ঢাকা: এনা পরিবহনের চালক মোহাম্মদ ফারুক হোসেন। শুক্রবার (৩০ এপ্রিল) ১০ কেজি চালের আশায় মহাখালী বাস টার্মিনালে অপেক্ষা করছেন।
সন্তান-সংসার নিয়ে ছোট একটা বাসায় রাজধানীতে বসবাস। প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা ঘর ভাড়া দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। কারণ অন্যান্য মাসে বাস চালিয়ে অনায়াসে ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকা আয় করেন ফারুক। এখন লকডাউনে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত তিনি।
বাস চালক ফারুক হোসেন বলেন, ‘লকডাউন’ কি শুধু আমাদের জন্য। প্রাইভেটকার-ট্রাক চলতে পারলে আমাদের হাত পা কেন বাঁধা হয়েছে। সরকারের কাছে অনুরোধ স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাস চালানোর অনুমতি দিক। না হলে সামনে ঈদ পরিবারের সামনে দাঁড়াতে পারবো না। জীবনে কখনও কারোর কাছে হাত পাততে হয়নি। কিন্তু এখন অসহায় হয়ে পড়েছি। আমাদের উপর এত জুলুম কেন?
ফারুকের মতো চলমান ‘লকডাউনে’ মানবেতর জীবন যাপন করছে সড়ক ও নৌ পরিবহনে কর্মরত হাজারোও শ্রমিক।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) পরিচালিত বেসরকারি বাণিজ্যিক যান্ত্রিক এবং অযান্ত্রিক সড়ক ও নৌ যান জরিপে দেখা গেছে, ৩১ লাখ ৬১ হাজার ১১৭ জন পরিবহন শ্রমিক রয়েছেন। দেশের পরিবহন খাতে নৌ পরিবহনে কর্মরত রয়েছেন ৩ লাখ ৩ হাজার ৭৮৮ জন শ্রমিক। অন্যদিকে সড়ক পরিবহনে কর্মরত ২৮ লাখ ৫৭ হাজার ৩২৯ জন শ্রমিক।
সড়ক পরিবহনে মোট জনবলের ৫ লাখ ৮৩ হাজার ১৭৯ জন কাজ করেন সাধারণ রিকশায়। এছাড়া অটোরিকশা ও স্কুটারে ২ লাখ ২৪ হাজার ৪৬৯ জন। সাড়ে ৪ লাখ মানুষ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। ১ লাখ ২০ হাজার মানুষ রিকশা ভ্যান চালিয়ে সংসার চালান। এছাড়া চেয়ার কোচে ৮৩ হাজার ৩৯২, সাধারণ বাসে ৫৭ হাজার ২৮১, মিনি বাসে ৮০ হাজার, মাইক্রোবাসে ৮৫ হাজার ৭৩৬ ও নসিমন চালিয়ে ৮১ হাজার মানুষ সংসার চালান। আর ‘লকডাউনে’ বিপাকে পড়েছেন ১ লাখ ২৩ হাজার মোটরসাইকেল (রাইডশেয়ার) চালক।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে পরিবহন শিল্প, বিশেষত বেসরকারি খাত সংশ্লিষ্ট সড়ক পরিবহন শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেসরকারি খাতে যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক যানবাহনের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের শ্রমজীবী মানুষের একটি বড় অংশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষাভাবে বেসরকারি পরিবহনখাতে নিয়োজিত রয়েছে। দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) এই খাতের অবদান প্রায় আট শতাংশ। জাতীয় অর্থনীতিতে পরিবহন শিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং এটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি সাধারণ হাতিয়ার হিসেবে চিহ্নিত হয়।
দেশে মোট সড়ক যানের মধ্যে ২৬ লাখ ২ হাজার ৩৫৩টি সড়ক যান বা ৯৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ স্বতন্ত্র বা একক মালিকানার অধীনে পরিচালিত। অপরদিকে, যৌথ মালিকানার সড়ক যানের সংখ্যা ৩২ হাজার ৮১০ বা ১ দশমিক ২৩ শতাংশ মাত্র। বেসরকারি লিমিটেড কোম্পানির অধীনে পরিচালিত সড়ক যানের সংখ্যা ৬ হাজার ৫২৯টি যা মোট সড়ক যানের শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ। সড়ক যানের একটি বিশাল অংশ স্বতন্ত্র মালিকানার অধীনে পরিচালিত।
মোট ২ লাখ ৫৩ হাজার ৪১৫টি নৌযান বা ৯৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ স্বতন্ত্র মালিকানাধীন বা একক মালিকানার অধীনে পরিচালিত। অপরদিকে ৬ হাজার ৯৪৪টি বা ২ দশমিক ৬৫ শতাংশ নৌ-যান যৌথ মালিকানার অধীনে পরিচালিত হয়ে আসছে।
‘লকডাউনে’ এসব যাত্রীবাহী পরিবহন বন্ধের ফলে আয়হীন হয়ে পড়েছেন সড়ক ও নৌ শ্রমিকেরা। লকডাউন সব থেকে বেশি প্রভাব পড়েছে পরিবহন শ্রমিকদের উপর। এই জন্য চলমান লকডাউনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাস চালুর দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি।
সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, ‘লকডাউনে’ বাস ছাড়া সবই চলছে। বাস চালু না থাকায় স্বাস্থ্যবিধি না মেনে বিকল্পভাবে সিএনজি চালিত অটোরিকশা, টেম্পু, থ্রি-হুইলার, মাইক্রোবাস, স্টাফ বাস এমনকি অ্যাম্বুলেন্সেও গাদাগাদি করে যাত্রী বহন করা হচ্ছে। এতে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। বরং স্বাস্থ্যঝুঁকি আরও বাড়ছে। লকডাউনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাসে সিটের অর্ধেক যাত্রী তথা ২ সিটে একজন যাত্রী নিয়ে বাস চালু থাকলে করোনা সংক্রমণ বাড়ার সম্ভাবনা থাকবে না। বাস চালুর ব্যাপারে সারা দেশের পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের মধ্যে সাংঘাতিকভাবে ক্ষোভ বিরাজ করছে। বাস চালুর দাবিতে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় সড়ক-মহাসড়কে অবরোধ ও বিক্ষোভ চলছে।
তিনি আরও বলেন, সামনে ঈদ। লাখ লাখ শ্রমিক কর্মহীন অবস্থায় পড়ে আছে। বহু গরিব মালিক ব্যাংক ঋণের কিস্তিসহ অসহায় অবস্থায় জীবন-যাপন করছে। এসব দিক বিবেচনা করে কর্মহীন শ্রমিকদের খাদ্য সহযোগিতা প্রদানসহ বাস চালু করতে সারা দেশের মালিকদের পক্ষ থেকে সরকারের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছি।
বাংলাদেশ সময়: ১২২৩ ঘণ্টা, মে ০১, ২০২১
এমআইএস/এইচএডি