ঢাকা, সোমবার, ১০ আষাঢ় ১৪৩১, ২৪ জুন ২০২৪, ১৬ জিলহজ ১৪৪৫

জাতীয়

বঙ্গবন্ধুর চীন সফর ও তার রাষ্ট্রভাবনা

শামীম খান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৫৭ ঘণ্টা, মার্চ ১৭, ২০২২
বঙ্গবন্ধুর চীন সফর ও তার রাষ্ট্রভাবনা

ঢাকা: একটি জাতি গঠন এবং দেশকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা কী হবে, সে বিষয়ে অনেক আগে থেকেই গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করতেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। চীন ভ্রমণের ওপর বঙ্গবন্ধুর ‘আমার দেখা নয়াচীন’ বইয়ে তা খুব সহজেই ধরা পড়ে।

পরাধীন বাংলার জাতীয় রাজনীতিতে উদীয়মান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান সদ্য বিপ্লব উত্তর চীনে গিয়েছিলেন ১৯৫২ সালের অক্টোবর মাসে ‘পিস কনফারেন্স অব দি এশিয়ান অ্যান্ড প্যাসিফিক রিজিওন্স’-এ পাকিস্তানের প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে। ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর চীনের শাসন ব্যবস্থা, সমাজে এর প্রভাব এবং যার ফলে মাত্র তিন বছরে মানুষের জীবনযাত্রা ও আর্থসামাজিক অবস্থার যে বিরাট পরিবর্তন, সেটা অতি সুক্ষ্মভাবে তিনি পর্যবেক্ষণ করেছেন। তার লেখায় একটি দেশের নতুন সমাজব্যবস্থা পর্যবেক্ষণে একজন উদীয়মান নেতার মুক্তমনের পাশাপাশি ওই বয়সেই একজন অভিজ্ঞ ও পরিপক্ক রাজনৈতিক নেতার মত তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী দৃষ্টির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শেখ মুজিবের গণচীন ভ্রমণ তার সেই চেতনাকে আরও প্রভাবিত করে। তার দৃষ্টিতে সহজেই ধারা পড়ে।

চীন থেকে ঘুরে আসার দুই বছর পর বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘আমার দেখা নয়াচীন’ বইটিতে (প্রকাশ ২০২১) এর প্রভাব প্রবলভাবে লক্ষ্য করা য়ায়। সেখানে তিনি যা প্রত্যক্ষ করেছেন, যা কিছু তার রাজনৈতিক চেতনাকে আন্দোলিত করেছে, লেখায় তিনি তা সহজভাবে তুলে ধরার পাশাপাশি নিজের দেশ ও মানুষের জরাজীর্ণ অবস্থার পরিবর্তনের নিজস্ব ভাবনাও বিশ্লেষণ করেছেন। শুধু তাই নয়, স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশ গঠনে বঙ্গবন্ধুর নেওয়া পদক্ষেপগুলোর সঙ্গে সেই চিন্তা-ভাবনার সামঞ্জস্য লক্ষ্য করা যায়।

চীনে বঙ্গবন্ধু প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রত্যেক শ্রেণি-পেশার মানুষের উন্নয়নে রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপগুলো তীক্ষ্ণভাবে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। রাষ্ট্রীয় ওই পদক্ষেপগুলোর ফলে দ্রুত গতিতে দেশটির মানুষের সার্বিক অবস্থার যে পরিবর্তন তিনি দেখেছেন, তাতে ভীষণভাবে অভিভূত হয়েছেন, যেটা এই বইয়ে চীনের সরকারের কর্মযজ্ঞ সম্পর্কে তার মন্তব্যের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে।

সফরকালে বঙ্গবন্ধু চীনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিল্পকারখানা, কৃষিখামার, হাসপাতাল ও বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে গিয়েছেন। তিনি সুক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে এবং অনুসন্ধিচ্ছু মন নিয়ে পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করেছেন, কীভাবে দেশটির নতুন শাসন ব্যবস্থা দারিদ্র্য, বেকারত্ব, ভিক্ষাবৃত্তি, দুর্নীতি, কালোবাজারি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, চুরি-ডাকাতি বন্ধ করেছে। এই সব ক্ষেত্রে সরকারের পদক্ষেপ ও ব্যবস্থাগুলো সম্পর্কে জানা এবং পরিবর্তনগুলো প্রত্যক্ষ করতে তিনি চীনের শহর, গ্রাম, প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে বেরিয়েছেন। কী উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি ছুটেছেন, তা তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন, যা একজন অসাধারণ রাজনীতিকের পরিচয় বহন করে।

চীনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু মন্তব্য করেছেন—‘আমাদের দেশের মতো কেরানি পয়দা করার শিক্ষা ব্যবস্থা আর নাই। কৃষি শিক্ষা, শিল্প, ইঞ্জিনিয়ারিং, টেকনিক্যাল শিক্ষা দেওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। ’ সেখানকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের দেওয়া তথ্য থেকে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন—‘আমার সাথে আলাপ হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর মি. হালিমের, তার একটা চীনা নামও আছে। তিনি আমাকে বললেন, বাধ্যতামূলক ফ্রি শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছি। প্রত্যেক ছেলে মেয়েকে স্কুলে দিতে হয়। সরকার তাদের যাবতীয় খরচ বহন করে। ’

চীনের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু আরও লিখেছেন—‘একটা বিষয় দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। এক এক দেশে এক এক প্রকারের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট শ্রেণি (প্রিভিলেজড ক্লাস) আছে যেমন—আমাদের দেশে অর্থশালী জমিদাররা প্রিভিলেজড ক্লাস.... কিন্তু নতুন চীনে দেখলাম শিশুরাই প্রিভিলেজড ক্লাস। এই প্রিভিলেজড ক্লাসটা সরকারের নানা সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকে। ’

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শিক্ষা ব্যবস্থার সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেন। শিক্ষার্থীদের জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত বিনামূল্যে এবং মাধ্যমিক পর্যন্ত নামমাত্র মূল্যে পাঠ্যবই সরবরাহের ব্যবস্থা, ১১ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাসহ ৪০ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারিকরণ করেছিলেন। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মাফ, বিনামূল্যে, স্বল্পমূল্যে কৃষকদের মধ্যে কৃষি উপকরণ বিতরণের ব্যবস্থা করেছিলেন। পরিত্যাক্ত ব্যাংক, বিমা ও ৫৮০টি শিল্প ইউনিটের জাতীয়করণ ও বন্ধ শিল্প কারখানা চালু, নতুন শিল্প স্থাপনের মাধ্যমে হাজার হাজার শ্রমিক কর্মচারীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছিলেন (তথ্য সূত্র: আমার দেখা নয়াচীন বইয়ে বঙ্গবন্ধুর জীবনপঞ্জি)।

মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও কাজের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা দেন। এর লক্ষ্য ছিল দুর্নীতি দমন, কৃষি ও শিল্পে উৎপাদন বৃদ্ধি, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এবং জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা। এই লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে তিনি দেশের সব রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে এক মঞ্চ অর্থাৎ বাংলাদশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠন করেন। তার এই পদক্ষেপগুলোর মধ্যে চীনের যে বিষয়গুলো তাকে আকৃষ্ট করেছিল সেগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য লক্ষ্য করা যায়।

চীনের দুর্নীতি দমনে বঙ্গবন্ধু দারুণভাবে অভিভূত হয়েছিলেন। এ সম্পর্কে তিনি লিখেছেন—‘নয়াচীন থেকে ঘুরে এসে আমার এই মনে হয়েছে যে, জাতির আমূল পরিবর্তন না হলে দেশ থেকে দুর্নীতি দূর করা কষ্টকর। নতুন করে সকল কিছু ঢেলে সাজাতে হবে। ...ভিত্তিটা মজবুত করতে হয়। ...তারা ভিত্তি মজবুত করে কাজ শুরু করেছে। ’ বঙ্গবন্ধুর এই পর্যবেক্ষণের মধ্যে নিজের দেশ ও জাতি গঠনে একজন রাজনীতিবিদের ভবিষ্যৎ চিন্তা ও পরিকল্পনার ছাপ রয়েছে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু দুর্নীতি দূর করার ওপর অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তার সেই সময়কার বিভিন্ন বক্তৃতায় পাওয়া যায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ।

