ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

জাতীয়

খ্যাতির জন্য নারী চিকিৎসক ঈশিতার যত প্রতারণা

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০২১ ঘণ্টা, আগস্ট ১, ২০২১
খ্যাতির জন্য নারী চিকিৎসক ঈশিতার যত প্রতারণা

ঢাকা: করোনা মহামারিকে পুঁজি করে ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে কর্মশালা ও সেমিনারের আয়োজন করে প্রশিক্ষক ও আলোচকের ভূমিকায় থেকে ভুয়া সার্টিফিকেট দিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিতেন ইসরাত রফিক ঈশিতা।

এছাড়াও বিদেশিদের দিয়ে সার্টিফিকেট দেওয়ার প্রচারণা চালিয়ে অর্থের বিনিময়ে তরুণদের আকৃষ্ট করতেন তিনি।

সেমিনারে অংশ নেওয়ার জন্য জনপ্রতি ৪ হাজার টাকা ও সার্টিফিকেট দেওয়ার নামে ৩ হাজার টাকা নিতেন বলে জানিয়েছে র‌্যাব।

রোববার (০১ আগস্ট) বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

এদিন সকাল সাড়ে ৯টার দিকে রাজধানীর মিরপুর ১ নম্বর থেকে কথিত তরুণ চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও গবেষক, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ইশরাত রফিক ঈশিতা ও তার সহযোগী মো. শহিদুল ইসলাম ওরফে দিদারকে গ্রেফতার করা হয়।

অভিযানে ভুয়া আইডি কার্ড, ভুয়া ভিজিটিং কার্ড, ভুয়া সিল, ভুয়া সার্টিফিকেট, প্রত্যয়নপত্র, পাসপোর্ট, ল্যাপটপ, ৩০০ পিস ইয়াবা, ৫ বোতল বিদেশি মদ ও মোবাইল ফোন জব্দ করে র‌্যাব।

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেফতার হওয়া ইশরাত রফিক ঈশিতা পেশায় একজন চিকিৎসক। যিনি বিভিন্ন মাধ্যমে একজন আলোচক, চিকিৎসা বিজ্ঞানী, গবেষক, পিএইচডি সম্পন্ন, মানবাধিকার কর্মী, সংগঠক, বিগ্রেডিয়ার জেনারেল পদমর্যাদার এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সদস্যসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত রয়েছেন বলে ভুয়া পরিচয় দিতেন।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ঈশিতা ভুয়া পরিচয়ের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনে করতেই ভুয়া নথিপত্র তৈরি ও প্রচার-প্রচারণা চালাতেন।

ঈশিতা ২০১৩ সালে ময়মনসিংহের একটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস সম্পন্ন করেন। এরপর ২০১৪ সালের জুনের প্রথম দিকে মিরপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে যোগ দেন। পরে একটি সরকারি সংস্থায় চুক্তিভিত্তিক চিকিৎসক হিসেবে নিয়োগ পান। সেখানে ৪ মাস পর শৃঙ্খলাজনিত কারণে ঈশিতাকে চাকরিচ্যুত করা হয়।

র‌্যাব কর্মকর্তা আরও বলেন, গ্রেফতার ঈশিতা চিকিৎসা শাস্ত্রের বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ও গবেষক হিসেবে নিজের পরিচয় দিতেন। তার ভুয়া বিশেষজ্ঞ ডিগ্রিগুলোর মধ্যে রয়েছে এমপিএইচ, এমডি, ডিও। এছাড়া ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ হিসেবেও নিজের পরিচয় দিতেন।

ঈশিতা বিভিন্ন সাইটে চিকিৎসা শাস্ত্রে গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ, আর্টিকেল ও থিসিস পেপার প্রকাশনা করেছেন। তিনি মূলত অনলাইনে প্রাপ্ত বিভিন্ন গবেষণাধর্মী প্রকাশনা এডিট করে গবেষণাধর্মী প্রকাশনা তৈরি করতেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন।

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ঈশিতা ২০২০ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশে হোটেল পার্ক অ্যাসেন্টে অনুষ্ঠিত জিআইএসআর ফাউন্ডেশনের প্রদত্ত ইন্টারন্যাশনাল ইন্সপিরেশনাল ওমেন অ্যাওয়ার্ড (আইআইডবিউ ২০২০) পেয়েছেন। যা ৩৫ বছর বয়সী চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও গবেষকদের মধ্যে ‘বছরের সেরা নারী বিজ্ঞানী’র পুরস্কার। এছাড়া তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতে ‘রিসার্চ অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’, ভারতের ‘টেস্ট জেম অ্যাওয়ার্ড ২০২০’, থাইল্যান্ডে আন্তর্জাতিক শিক্ষা সম্মেলনে অংশ নিয়ে ‘আউটস্ট্যান্ডিং সায়েন্টিস্ট অ্যান্ড রিসার্চার অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন। তিনি প্রতারণার মাধ্যমে ভুয়া নথি উপস্থাপন করে ২০১৮ সালে জার্মানিতে ‘লিন্ডা ও নোবেল লরিয়েট মিট-মেডিসিনে’ অংশ নেন। তবে এগুলো সবই ভুয়া।

