ঢাকা, বুধবার, ৩১ চৈত্র ১৪৩১, ১৫ মে ২০২৪, ০৬ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

প্রতিবন্ধী মিরাজুল এখন গ্রামের সবার ভরসার নাম

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪০১ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৮, ২০২২
প্রতিবন্ধী মিরাজুল এখন গ্রামের সবার ভরসার নাম

পাবনা: সামাজিকভাবে অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার তরুণ মিরাজুল জন্মে ছিলেন দুই হাত ছাড়া। তবে প্রতিবন্ধী হলেও থেমে থাকেননি তিনি।

প্রবল ইচ্ছা শক্তি তাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়েছে। দুই হাত না থাকায় তাকে শুরুতে স্কুলে ভর্তি নেওয়া হয়নি। তবুও দমে যাননি।

নানা প্রতিবন্ধকতা দূর করে সমাজের বঞ্চনাকে মাথায় নিয়ে এগিয়ে চলেছেন। সময়ের সঙ্গে জীবনযুদ্ধে এরই মধ্যে পার করেছেন ২০ বছর। এ সময় শিক্ষা, সামাজিক মর্যাদা, কর্মসংস্থানসহ অর্জন করেছেন নানা খ্যাতি। অবহেলিত শারীরিক প্রতিবন্ধী এই তরুণই আজ হাজারও তরুণের অনুপ্রেরণার নাম আর অসহায়দের ভরসার স্থলে পরিণত হয়েছেন। বাড়ি পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের যাত্রাপুর  গ্রামে।

বাবা তোরাব আলী ও মা সূর্য খাতুনের দুই ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে মিরাজ সবার ছোট। যার থেকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতা পেয়েছেন সম্প্রতি সেই মাকেও হারিয়েছেন। বাবা শারীরিক ভাবে অসুস্থ হয়ে দীর্ঘদিন বাড়িতেই থাকেন।

দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম নেওয়া মিরাজের সফলতার পথ এতো সহজ ছিল না। খেয়ে, না খেয়ে, হাজারো কষ্টের মধ্যে নিজেকে সমাজ বা রাষ্ট্রের বোঝা নয় বরং স্বাভাবিক মানুষের মতো কর্মক্ষম প্রমাণ করেছেন।  সোশ্যাল মিডিয়ায় মিরাজ আফরিদী নামে ইউটিউব পেজের মাধ্যমে মাসে অর্জিত টাকার কিছু অংশ তিনি ব্যয় করেন সমাজের অসহায় মানুষের সেবায়।

শুরুতেই মিরাজ চেয়েছিলেন শিক্ষার আলোয় আলোকিত হতে। কিন্তু সেই পথও সহজ ছিল না। মাটিতে লেখার জন্য বাঁশের কাঠি বানিয়ে দিয়েছিলেন বোন মুক্তা খাতুন। প্রথম প্রথম মিরাজ লিখতে পারতেন না, ধীরে ধীরে মাটিতে লেখা শেখেন। পরবর্তীতে পা দিয়ে লিখে যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে স্কুলে ভর্তি হন। দুই হাত না থাকা সত্ত্বেও পা দিয়ে সব ধরনের কাজ করতে পারেন। মনের প্রবল ইচ্ছাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যান। আটঘরিয়া উপজেলার একদন্ত উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় পেয়েছেন ‘এ গ্রেড’। সর্বশেষ চলতি বছরে পাবনার সরকারি শহীদ বুলবুল কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় ৪.৮৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন।

এখন মিরাজের সফলতার গল্প অনেক। ইচ্ছেশক্তি থাকলে মানুষকে যে দমিয়ে রাখা যায় না, তা প্রমাণ করে দিয়েছেন মিরাজ। দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় বেসরকারি একটি টিভি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন। আর এখন নিয়মিত টিভি চ্যানেলগুলোতে বিনোদন দিয়ে যাচ্ছেন। প্রযুক্তিখাতে গড়েছেন নিজের ক্যারিয়ার। এখন সফল ফ্রিল্যান্সার ও ইউটিউবার। আর্থিকভাবেও সফল হয়েছেন নিজ চেষ্টায়, হাল ধরেছেন পরিবারের।

