ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১০ অক্টোবর ২০২৪, ০৬ রবিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

বাড়িভাড়া ফাঁকি, টাকা আত্মসাতের অভিযোগ পাবিপ্রবি ভিসির বিরুদ্ধে

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১১৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৮, ২০২০
বাড়িভাড়া ফাঁকি, টাকা আত্মসাতের অভিযোগ পাবিপ্রবি ভিসির বিরুদ্ধে উপচার্যের জন্য নির্ধারিত সুরম্য এই বাড়িটিকেই গেস্ট হাউজ ঘোষণা করেছেন উপাচার্য ড. এম রোস্তম আলী

পাবনা: নানা অনিয়ম আর দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এম রোস্তম আলীর বিরুদ্ধে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া উপাচার্যের বেতন বিলেও বাড়ি ভাড়া না দেওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

ভিসির এমন হাজারো অনিয়ম আর ক্ষমতার অপব্যবহার বিষয় নিয়ে বিব্রত বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

এমন অনিয়মকে ক্ষমতার অপব্যবহার বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সম্প্রতি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক ভিসির নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলে এককভাবে ক্যাম্পাসে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। এছাড়াও এই অনিয়মের অভিযোগের আলোকে অনুসন্ধান কাজ শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

ইউজিসি ও পাবিপ্রবির সূত্র জানায়, উপাচার্যের নিয়োগ পত্রের নীতিমালায় রয়েছে, উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে সার্বক্ষণিক ক্যাম্পাসে অবস্থান করবেন। সে লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম প্রজেক্টেই পাবিপ্রবি ক্যাম্পাসে প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যায়ে উপাচার্যের থাকার জন্য আধুনিক বাসভবন নির্মাণ করা হয়। বাসভবনটি মেরামতের জন্য প্রতি বছর ইউজিসি থেকে অর্থও বরাদ্দ দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরের মূল বাজেটে ৩০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে উপাচার্যের বেতনের ৪৫ শতাংশ বাড়ি ভাড়া হিসেবে কর্তনের সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয় ইউজিসি। তবে উপাচার্য তার তোয়াক্কা না করে দৈনিক ১২৯ টাকা হারে ভাড়ায় এই বাসভবনে থাকছেন। রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ার সুস্পষ্ট শর্ত সার্বক্ষণিক ক্যাম্পাসের অবস্থানের বিষয়টিও আমান্য করে প্রায়ই তিনি রাজশাহীতে নিজ বাড়িতে অবস্থান করেন বলে জানা যায়।

বর্তমানে পাবিপ্রবির ক্যাম্পাসে উপাচার্যের বাসভবনে ভিসির নিরাপত্তার দায়িত্বে আছেন ৯ জন আনসার সদস্য। এছাড়াও উপাচার্যের পিয়ন, আর্দালি, মালি, বাবুর্চিসহ ব্যক্তিগত কর্মচারী হিসেবে কাজ করছেন ১৫ জন কর্মচারী। তারা উপাচার্যের বাসভবনের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত। বিশ্ববিদ্যালয় তহবিল প্রতিমাসে তাদের বেতন ভাতা বাবদ ব্যয় হয় লক্ষাধিক টাকা। এই ভিসি তার বাসভবনকে গেস্ট হাউস হিসেবে ঘোষণা করলেও বাসভবনের জন্য বরাদ্দ সকল সুবিধাই গ্রহণ করছেন তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, এই বাসভবনটিকে গেস্ট হাউজ বলা হলেও এখানে তার মনোনীত, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক রঞ্জিত কুমার ও পাবিপ্রবির কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. আনোয়ার পারভেজ খসরু ব্যতীত কোনো গেস্টই সেখানে থাকেন না।  

সম্প্রতি, উপাচার্যের একটি বেতন বিলে দেখা যায়, তিনি বাড়ি ভাড়া বাবদ বেতন থেকে উত্তোলন করেছেন ৩১,২০০ টাকা। ইউজিসির নির্দেশনা অমান্য করে তিনি গেস্ট হাউজের ওই মাসে ভাড়া হিসেবে কর্তন করেছেন ৩ হাজার ৮৭৫ টাকা। এতে তিনি প্রতি মাসে অর্থ ফাঁকি দিয়েছেন ২৭ হাজার ৩২৫ টাকা। এই হিসেবে ভিসি তার মেয়াদকালে গত পৌনে তিন বছরে বিশ্ববিদ্যালয় তথা সরকারকে অর্থ ফাঁকি দিয়েছেন ৯ লাখ ১ হাজার ৭২৫ টাকা।
 