ঈশিতা প্রচার করেন তিনি প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এসব আন্তর্জাতিক সেমিনার ও অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। এছাড়া তিনি আমেরিকান সেক্সুয়াল হেলথ অ্যাসোসিয়েশন, ন্যাশনাল সার্ভিকাল ক্যান্সার কোয়ালিশন এবং গ্লোবাল গুডউইলের মতো সংগঠনের অ্যাম্বাসেডর হিসেবে বাংলাদেশে কাজ করছেন বলে প্রচার করতেন।

অ্যাওয়ার্ড বিষয়ক অনুষ্ঠানে উপস্থিতির এডিটিং করা ভুয়া ছবি ও সনদ তৈরি করে গণমাধ্যমে পাঠানো ও ভার্চ্যুয়াল জগতে প্রচারণা করতেন বলেও প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন ঈশিতা।

খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেফতার ঈশিতা প্রতারণার কৌশল হিসেবে নিরাপত্তা বাহিনীর র‌্যাংক ব্যাচ ও পদ অর্জনের চেষ্টা চালান। তিনি ফিলিপাইনে পরিচালিত একটি ওয়েবসাইট (IPC.Phil.com) থেকে ৪০০ ডলারের বিনিময়ে সামরিক বাহিনীর মতো ‘বিগ্রেডিয়ার জেনারেল’ পদ কিনেছিলেন বলে জানান। এছাড়াও তিনি ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ অর্গানাইজেশন, কাউন্টার ক্রাইম ইন্টেলিজেন্স অর্গানাইজেশনের সদস্য পদের ভুয়া সনদ তৈরি করে প্রচারণা চালাতেন।

নিজের ভুয়া ডিগ্রি, পদ ও পদবী প্রচারণার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও আইপি চ্যানেল ব্যবহার করতেন ঈশিতা। প্রচারণার মাধ্যমে তিনি বিশিষ্ট আলোচকদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হিসেবে টকশোতে অংশ নিতেন। ক্ষেত্র বিশেষে গণমাধ্যমে তার টকশো, আলোচনা, সাক্ষাৎকার ও সাফল্য প্রচারিত হয়েছে। মূলত তিনি তার ভুয়া সার্টিফিকেট, এডিটিং ছবি, মিথ্যা বিবৃতি ও তথ্য প্রদানের মাধ্যমে সবাইকে বিভ্রান্ত করতেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে তিনি মানবাধিকার লঙ্ঘন, নারী ও শিশু অধিকার, চিকিৎসা বিজ্ঞান, করোনাভাইরাসের বিষয়ে আলোচক হিসেবে আবির্ভূত হয়ে গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধিতে অপচেষ্টা চালাতেন বলে স্বীকার করেছেন।

র‌্যাব কর্মকর্তা বলেন, ঈশিতা বিভিন্ন জায়গায় তার সহযোগী শহিদুল ইসলাম দিদারকে বস হিসেবে সম্বোধন করতেন, যাতে কোথাও জটিলতায় না পড়েন। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনলাইনে বিভিন্ন মিটিংয়ে বস হিসেবে দিদারকে পরিচয় দিতেন। তবে কৌশলগত কারণে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত ‘ইয়াং ওয়ার্ল্ড লিডার্স ফর হিউম্যানিটি’ অনুষ্ঠানে তিনি অংশ নেননি।

তিনি বলেন, ঈশিতার সহযোগী গ্রেফতার শহীদুল ইসলাম দিদার ২০১২ সালে একটি ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে তিনি পোস্ট গ্রাজুয়েশন ডিপ্লোমাও সম্পন্ন করেন। বর্তমানে একটি গার্মেন্টেসে কমার্শিয়াল ম্যানেজার হিসেবে নিযুক্ত রয়েছেন। তিনিও ফিলিপাইনে একই সাইট থেকে অর্থের বিনিময়ে মেজর জেনারেল পদ ধারণ করেন বলে জানান।

শহীদুল ইসলাম দিদার নিজেকে আইন সহায়তা কেন্দ্র (আসক), ইয়াং ওয়ার্ল্ড লিডার ফর হিউম্যানিটিসহ বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা বা কর্ণধার হিসেবে উপস্থাপন করতেন। একইভাবে তিনি দূর্নীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থার দূত বা অ্যাম্বাসেডর হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন।

খন্দকার আল মঈন বলেন, আসামি চক্রে আরও সদস্য রয়েছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

আরও পড়ুন: বহু ভুয়া পরিচয়ে পরিচিত প্রতারক ঈশিতা আটক

বাংলাদেশ সময়: ২০১৩ ঘণ্টা, আগস্ট ০১, ২০২১
এসজেএ/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।