেখে আবার নির্যাতন চালাবে। আমরা সেখানে (বার্মা) যাবো না। )

এভাবেই মিয়ানমার সরকারের ওপর আস্থাহীনতার কথা জানালেন ভিটে-মাটি হারিয়ে রাখাইন থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া আলী হোসেন (৪৭) নামের এক রোহিঙ্গা নাগরিক।  

এ কথা কক্সবাজার জেলার উখিয়ার উপজেলার জামতলী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ‘এফ’ ব্লকের আলী হোসেনের-ই নয়, তার মতো এই ক্যাম্পসহ অন্যান্য জায়গায় বসবাসকারী রোহিঙ্গা নারী-পুরুষেরও।  

ভুক্তভোগী রোহিঙ্গারা বলছেন, আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মিয়ানমার তাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হয়েছে ঠিক-ই, কিন্তু এটা শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দেখানোর জন্য। এটা তাদের আসল সিদ্ধান্ত নয়। নিয়ে গিয়ে তাদের অধিকার ফিরিয়ে দেবে না। নাগরিকত্ব দেবেনা, ভিটে-বাড়ি ফেরত দেবে না। তাই দেশটি এখনও তাদের জন্য নিরাপদ নয়। যে নিজ দেশে ফেরত যেতে পারছেন না তারা।  

সৈয়দ আলমের বাড়ি রাখাইনের কুইলাগং এলাকায়। তিনিও অন্যদের মতো ভিটে-বাড়ি হারিয়ে ছেলে-মেয়ে নিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন।  

তিনি বলেন, নাগরিকত্ব আর ভিটে-বাড়ি ফেরত অবশ্যই ফিরে যাবো। আমরা দাবি-দাওয়া দিয়েছি, ইউএন-এর কাছে বিচার দিয়েছি, এখনও বিচার পাইনি, তাই যাচ্ছি না।  

ক্যাম্পের জীবন কেমন? এমন প্রশ্নে সৈয়দ বলেন, ক্যাম্পে জীবন-যাপন ভালো না। কারণ এটি আমাদের দেশ নয়। বিচার পাওয়া পর্যন্ত আমরা এখানে থাকবো। বিচার হয়ে গেলে আমরা চলে যাবো।

নির্যাতনের ঘটনা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, বার্মার সরকার আমাদের বেশি নির্যাতন করে, এমবিসি কার্ড নিতে বলে, না নিলে যুবকদের ধরে নিয়ে যায়, আমার বাবাকেও ধরে নিয়ে গেছে। আমার বাবার বয়স ৮৮ বছর। গ্রামে ঢুকে পাড়ার অন্যান্য যুবকদের সঙ্গে বার্মার সেনাবাহিনী আমার বাবাকেও নিয়ে গেছে।  

‘পরে বাবার বয়স ৪০ বছর দেখিয়ে ২৫ বছর জেল দিয়েছে। সে রকম খারাপ বার্মার সরকার। সে কারণে ভয়ে আমরা সেখানে যাচ্ছি না। তাদের দেখলে আমাদের ভয়ে কাঁপুনি শুরু হয়। আমাদের সেখানে নিয়ে গিয়ে হয়তো সারাজীবনের জন্য জেলে দিবে নয়তো সবাইকে মেরে ফেলবে, সেই ভয়ে যাচ্ছি না। ’

প্রায় একই কথা কুতুপালং ক্যাম্পের সফিনা বেগমেরও। তিনি বলেন, রাখাইনে আমাদের গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে, বাড়ি ঘর নেই, পাড়া নেই সেখানে গিয়ে আমরা কোথায় থাকবো। ক্যাম্পে ঢুকিয়ে আমাদের আটকিয়ে পেটানোর ফন্দি করছে বার্মা। আন্তজার্তিক বিশ্ব থেকে বাঁচার জন্য, তাদের দেখানোর জন্য এটা বার্মার ছলছাতুরি। তারা আমাদের কখনই মেনে নিবে না, কখনই নাগরিকত্ব দেবে না।

তিনি বলেন, এর চেয়ে ত্রিপললের ঘরে এখানে আমরা বার্মার চেয়ে ভাল আছি। বাংলাদেশের মানুষ আমাদের আশ্রয় দিয়েছে। শেখ হাসিনা আমাদের মা । আমাদের খাবার-দাবার সবকিছু দিচ্ছে।  

রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা মিয়ানমারে ফেরত যেতে ৭ দফা দাবি জানালেও মূলত নাগরিকত্ব ও তাদের বাপ-দাদার ভিটে বাড়ি ফেরত পেলেই চলে যাবেন জন্মভূমিতে।  

যোগাযোগ করা হলে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সর্ম্পকিত টেকনিক্যাল কমিটির প্রধান মোহাম্মদ আবুল কালাম বলেন, নির্বাচনের আগে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত আসছে না। পূর্ববতী সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আমাদের চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। রোহিঙ্গারা রাজি হলেই আমরা তাদের মিয়ানমারে পাঠানোর ব্যবস্থা করবো।

বাংলানিউজকে তিনি বলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন করে সিদ্ধান্ত যেহেতু হয়নি সুতরাং আমরা আগের সিদ্ধান্তেই এখনও আছি। মাঠ পর্যায়ে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। রোহিঙ্গারা রাজি হতেও পারে, রাজি হলেই আমরা পাঠাবো।  

গত বছরের ২৫ আগস্টের পর রাখাইনে একটি তল্লাশি চৌকিতে হামলা চালানোকে কেন্দ্র করে রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা চালানো হয়। এরপরে থেকেই বাংলাদেশমুখী রোহিঙ্গাদের ঢল নামে। এ পর্যন্ত প্রায় ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছেন বলে বিভিন্ন সংস্থার হিসেবে বলা হচ্ছে।  

বাংলাদেশে আশ্রিতরা বলছেন, রাখাইনে নিজ ভিটে-বাড়ি থেকে উচ্ছেদের পাশাপাশি ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও নির্যাতনে মিয়ানমার সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে যোগ গিয়েছে স্থানীয় মগরা।  

পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের নিজ বাসভূমে ফেরাতে আন্তর্জাতিকভাবে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাতে থাকে বাংলাদেশ। এরই পরিপ্রেক্ষিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হয়।  

তবে এ বিষয়ে কোনো উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ নিচ্ছে না মিয়ানমার।  

বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২০, ২০১৮
এমএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।