ঢাকা, শনিবার, ১২ আশ্বিন ১৪৩১, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

যে এসপির সঙ্গে দেখা করতে লাগে না অনুমতি 

হারুন-অর-রশীদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৩১ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০২২
যে এসপির সঙ্গে দেখা করতে লাগে না অনুমতি  এসপি আলিমুজ্জামান।

ফরিদপুর: পুলিশ সুপার (এসপি) আলিমুজ্জামান। যার অফিসের দরজা-জানালা খোলা থাকে সবসময়।

কোনো অনুমতি ছাড়াই সকাল থেকে রাত অবধি যে কেউই অনায়াসে ঢুকতে পারেন তার অফিসে। ফরিদপুরের এই এসপিকে অসহায়-গরিব-দুখী থেকে শুরু করে সব ধরনের বিচারপ্রার্থী বিচারের শেষ আশ্রয়স্থল মনে করেন।

নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার গন্ডব গ্রামে জন্ম নেওয়া এ পুলিশ সুপার চলাফেরাও করেন খুব সাদামাটাভাবে। কোনো ধরনের নিজস্ব বডিগার্ড ছাড়াই রাস্তা-ঘাটে মর্নিং ওয়াক করার দৃশ্য যে কারোরই চোখে পড়ে। স্কুল শিক্ষক বাবার নীতি ও আদর্শকে বুকে ধারণ করে পথচলা যার স্বপ্ন। বাবা মো. ওলিয়ার রহমান ছিলেন এমপিওভুক্ত একটি স্কুলের শিক্ষক। যিনি ছাত্র-ছাত্রীদের বিনা পয়সায় নিজ বাড়িতে প্রাইভেট পড়াতেন। পথের অসহায়দের ডেকে এনে নিজ বাড়িতে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। কোনো স্বার্থ ছাড়াই দাঁড়াতেন বিপদগ্রস্তদের পাশে, উপকার করতেন সবার।

বাবার এই নীতিকে বুকে লালন করেন এসপি আলিমুজ্জামান। নিজেও স্বপ্ন দেখেন বাবার আদর্শকে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে। নির্লোভ ও নিরহংকার এই মানুষটি স্বপ্ন বুনেন মানুষের জন্য কিছু করে যেতে।  

তাই তো দরিদ্র শিক্ষার্থীদের কিনে দেন বই কিংবা স্কুল ড্রেস, অসহায়দের তৈরি করে দেন বাড়ি, রোগীদের করে দেন চিকিৎসার ব্যবস্থা।

শীতের রাতে ঘুরে ঘুরে পথচারীদের গায়ে জড়িয়ে দেন শীতবস্ত্র। রমজানে সেই সব পথচারীদেরই আবার করান সেহরি ও ইফতার।

করোনা ভয়াবহ রূপ ধারণ করলে মানুষ যখন দিশেহারা, ঠিক তখন জীবনের মায়া ভুলে পাশে দাঁড়িয়েছেন মানুষের। অসহায় মানুষ যখন পেটের ক্ষুধায় কাতর, তখন সব জায়গায় ব্যর্থ হলেও জায়গা মিলেছে এই পুলিশ সুপারের দরজায়। তিনি তাদের চাল-ডাল কিংবা খাদ্যসামগ্রী কিনে দিয়ে দিয়েছেন সান্ত্বনা।

করোনায় মরদেহ যখন দাফন কিংবা সৎকার করতে ফেলে রাখা হয়েছে তিনি তখন মরদেহটির দাফন ও সৎকারের ব্যবস্থা করেছেন।

করোনায় আক্রান্তদের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিয়েছেন খাবার, সরবরাহ করেছেন অক্সিজেন সিলিন্ডার কিংবা অ্যাম্বুলেন্স সেবা। এভাবে জীবন বাজি রেখে মানুষের সেবা করতে গিয়ে নিজেই আক্রান্ত হন করোনায়। তবুও পিছপা হননি মানুষের সেবা করা থেকে।