দারিদ্র্য বিমোচন নিয়ে চীনের পদক্ষেপগুলোকে তিনি সুক্ষ্মভাবে দেখার চেষ্টা করেছেন। সেখানে ভিক্ষুক খুঁজতে তার প্রচেষ্টার কথা তুলে ধরে বলেন—‘দীর্ঘ পঁচিশ দিন পর্যন্ত নয়াচীনের কত নগর, কত গ্রাম আমি দেখেছি তা আপনারা সহজেই অনুমান করতে পারেন। মহল্লায় মহল্লায় ঘুরেছি। পাড়ায়, পাড়ায় বেড়িয়েছি, স্টেশনে স্টেশনে নেমে ঘুরে দেখেছি। চেষ্টা করছি দেখতে ভিক্ষুক পাওয়া যায় কি না। এ দেশ একদিন ভিক্ষার জন্য বিখ্যাত ছিল। তাই চীনে যথেষ্ট জায়গা খুঁজেও একটা ভিক্ষুক দেখতে পেলাম না। ”

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার বইয়ে চীনের ভবিষ্যৎ মূল্যায়ন করতে গিয়ে যে মন্তব্য করেছেন তার মধ্য দিয়ে দূরদৃষ্টির তীক্ষ্মতা ফুটে ওঠে। তিনি বলেছেন—‘নতুন মানুষদের একটা জাত গড়ে তুলছে নয়াচীন। ১৫/২০ বছর পর এরা লেখাপড়া শিখে মানুষ হয়ে দেশের জন্য কাজ করবে তখন ভেবে দেখুন নয়াচীন কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। ’ আর এক জায়গায় তিনি বলেছেন—‘যদি দশ বৎসর তারা দেশকে শান্তিপূর্ণভাবে গড়তে পারে তবে... দুনিয়ার যে কোনো শক্তির সাথে মোকাবিলা করতে পারবে সকল দিক থেকে। ’ আজকের চীনের দিকে তাকালে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি কতটা প্রখর ছিল, তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কমিউনিস্ট আর্দশ দ্বারা প্রভাবিত দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, এই মতাদর্শ প্রয়োগের ফলে পরিবর্তনের যে সূচনা তিনি দেখিছিলেন, সেটা থেকেই তিনি এ মন্তব্য করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধু এ সময় নয়াচীনের প্রতিষ্ঠাতা, চেয়ারম্যান মাও সে তুং-এর নিরাপত্তার দিকটাও পর্যবেক্ষণ করেছেন। তিনি মাও সে তুংয়ের নিরাপত্তার গুরুত্ব সম্পর্কে লিখেছেন—‘আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনাদের নেতাকে তো সকলে ভালোবাসেন তবে তিনি ওভাবে গার্ডের ভেতর বাস করেন কেন? তারা উত্তর দিল, দুনিয়া ভরা আমাদের শত্রু। মাও সে তুংকে হত্যা করার জন্য কোটি কোটি টাকা ব্যয় করতে অনেক সাম্রারাজ্যবাদী রাষ্ট্র প্রস্তুত। ঘরের শত্রুও আছে। ’

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরও দেশের ভেতরে-বাইরে শত্রু ছিল। অনেকের মুখেই শোনা যায়, বঙ্গবন্ধু নিজের নিরাপত্তার ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন, পর্যাপ্ত নিরাপত্তার প্রয়োজনীয়তাকে তিনি গুরুত্ব দেননি। মানুষের প্রতি বিম্বাস আর উদার মন নিয়েই চলতেন। একটা রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত সদ্য স্বাধীন দেশের স্থপতি হিসেবে নিজের নিরাপত্তার দিকটাকে গুরুত্ব দিলে হয় তো বঙ্গবন্ধুকে ঘাতকের হাতে এভাবে জীবন দিতে হতো না।

বাংলাদেশ সময়: ২১৫৫ ঘণ্টা, মার্চ ১৭, ২০২২
এসকে/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।