ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

‘নিরাপত্তাহীনতায় মসজিদে নামাজটাও পড়তে পারতাম না’

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫২৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০২১
‘নিরাপত্তাহীনতায় মসজিদে নামাজটাও পড়তে পারতাম না’ শাওন ও তার পরিবার/ ছবি: জিএম মুজিবুর

ঢাকা: আমি যখন হিজরতে ছিলাম, তখন আমার ও পরিবারের উপর চরম দুর্ভোগ নেমে এসেছিল। নিজের কোনো সামাজিক, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবন ছিল না।

আমার স্ত্রী একজন চিকিৎসক। কিন্তু জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার কারণে তার (স্ত্রী) জীবনেও চরম গ্লানি নেমে আসে। আর আমার সন্তানের জীবনে নেমে আসে অন্ধকারের কালো ছায়া। পুরো সমাজ ব্যবস্থা থেকেই আমরা বিচ্ছিন্ন হয় গিয়েছিলাম। অনেক সময় নিরাপত্তাহীনতার কারণে মসজিদে গিয়ে ঠিকমতো নামাজটাও পড়তে পারতাম না।  

কথাগুলো বললেন, জঙ্গিবাদ থেকে বেরিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরা শাওন মুনতাহা ইবনে শওকত (৩৪)। শাওনের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে তার স্ত্রী ডা. নুসরাত আলী জুহি (২৯) জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু ভুল বুঝতে তারা।

শাওন সিলেটের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। ছাত্র থাকাকালীন অবস্থায় তিনি নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীরে যুক্ত হন। পরে তিনি হিযবুত তাহরীরের বিশ্ববিদ্যালয় শাখায় শীর্ষ পর্যায়ে চলে যান। এরপর ২০০৯ সালে আনসার আল ইসলামে যোগ দেন তিনি। ২০১১ সালে মেডিক্যাল শিক্ষার্থী ডা. নুসরাতকে বিয়ে করেন শাওন। পরবর্তীতে সংগঠনের নির্দেশনায় তিনি ঢাকায় চলে আসেন। ২০১৭ সাল থেকে তার স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে ঢাকায় বসবাস শুরু করেন।

বৃহস্পতিবার (১৪ জানুয়ারি) দুপুর ১২টার দিকে রাজধানীর কুর্মিটোলায় র‌্যাব সদর দফতরে আয়োজিত ‘নব দিগন্তের পথে’ জঙ্গিদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে মধ্য দিয়ে ৯ জঙ্গি আত্মসমর্পণ করেন।

আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে শাওন বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থাকাকালীন আমি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্মীয় বিভিন্ন পোস্ট দেখে আকৃষ্ট হই। ২০০৯ সালে আনসার আল ইসলামের দাওয়াতি শাখায় কাজ শুরু করি। ২০০৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত আমি সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলাম। এক পর্যায়ে আমি আমার কয়েকজন বন্ধুকে মোটিভেট করে সংগঠনে যুক্ত করতে সক্ষম হই। তবে এখন পর্যন্ত আমি নিজে কখনও কোনো নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হইনি।

‘সংগঠনের দায়িত্বশীলদের নির্দেশনায় আমি দাওয়াতি শাখা থেকে সংগঠনের প্রশিক্ষণ বিভাগের ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে নিয়োজিত হই। তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতার কারণে আমি স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারছিলাম না। নিজের কোনো সামাজিক, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবন বলে কিছুই ছিল না। পরে আমি নিজেকে জঙ্গি সংগঠন থেকে বের করে আনতে বাধ্য হই। তবে ওই সময়টা আমি পরিবার নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে শুরু করি। ’

শাওন আরও বলেন, একটা সময় গিয়ে বুঝতে পারি যে, আমি ধর্মীয় অপব্যাখ্যার শিকার হয়েছিলাম। তখন নিজেই অনুশোচনার মধ্যে পড়ে যাই। আমার ভেতরে নতুন বোধ উদয় হয়। আমি পরিবারের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করি। স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবার ও বন্ধুদের নিয়ে নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখি।

‘তখন আমি কিছুটা ভীত হয়ে পড়েছিলাম। তারপর পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে র‌্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করি। শুরুতে কিছুটা দ্বিধার মধ্যে থাকলেও র‌্যাব আমার ভয়-ভীতি, দ্বিধা সব দূর করে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য সাহস দেয়। ’

শাওন বলেন, আমি যে পথে হেঁটেছি, তা ভুল পথ। তরবারির ঝনঝনানি, এটা সেই যুগের কথা। এখন জ্ঞান বিজ্ঞানের যুগ, শিক্ষার যুগ। মননশীলতা, চিন্তা সৃষ্টিশীলতার যুগ। ভালোবাসা দিয়ে পৃথিবী গড়ে তোলার যুগ। আমরা কেউ যেন ইসলাম নিয়ে ভুল ব্যাখ্যায় প্রভাবিত না হই। ইসলাম শান্তির ধর্ম। আসুন আমরা ইসলাম অনুসরণ করি, একটা সত্য সুন্দর বাংলাদেশ গড়ে তুলি।

ডা. নুসরাত আলী জুহি (২৯) সিলেটের একটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রী থাকাবস্থায় জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্য শাওনের সঙ্গে বিয়ে করেছিলেন। মূলত স্বামী শাওন তাকে উগ্রবাদের দিকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। স্বামীর সঙ্গে সে সাংগঠনিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতেন। জঙ্গিবাদে জড়িত হওয়ার কারণে নুসরাত ঢাকায় কয়েকটি হাসপাতালে তার পরিচয় গোপন রোখে খণ্ডকালীন চাকরি করেছিলেন। বর্তমানে তিনিও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৫২৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০২১
এসজেএ/পিএম/এইচএডি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।