এদিকে, পাবিপ্রবি উপাচার্যের জন্য বরাদ্দ বাড়িটি গেস্ট হাউজ ঘোষণা করার এখতিয়ার ভিসি রোস্তম আলীর নেই বলে জানিয়েছেন ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান। তিনি বলেন, নিজের মতো করে নীতিমালা বানিয়ে বাড়ি ভাড়া কর্তন না করা আইন সিদ্ধ নয় এবং তা নিয়ম বহির্ভূত। কোনো অবস্থাতেই ভিসির বাংলো গেস্ট হাউস ঘোষণা করে বসবাস করার সুযোগ নেই। কারণ এতে বিশ্ববিদ্যালয় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এমন সমালোচিত কাণ্ডকে লজ্জাজনক অভিহিত করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও।

পাবিপ্রবির সহযোগী অধ্যাপক ড. এম আব্দুল আলীম বলেন, ভিসি স্যারের বাসভবন গেস্ট হাউস দেখিয়ে বিধি মোতাবেক ভাড়া না কাটলেও তার রাজশাহীর বাড়ির বুয়ার বেতন থেকে শুরু করে সমুদয় খরচ তিনি বিশ্ববিদ্যালয় তহবিল থেকে নেন। এই দুই বাড়ির জন্য উপাচার্য মহোদয় বিশ্ববিদ্যালয়ের যতো কর্মচারী খাটান এবং যতো অর্থ ব্যয় করেন তা বহন করা একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে সম্ভব কিনা সেটি খতিয়ে দেখার সময় এসেছে। তার সমালোচনা আর অনিয়ন নিয়ে কথা বলতে গেলে তিনি সেটি ভালোভাবে নেন না। বিষয়টি পাবনাবাসী তথা বিশ্ববিদ্যালয়ে সব শিক্ষকরে জন্য অপমানজনক।

গেস্ট হাউজ ঘোষণা করা ভিসির বাসভবনে বসবাসকারী পাবিপ্রবি কোষাধ্যক্ষ ড. আনোয়ার  পারভেজ খসরুর কাছে সেখানে থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার কোনো আবাসন নেই। ভিসি স্যার তার বাংলোকে গেস্ট হাউজ করায়, সেখানে ভাড়া দিয়ে অবস্থান করি। অনিয়ম হয়েছে কিনা সেটা ভিসি স্যার ভালো বলতে পারবেন।

ভিসির বাংলোকে গেস্ট হাউজ ঘোষণার বিষয়ে পাবিপ্রবি উপাচার্য ড. এম রোস্তম  আলী বলেন, কোনো অনিয়ম হয়নি। উপাচার্যের জন্য বরাদ্দকৃত বাড়িটির কারিগরি ত্রুটি রয়েছে। এটা কোনো বাংলোই হয়নি। এটাকে পরিত্যাক্ত ফেলে না রেখে গেস্ট হাউজ করায় তাতে বিশ্ববিদ্যালয় কিছু অর্থ অন্তত পাচ্ছে। এখানে গার্ডরুম, ড্রাইভার রুম, কুকের রুমসহ অনেক কিছুই নেই। সংস্কার করে তা নির্মাণ করা সম্ভব নয়। ভিসির ভবন নতুন করে তৈরি করতে হবে।

রাজশাহীর তার ব্যক্তিগত পাবারিক বাস ভবনের খরচ নেওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগের ভিসিরা নিয়েছেন তাই আমিও নিই। অনিয়ম আর দুর্নীতি কি জিনিস আমি নিজেই জানি না। সবকিছু নিয়মের মধ্যে চলছে।

এদিকে, বাড়ি ভাড়া ফাঁকি, পরিবহনপুলে দুর্ণীতিসহ পাবিপ্রবি ভিসির বিভিন্ন  অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে তদন্ত নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।  

দুদক পাবনা আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি স্যারের বিরুদ্ধে আমাদেরে কাছে অভিযোগ এসেছে। অভিযোগের আলোকে ওই সব বিষয় অনুসন্ধান কাজ শুরু করা হয়েছে।

এদিকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ভিসির অনিয়ম সেচ্ছাচারিতা নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হওয়ার কারণে ক্যাম্পাসে সাংবাদিক প্রবেশে নিশেধাজ্ঞা জারি করেছেন ভিসি। করোনা পরিস্থিতির আগে ক্যাম্পাস খোলা থাকা অবস্থায় শিক্ষার্থীরা এই ভিসি অপসারণের দাবিতে আন্দোলন করে। এই ভিসির ব্যবহারের জন্য দামি একটি গাড়ি বর্তমানে রাজশাহীতে তার ছেলে ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহার করছে বলে জানা গেছে।  

পাবনাবাসীর কাঙ্ক্ষিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সব উন্নয়নে স্বচ্ছতাসহ জবাব দিহিতামূলক প্রশাসনিক সব কার্যক্রম ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেন সচেতন পাবনাবাসী।

বাংলাদেশ সময়: ২১০০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৮, ২০২০
এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।