ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১০ অক্টোবর ২০২৪, ০৬ রবিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

প্রযুক্তির অপব্যবহারে সিরাজগঞ্জে বাড়ছে কিশোর অপরাধ

স্বপন চন্দ্র দাস, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭২১ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০২০
প্রযুক্তির অপব্যবহারে সিরাজগঞ্জে বাড়ছে কিশোর অপরাধ

সিরাজগঞ্জ: সিরাজগঞ্জে এ পর্যন্ত কোনো কিশোর গ্যাংয়ের সন্ধান না পাওয়া গেলেও বিভিন্ন ধরনের অপরাধ প্রবণতা ছড়িয়ে পড়েছে শিশু-কিশোরদের মধ্যে। মাদক, জুয়া ও চুরি-ছিনতাই থেকে শুরু করে খুন-ধর্ষণের মতো অপরাধেও জড়িয়ে পড়ছে যমুনাপাড়ের শিশু-কিশোরেরা।

অবাধ প্রযুক্তির অপব্যহারেই কিশোর অপরাধ বাড়ছে বলে সচেতন মহল মনে করছে।  

জেলার ১১টি থানায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি বছরে বিভিন্ন অপরাধে মোট ৪৮টি মামলায় ৬১ জন শিশু-কিশোরকে আসামি করা হয়েছে। এসব মামলার বেশিরভাগই তুচ্ছ ঘটনায় সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়া।  

সংঘর্ষ ও মারামারির ঘটনায় ১০ মাসে সর্বোচ্চ ২৪টি মামলায় ৩৪ জন কিশোরকে আসামি করা হয়েছে। এসব মামলার অধিকাংশেরই অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা। ধর্ষণ, অপহরণ ও ধর্ষণচেষ্টার ঘটনায় দায়ের করা ১২ মামলায় আসামি রয়েছে ১৩ কিশোর। এর মধ্যে বেশিরভাগ মামলারই অভিযোগপত্র দাখিল হয়েছে। এছাড়াও মাদক, চুরি ও ছিনতাই সরকারি কাজে বাঁধাদানের অভিযোগেও একাধিক কিশোরের নামে মামলা রয়েছে।  

অপরদিকে সমাজসেবা অফিস সূত্র জানিয়েছে, দু’টি হত্যা মামলার আসামি হিসেবে দু’জন কিশোর বর্তমানে জেলহাজতে রয়েছে।  

অনুসন্ধানে জানা গেছে, জেলা শহরের যমুনার ক্রসবার বাঁধ এলাকায় হোসেনপুর, দত্তবাড়ী, গয়লা, একডালা ও রানীগ্রাম মহল্লায় মাঝে মধ্যেই তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে সংঘর্ষ বাধে। এসব সংঘর্ষে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রও ব্যবহার করা হয়। এতে ১৪-১৭ বছরের শিশু-কিশোররাই বেশি জড়িয়ে পড়ে। ফেসবুকে পোস্ট দেওয়া, মন্তব্য করা নিয়েও হামলা, দুই গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।  

শহর ও শহরতলীর গ্রামগুলোর অনেক শিশু-কিশোররা ইয়াবা-ফেন্সিডিল, ড্যান্ডির মতো মরণ নেশায় আসক্ত হচ্ছে। এসব মাদকের টাকা জোগাড় করতে তারা ছিনতাই ও চুরির মতো ঘটনাতেও জড়িয়ে পড়ছে তারা। সম্প্রতি সদর উপজেলায় মাদকের টাকা না দেওয়ায় নিজের নানিকে কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে এক কিশোরের বিরুদ্ধে।  

