ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

৮ ডিসেম্বর চাঁদপুর মুক্ত দিবস

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪২০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৮, ২০১৮
৮ ডিসেম্বর চাঁদপুর মুক্ত দিবস ৮ ডিসেম্বর চাঁদপুর মুক্ত দিবস।

চাঁদপুর: ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর চাঁদপুর পাক হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্তি পেয়েছিল। চাঁদপুর থানার সামনে এদিন বিএলএফ বাহিনীর প্রধান মরহুম রবিউল আউয়াল কিরণ প্রথম চাঁদপুরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন।

১৯৭১ সালের ৭ এপ্রিল চাঁদপুরে পাক হানাদার বাহিনী দু’টি বিমান থেকে সেলিংয়ের মাধ্যমে প্রথম আক্রমণের সূচনা করে। প্রথম দিনেই হামলায় চাঁদপুর শহরের পুরান বাজারের এক নারী পথচারী নিহত হন।

পর দিন বিকেলে প্রায় ৫শ পাকসেনার একটি বহর চাঁদপুর আসে।

শহর থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে চাঁদপুর কারিগরি উচ্চ বিদ্যালয়টি অস্থায়ী ক্যাম্প তৈরি করে তারা। এ স্কুলের মাঠ থেকে প্রতিদিনের মতো লতুফা বেগম নামে এক বৃদ্ধা গরু-ছাগল বাড়ি নিয়ে যাওয়ার সময় পাক বাহিনীর সদস্যরা রাতের খাবার জোগাড় করার জন্যে প্রথম অপারেশন হিসেবে ওই বৃদ্ধাকে গুলি করে হত্যা করে এবং বৃদ্ধার একটি গরু ও একটি ছাগল নিয়ে যায়। আর পাক সেনাদের অফিসারদের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের রেস্ট হাউজটি নির্ধারণ করা হয়েছিলো।

নিহত লতুফা বেগমের নাতি মো. সিরাজ মৃধা বাংলানিউজকে জানান, তার দাদিকে প্রকাশ্যে হত্যা করে হানাদার বাহিনী গরু-ছাগল নিয়ে যায়। সে দূর থেকে দেখলেও কিছুই করতে পারেনি। ওই ক্ষোভ এখনো তার মনে রয়েছে।

কারিগরি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠের বর্বরতম হত্যার প্রত্যক্ষদর্শী তরপুরুচন্ডী গ্রামের বাসিন্দা মো. নান্নু মিজি বাংলানিউজকে জানান, তিনি এবং তার বড় ভাইকে সন্ধ্যার দিকে এনে কবর খুঁড়ার জন্য নির্দেশ দেয়। তখন তারা বাড়িতে যাবে বলে জানালে তাদেরকে বেধম পিটিয়ে আহত করে। পরে জোর করে তাদের দিয়ে তিনটি কবর খুঁড়ে। ওই কবরই মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত তিনজন পাক সেনা সদস্যকে কবর দেওয়া হয়।

৮ এপ্রিল রাতেই চাঁদপুরে অবস্থানরত ২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা বিচ্ছিন্নভাবে হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে হামলা চালান। হামলা দেখে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীরা এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। তখন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা মারাত্মক আহত হন। ৯ এপ্রিল ভোরে পাকিস্তানি মিলিটারি শহরে ঢুকে চাঁদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ইসমাইল হোসেন ভলন্টিয়ার (৫৫) নামে এক ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করে। একই সঙ্গে তারা শহরের হাসান আলী হাই স্কুলের মোড়ে আপাক ও মাখন নামে দুই যুবককে সাইকেলে চালাতে দেখে গুলি করে হত্যা করে।

এরপরেই তারা শুরু করে তাদের মূল অপারেশন কার্যক্রম। এজন্য চাঁদপুর বড় স্টেশন মোলহেড এলাকায় হানাদার বাহিনীর একটি টর্চার সেল গঠন করে। এখানে চাঁদপুর রেলপথ, সড়কপথ এবং নৌ-পথে যে সব যাত্রীদের সন্দেহ হয়েছে, সেসব নারী-পুরুষকে এনে অমানবিক নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ করেছে। পরে ওই মরদেহগুলো মেঘনা এবং পদ্মা নদীতে ফেলে দিয়ে। যার সাক্ষী আজও পদ্মা-মেঘনা নদী বহন করছে।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষার্থে চাঁদপুর পৌরসভা ও জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ২০১৩ সালে বড় স্টেশনে ‘রক্তধারা’ নামে বদ্ধভূমি নির্মাণ করা হয়। এরআগে চাঁদপুরের প্রথম শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সুশীল, সংকর ও খালেকের নামে ট্রাক রোডে নির্মাণ করা হয় ‘মুক্তিসৌধ’ এবং চাঁদপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রে লেকের ওপর দৃশ্যত ভাসমান মুক্তিস্মৃতি সৌধ ‘অঙ্গীকার’ নির্মাণ করা হয়।

চাঁদপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সম্মুখে এ জেলায় স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের নামের তালিকা সম্বলিত একটি স্মৃতি ফলক নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়াও চাঁদপুর পৌরসভার ৫ রাস্তার মোড়ে পৌরসভার অর্থায়নে নির্মাণ করা হয় ‘শপথ চত্বর’।

এপ্রিল থেকে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের চলে দফায় দফায় গোলাগুলি। পরে গঠন করা হয় শান্তিবাহিনী। তারপর নতুন কায়দায় শান্তিবাহিনী ও পাকবাহিনী বিভিন্ন জায়গায় চালাতে থাকে বর্বর অত্যাচার ও হত্যাযজ্ঞ। ৩৬ ঘণ্টা যুদ্ধের পর পালিয়ে যায় তারা।

এভাবে ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানের দোসররা কত লোককে হত্যা করেছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। চাঁদপুর জেলায় (তৎকালীন মহকুমা) সর্বশেষ যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল ৭ ডিসেম্বর লাকসাম ও মুদাফ্ফরগঞ্জ মুক্ত হওয়ার পর। যৌথ বাহিনী হাজীগঞ্জ দিয়ে ৬ ডিসেম্বর চাঁদপুর আসতে থাকলে মুক্তিসেনারা হানাদার বাহিনী প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়।

ভারতীয় গার্ডস রেজিমেন্টের নেতৃত্বে ৩১১তম মাউন্টেন ব্রিগেড ও ইস্টার্ন সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের যৌথ আক্রমণ চালায়। দিশে না পেয়ে পাকিস্তান ৩৯ অস্থায়ী ডিভিশনের কমান্ডিং অফিসার মেজর জেনারেল রহিম খানের নেতৃত্বে দু’টি জাহাজে করে নৌ-পথে ঢাকার উদ্দেশ্যে চাঁদপুর থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর ট্যাংক ও বিমান আক্রমণে চির কবর রচনা হয় নাদীতে।

১৯৯২ সাল থেকে সার্বজনীনভাবে চাঁদপুরে অঙ্গীকারের পাদদেশে মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এবারও ১ ডিসেম্বর থেকে বিজয় মেলা-২০১৮ হাসান আলী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে শুরু হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ০৯১৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৮, ২০১৮
জিপি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।