এছাড়াও তার ব্যক্তিগত অর্থে এতিম ও অসহায়দের সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। দুই হাত নেই, এরপরও তিনি নিরলসভাবে মানুষের সহযোগিতায় নিজেকে নিয়োজিত করছেন। এই সাহসী গল্প সমাজের অন্য প্রতিবন্ধী ও স্বাভাবিক মানুষদের সাহস যোগাবে। অনুপ্রেরণার এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন এই তরুণ।

মিরাজুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয় তিনি বলেন, ছোট বেলা থেকেই খুব কষ্টে বড় হয়েছি। স্বাভাবিক বাচ্চাদের মতো আমার জীবন ছিল না। মা ও পরিবারের সহযোগিতায় আমি আজ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি। আমার যখন স্বাভাবিক জ্ঞান-বুদ্ধি হয়, তখন থেকেই নিজেকে নিয়ে ভেবেছি। আমি পরিবার-সমাজ কারও বোঝা হয়ে থাকতে চাইনি। প্রতিনিয়ত নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে গেছি। হাসিমুখেই মেনে নিয়েছি সব প্রতিবন্ধকতা। কিন্তু থেমে থাকেনি কখনো।

তিনি আরও বলেন, মনে মনে পণ করেছিলাম  আমাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতেই হবে। সমাজের জন্য, মানুষের জন্য, পরিবারের জন্য ও নিজের জন্য কিছু করতে হবে। সবার সহযোগিতায় আমি এখন মানুষের সেবা করছি। আশা করছি আমার এই কাজ দেখে সমাজের প্রতিবন্ধী বাচ্চাদের আর বোঝা ভাববেন না যেসব অভিভাবকরা। তাদেরকে সেবা যত্ন করবেন। আর সৃষ্টি কর্তার কাছে প্রার্থনা করি সবার যেন সুস্থ বাচ্চা হয়।

মিরাজ বলেন, ‘আমি বুঝি অসহায়-অবহেলিত মানুষের কষ্ট। তাদের কষ্টগুলো আমাকেও আঘাত করে। তাই আমি তাদের পাশে থেকে সহযোগিতা করতে চাই, তাদের পাশে দাঁড়াতে চাই। ’

মিরাজের একমাত্র বোন মুক্তা খাতুন বলেন, সব সময় পরিবারে অর্থনৈতিক অভাব-অনাটন দেখেছি। আমার ভাইকে নিয়ে অনেক চিন্তা করেছি। তার ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক ভেবেছি। স্কুল যখন মিরাজকে ভর্তি করেনি তখন অনেক কেঁদেছি আমরা। কিন্তু তারপরও আমরা থেমে থাকেনি। ওকে সাহস দিয়েছি। আমার ভাই আজকে এই পর্যায়ে পৌঁছাবে তা আমরা কখনও কল্পনাতেও ভাবেনি।

লক্ষ্মীপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আব্দুল মালেক বলেন, ‘মিরাজকে নিয়ে আমাদের ইউনিয়নবাসী গর্ববোধ করি। শারীরিক প্রতিবন্ধী হওয়া সত্বেও সে যে সফলতা দেখিয়েছে তা শুধুমাত্র প্রশংসার দাবিই রাখে না, সমাজকে শিক্ষাও দেয়। মিরাজ আজ অনেক তরুণ যুবকের অনুপ্রেরণার নাম। মিরাজের জন্য আমরা তেমন কিছুই করতে পারিনি। তবে মিরাজ আমাদের জন্য যেমন সম্মান বয়ে আনছে, তেমনি সমাজের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। মিরাজের এই সফলতায় আমরা তার জন্য রাষ্ট্রীয় ভাবে সম্মানের দাবি করছি।

আটঘরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাকসুদা আক্তার বলেন, ‘বিষয়টি আপনাদের কাছ থেকে ও স্থানীয় সাংবাদিকদের মাধ্যমে জানতে পারলাম। মিরাজ সম্পর্কে বিস্তারিত খোঁজখবর নিয়ে প্রশসানের সহযোগিতা লাগলে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ১৪০১ ঘণ্টা, ১৮ এপ্রিল, ২০২২
এমএমজেড

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।