এদিকে করোনাকালে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় মোবাইল গেমস, ইউটিউবে, বিভিন্ন ধরনের ভিডিও দেখা, টিকটকসহ বিভিন্ন ধরনের ডিজিটাল বিনোদনের দিকে ঝুঁকছে শিশু-কিশোরেরা। অবাধ ইন্টারনেট ব্যবহারের কারণে ইউটিউবে নগ্ন ভিডিও দেখে কিশোর অবস্থাতেই যৌনতার দিকে আকর্ষিত হচ্ছে অনেকে। নিয়ন্ত্রণহীন প্রযুক্তির ব্যবহার ও অভিভাবকদের নজরদারির অভাবে কিশোর বয়সেই প্রেম ও দৈহিক সম্পর্ক গড়ার মতো ঘটনা অহরহই ঘটছে এ জেলাতে। প্রেমঘটিত কারণে অপহরণ, ধর্ষণ, যৌন হয়রানিসহ গুরুতর অপরাধেও সম্পৃক্ত হচ্ছে এ অঞ্চলের কিশোররা। অনেকে কিশোরই আবার কিশোরীদের সঙ্গে প্রেম করে তাদের নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। এসব ঘটনায় তার বিরুদ্ধে দায়ের হচ্ছে অপহরণ মামলা।  

সিরাজগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জেনারেল হাসপাতালের জুনিয়র কনসালট্যান্ট (শিশু) ডা. আমিনুল ইসলাম বলেন, অশ্লীল ভিডিও দেখে শিশুরা আকর্ষিত হয়। তারা প্রেম-ভালবাসা বা দৈহিক সম্পর্কের স্বাদ নিতে চায়। এ থেকে বন্ধু-বান্ধবী বা সমবয়সীদের সঙ্গে এসব সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করে। এ থেকেই অপরাধের সূত্রপাত হয়। মাদকও অপরাধে জড়ানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে।

সিরাজগঞ্জ সমাজসেবা অফিসের প্রবেশনাল অফিসার হাসান শরীফ বলেন, জেলার ছয়জন শিশু অপরাধী টঙ্গী শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে রয়েছে। এদের মধ্যে সবাই নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার আসামি। এছাড়া দু’জন হত্যা মামলার শিশু আসামি বর্তমানে জেলহাজতে রয়েছে।  

সিরাজগঞ্জ কোর্ট পরিদর্শক মোস্তফা কামাল বলেন, গত তিন মাসে মোট ১৩টি মামলায় ১৫ জন শিশু আসামি রয়েছে। এর মধ্যে দু’টি মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। বাকি ১১টি মামলার তদন্ত চলছে।  

জেলা শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা মোস্তফা কামাল বলেন, মোবাইল প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহারের কারণে মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটছে। যার ফলে মূল শিক্ষা থেকে পিছিয়ে পড়ছে, শিশুদের মধ্যে মূল্যবোধ বাড়ছে না। সোশ্যাল মিডিয়ায় যে ধরনের প্রোগ্রাম দেওয়া হয়, তা থেকে প্রভাবিত হয়ে শিশুরা অপরাধের দিকে ঝুঁকে পড়ে। সে ক্ষেত্রে শিশুদের শিক্ষার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক বিকাশের দিকে জোর দিতে হবে।  

পুলিশ সুপার মো. হাসিবুল আলম বলেন, পুলিশের সার্বক্ষণিক নজরদারির কারণে জেলায় কোনো কিশোর গ্যাং গড়ে ওঠেনি। একাধিক কিশোরের জটলা দেখলেই পুলিশ তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিচ্ছে। তবে এ জেলায় ধর্ষণ ও অপহরণজনিত অপরাধে শিশুরা জড়িয়ে পড়ছে। অবাধ মোবাইল ও ইন্টারনেটের অপব্যবহার, ইউটিউব, ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কুরুচিপূর্ণ ভিডিও দেখে যৌনতার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে কিশোররা। এতে করে প্রেম-ভালোবাসার পাশাপাশি দৈহিক সম্পর্কেও লিপ্ত হচ্ছে তারা।  

শিশুদের ইন্টারনেটের অপব্যবহার বন্ধ, অভিভাকদের সার্বক্ষণিক নজরদারি রাখতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে নোংরা নাটক ও সিনেমা আপলোড করা বন্ধ করতে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলেও মনে করেন তিনি।  

বাংলাদেশ সময়: ০৭১৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০২০
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।