ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

সুদের বেড়াজালে আশাশুনির ধান্যহাটি গ্রামের মানুষ

শেখ তানজির আহমেদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১১৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০১৯
সুদের বেড়াজালে আশাশুনির ধান্যহাটি গ্রামের মানুষ

সাতক্ষীরা: লাখ টাকায় দৈনিক সুদ এক হাজার টাকা। জরুরি প্রয়োজনে এই শর্তে টাকা নিয়ে দেনার জালে জড়িয়ে পড়েছেন আশাশুনির লতিকা সরকার। মহাজনের দাবি, তার কাছে এখনও পাওনা সাত লাখ ৪০ হাজার টাকা। 

একইভাবে ঋণ নিয়েছিলেন স্কুল শিক্ষক তাপস চক্রবর্তী। ঋণ শোধের পরও মহাজন তার ঘাড়ে চাপিয়েছেন ২৪ লাখ টাকার দেনা।

 

আশাশুনি উপজেলার সদর ইউনিয়নের ধান্যহাটি গ্রামের প্রায় ২০টি পরিবার এ ধরনের ঋণের জালে আটকা পড়েছেন। তাদের মহাজন নাজমা বেগম ও তার স্বামী আব্দুর রশিদের দাপটের মুখে ছেলে-মেয়েদের স্কুল-কলেজে পাঠাতে পারছেন না ঋণগ্রস্তরা। তাদের জমি লিখে নিয়েছে, মাছের ঘেরও লুট করেছে। আর এখন আইনি নোটিশ দিয়ে ঋণ গ্রহীতাদের পিছু নিয়েছে নাজমা-রশিদ দম্পতি।  

রোববার (১৩ জানুয়ারি) সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে আশাশুনির ধান্যহাটি গ্রামের বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষ ঋণগ্রহীতা এসে এসব অভিযোগ করেন।

ওই গ্রামের কুন্দুড়িয়া হাইস্কুলের শিক্ষক তাপস চক্রবর্তী বলেন, আমার কিডনি জটিলতা এবং মেয়ের অসুস্থতার কারণে গ্রাম্য মহাজন নাজমা বেগমের কাছ থেকে শতকরা মাসিক ১০ টাকা সুদে সাড়ে চার লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলাম ২০১০ সালে। পর্যায়ক্রমে সেই টাকার জন্য শোধ করেছি সাত লাখ ৬০ হাজার টাকা।  

তিনি বলেন, প্রতি লাখে একটি করে ব্লাংক চেক এবং নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করে দেওয়া ছিল মহাজনের কাছে। মহাজন নাজমা বেগম এখন এই খালি চেকে ২৪ লাখ টাকা বসিয়ে আমার ওপর চাপ দিচ্ছেন, এমনকি লিগ্যাল নোটিশও পাঠিয়েছেন।  

ওই গ্রামের বাবু লাল অধিকারীর স্ত্রী লতিকা অধিকারী জানান, দু’টি স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করে এক লাখ ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন নাজমা বেগমের কাছ থেকে। এর বিপরীতে কয়েক বছরে তিনি সাড়ে ছয় লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন। এখন নাজমা বেগমের দাবি, তাকে আরও সাত লাখ ৪০ হাজার টাকা দিতে হবে। এ নিয়ে অশান্তির জেরে লতিকা বিষ পান করে আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছেন কিছুদিন আগে।  
 
তিনি জানান, তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছেন নাজমা। রোজই তার বাড়িতে গিয়ে টাকার জন্য তাগাদা দিচ্ছেন। হুমকির মুখে তার এসএসসি পরীক্ষার্থী মেয়ে স্কুলে যেতে পারছে না। এমনকি ২ ফ্রেব্রুয়ারি অনুষ্ঠেয় পরীক্ষায়ও সে যাতে যেতে না পারে সে ব্যবস্থা করার হুমকিও দিয়েছেন নাজমা ও তার স্বামী।  

এদিকে, একই গ্রামের তারক সরকারের স্ত্রী যমুনা সরকার জানান, তার দুই ছেলে আশুতোষ ও শুকলাল সরকার ৬৫ হাজার টাকার ঋণ নিয়েছিলেন একটি নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প মূলে। এই টাকার বিপরীতে তিনি দফায় দফায় আড়াই লাখ ও দেড় লাখসহ চার লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন। এছাড়াও ভয়ভীতি দেখিয়ে তার কাছ থেকে ১১ শতক জমি সাফ কবলা মূলে দলিল করে নিয়েছেন মহাজন নাজমা।
 
এখন নাজমা ওই দলিল ফেরত দিচ্ছেন না, উল্টো আরও দাবি করছেন সাত লাখ ৪০ হাজার টাকা। এরই মধ্যে নাজমা ও তার স্বামী যমুনাদের আড়াই বিঘা জমির মাছ লুট করে নিয়েছেন।  

আশাশুনির বড়দল আফতাব উদ্দিন কলেজিয়েট স্কুলের প্রভাষক দেবদত্ত চক্রবর্তী জানান, তিনি তিনটি খালি চেক এবং ৫০০ টাকার স্বাক্ষরিত সাদা স্ট্যাম্পের বিনিময়ে দেড় লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন। এ যাবত তিনি দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা পরিশোধ করেছেন। তা সত্ত্বেও এখনও তার কাছে পাঁচ লাখ ৪০ হাজার টাকা দাবি করে নাজমা খাতুন তাকে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন।  

একইভাবে ঋণের জালে আটকা পড়েছেন ওই এলাকার প্রেম সরকার, সুকুমার সোম, নেপাল সরকার, সনদ অধিকারী, গোবিন্দ সরকার, চাম্পাফুলের অনয় সরকারসহ অনেকেই।  

অভিযোগ করে তারা বলেন, আমরা ঋণের টাকারও অনেক বেশি সুদসহ দেনা পরিশোধ করেছি। তারপরও আমাদের ওপর ‘মহাজনী স্টিম রোলার’ চালাচ্ছেন নাজমা ও তার স্বামী আব্দুর রশিদ। তাদের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার শর্ত হলো- বেলা ডোবার আগেই সুদের টাকা পরিশোধ করতে হবে। এখন বাড়ি-ঘর ছেড়ে আমরা নাজমার হাত থেকে বাঁচার জন্য পালিয়ে বেড়াচ্ছি।  

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মান্নান বাংলানিউজকে জানান, নিরীহ ও দরিদ্র এসব পরিবারের ওপর নাজমা ও রশিদ দম্পতির মহাজনী নির্যাতন চরমে উঠেছে। মহাজনরা তাদের গরু-ছাগল ধরে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দিচ্ছেন।  

আশাশুনি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বিপ্লব কুমার নাথ বাংলানিউজকে বলেন, নাজমার মহাজনী দাপট চরমে ওঠায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে নিয়ে আমি বৈঠক করেছি। উভয়পক্ষকে কিছুটা শর্ত দিয়ে বিষয়টি নিষ্পত্তি করার পরামর্শ দিয়েছি। এ ঘটনার পর থেকে নাজমা বেগম পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। আমরা তাকে খুঁজে পাচ্ছি না।  

তিনি আরও বলেন, ঋণগ্রস্তদের পরিবারের জানমালের ক্ষয়ক্ষতির চেষ্টা করলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।  

তবে, এ ব্যাপারে নাজমা-রশিদ দম্পতির সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।  

বাংলাদেশ সময়: ১৬০৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০১৯
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।