সেবা নিতে আসা ফরিদপুর নগরকান্দার লাবন্য বেগম নামে এক গৃহবধূ বাংলানিউজকে বলেন, শুনেছি এসপি স্যার নাকি অনেক ভালো মানুষ। তাই তো কোথাও বিচার না পেয়ে সরাসরি এসপি স্যারের কাছে এসেছি। এসে দেখি তিনি তার কক্ষের দরজা খোলা রেখে অফিস করছেন। পরে অফিসে ঢুকে সরাসরি স্যারের কাছে সব কথা খুলে বললাম। স্যার, আমার কথা মনোযোগ সহকারে শুনে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিলেন।

ফরিদপুরের সালথা থেকে সেবা নিতে আসা শামীম মাতুব্বর নামে এক কৃষক বাংলানিউজকে বলেন, স্যার সমসময় রুম খোলা রেখে অফিস করেন। আমি লুঙ্গি পড়ে একদিন স্যারের সঙ্গে দেখা করেছি। স্যারের অফিসের দরজার সামনে গিয়ে দেখা করার অনুমতি চাইলে, তিনি বলেন, আমার অফিসে ঢুকতে কোনো অনুমতি দরকার নেই। চলে আসুন।  

শামীম নামে এই কৃষক আরও বলেন, এরকম অফিসার যদি সব অফিসে থাকতো, তাহলে আমাদের মতো গরিব মানুষের ন্যায্য অধিকার পেতে কষ্ট হতো না।

এরকম একাধিক সেবাপ্রত্যাশীদের সঙ্গে কথা বলে বাংলানিউজ। তারা বাংলানিউজের কাছে বলেন, আমরা কোনোদিন এমন কর্মকর্তা দেখিনি, সেবাপ্রত্যাশীদের যাতে কোনো বিড়ম্বনায় পড়তে না হয় সে কথা মাথায় রেখে সমসময় দরজা খোলা রেখে অফিস করেন। সম্প্রতি পুলিশের জন্য ৬ তলা বিশিষ্ট একটি ভবন তৈরি করা হয়েছে। তবে সে ভবনে অন্যান্য পুলিশ কর্মকর্তারা অফিস করলেও সেবাপ্রত্যাশীদের কষ্ট হবে এমন কথা চিন্তা করে এসপি পুরনো একটি ভবনের নিচ তলার একটি কক্ষে অফিস করেন। সত্যিই এসপি আলিমুজ্জামান স্যার একজন মানবিক পুলিশ অফিসার। আল্লাহ যেন তাঁকে দীর্ঘায়ু দান করেন।

এসব বিষয়ে জানতে কথা হয় এসপি আলিমুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, মানুষ তো মানুষের জন্য। মানুষকে ভালোবাসা ও সেবা করাই সবচেয়ে বড় ইবাদত। মানুষকে ভালোবাসার মাঝেই আনন্দ খুঁজে পাওয়া যায়।  

দরজা জানালা সবসময় খোলা রাখার ব্যাপারে এ পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, আমি ফরিদপুরে যোগদান করার পরে অফিসের দরজা-জানালার পাশ দিয়ে লোকজনকে ঘোরাঘুরি করতে দেখতাম। পরে কৌতুহল হলে তাদের বিষয়টি জানতে চেষ্টা করি। পরে দেখা গেল, মূলত দরজা-জানালা বন্ধ থাকাতে তারা ঢুকতে সাহস পাচ্ছে না। বিষয়টি সমাধানে সিদ্ধান্ত নেই দরজা-জানালা সার্বক্ষণিক খোলা রেখে অফিস করার। পরে দরজা-জানালার চারপাশে কাউকে ঘোরাঘুরি করতে দেখলেই তাকে ডেকে কারণ জিজ্ঞাসা করাসহ তাদের সমস্যার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে তাৎক্ষণিক সেবা দেওয়ার চেষ্টা করতাম।  

এসপি আলিমুজ্জামান আরও বলেন, সব এসপি-ডিসির বডিগার্ড-ড্রাইভার ও পিয়ন নিজেকে এসপি-ডিসি মনে করেন। তাই তাদের সঙ্গে দেখা না করা ও অনুমতি ছাড়াই আমার অফিসে এসে কেউ যেন বিড়ম্বনায় না পড়েন, সে জন্যই দরজা-জানালা খোলা রেখে অফিস করি। যাতে কোনো ভয়ভীতি ছাড়াই সরাসরি আমার অফিসে ঢুকতে পারেন সেবাপ্রত্যাশীরা।

বাংলাদেশ সময়: ১২২৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০২২
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।