ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ২০ মে ২০২৪, ১১ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

রাজবাড়ী কৃষি ব্যাংকে জাল কাগজে ভুয়া ঋণ, শতাধিক কৃষক হয়রানি

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৪৯ ঘণ্টা, জুলাই ৩১, ২০২২
রাজবাড়ী কৃষি ব্যাংকে জাল কাগজে ভুয়া ঋণ, শতাধিক কৃষক হয়রানি

রাজবাড়ী: বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক রাজবাড়ী শাখা থেকে কোনো ঋণ না নিয়েও শতাধিক কৃষক পেয়েছেন ঋণ খেলাপির লাল নোটিশ। হঠাৎ করেই ঋণ খেলাপির এমন নোটিশ পেয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তারা।

 

ঘটনাটি ঘটেছে রাজবাড়ী সদর উপজেলার খানগঞ্জ ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কৃষি ব্যাংক রাজবাড়ী শাখার দালাল হিসেবে পরিচিত একটি প্রতারক চক্র ব্যাংকের মাঠ পর্যায়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তা এবং ওই সময়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপকের যোগসাজশে ২০১৫ সাল এবং পরবর্তী সময়ে নিরীহ সাধারণ কৃষকের নামে ভুয়া ঋণ দেখিয়ে টাকা তুলে নিজেরাই ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়েছেন। যাদের নামে ঋণ তোলা হয়েছে তারা কখনও ঋণের জন্য আবেদন করেনি বা ব্যাংকেও যাননি।

অভিযোগ উঠেছে, কৃষি ব্যাংকের তৎকালীন মাঠকর্মী রেজাউলের সঙ্গে একটি প্রতারক চক্র সমন্বয় করে কিছু কৃষকের নাম ঠিকানা ব্যবহার করে ও ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জাল ওয়ারিশ সনদ বানিয়ে কৃষকদের নামে ঋণ তুলে নিজেরাই ভাগ বাটোয়ারা করে নেন। অথচ যাদের ঋণ পাওয়ার কথা তারা পাননি। আবার জায়গা জমি নেই এমন অনেকে ঋণ পেয়েছেন। এ ঘটনার দীর্ঘ ৭ বছর পর ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহীতাদের নামে খেলাপির নোটিশ দেওয়া হয়েছে।

ঋণ খেলাপির নোটিশ পেয়েছেন রাজবাড়ী সদর উপজেলার খানগঞ্জ ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামের মণ্ডল বাড়ির ছেলে ইউসুফ মণ্ডল, ছলিম মণ্ডল ও আজিম মণ্ডল। তারা আপন তিন ভাই। কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করলেও তারা ব্যাংক থেকে কখনো কোনো ঋণ নেননি। অথচ মাস ছয়েক আগে তিন ভাইয়ের নামে কৃষি ব্যাংক রাজবাড়ী শাখা থেকে ঋণ খেলাপির লাল নোটিশ আসে।

সেখানে বলা হয়েছে- তারা ব্যাংক থেকে ৬০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। কিন্তু ঋণের টাকা তারা পরিশোধ করেননি। যা সুদ আসলে এখন দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা। অথচ কখনো ঋণের জন্য আবেদন তো দূরের কথা ব্যাংকেও জাননি তারা। ফলে ব্যাংক থেকে বাড়িতে আসা ঋণ খেলাপির চিঠি পেয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন পরিবারের সদস্যরা। শুধু এই তিন ভাই নন, খানগঞ্জ গোবিন্দপুর এলাকার বারেক শেখ, লতিফ শেখ, রহিমসহ অনেক কৃষকই পেয়েছেন কৃষি ব্যাংকের ঋণ খেলাপির লাল নোটিশ।  

ভুক্তভোগীরা জানান, কৃষি ব্যাংক রাজবাড়ী শাখায় কর্মরত তৎকালীন মাঠকর্মী রেজাউলসহ তাদের গ্রামের কয়েকজন প্রতারক চক্র জালিয়াতি করে স্থানীয় কৃষকদের নামে ঋণ তুলে তাদের ফাঁসিয়েছেন।

এ ব্যাপারে কথা হয় ঋণ খেলাপির নোটিশ পাওয়া ভুক্তভোগী তিন ভাই আজম, ইউসুফ ও সলিমের সঙ্গে।
তারা বলেন, কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করলেও এ পর্যন্ত কখনো ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু হঠাৎ করেই মাস ছয়েক আগে কৃষি ব্যাংকের রাজবাড়ী শাখা থেকে কয়েকজন এসে আমাদের তিন ভাইকে তিনটি ঋণ খেলাপির লাল নোটিশ দিয়ে যায়। আমরা নাকি ২০১৫ সালে ব্যাংক থেকে ৬০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছি। যা সাত বছর পর সুদে আসলে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা হয়েছে। নির্ধারিত তারিখের মধ্যে এ টাকা পরিশোধ না করলে গ্রেফতারি পরোয়ানা ও মালামাল ক্রোকের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পরে আমরা তিন ভাই ব্যাংকে গিয়ে বিষয়টি নিয়ে ম্যানেজারের সঙ্গে আলাপ করি এবং নথি খুঁজে দেখি ঋণের জন্য আমাদের নাম ঠিকানা ব্যবহার করা হলেও সেখানে আমাদের ছবির পরিবর্তে অন্য ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। আবার ব্যাংকে যে জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি জমা দেওয়া হয়েছে সেটিতেও নাম-ঠিকানা থাকলেও আসল জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর আর জন্ম তারিখ ঠিক নেই। পরে বিষয়টি ব্যাংকের কর্মকর্তাদের অবগত করলে তারা সমাধানের আশ্বাস দেন। কিন্তু দীর্ঘ ছয়/সাত মাস পার হলেও বিষয়টির সুরাহা না হওয়ায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তারা।

ঋণ খেলাপির নোটিশ পাওয়া আরেক ভুক্তভোগী বারেক শেখ বলেন, তার বয়স হয়েছে, তাই কৃষিকাজ অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছেন। এখন তার ছেলে কৃষিকাজ করে। তারা বাপ-বেটা কখনো ব্যাংক থেকে ঋণ করেননি। আর রাজবাড়ীর কোথায় কৃষি ব্যাংক সেটিও তিনি জানেন না। কখনো ব্যাংকে যাননি। অথচ চিঠিতে দাবি করা হয়েছে, তার ছেলের কাছে ব্যাংক ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা পায়।
বারেক শেখের ছেলে লতিফ শেখ বলেন, লাল নোটিশ পাওয়ার পর খোঁজ নিতে আমরা ব্যাংকে যাই। পরে দেখি আমাদের নাম করে ঋণ নিয়েছে সদর উপজেলার খানগঞ্জ ইউনিয়নের দাদপুর গ্রামের মনছের শেখের ছেলে মো. শাহিন খান। তৎকালীন কৃষি ব্যাংকের মাঠকর্মী রেজাউলের মাধ্যমেই এমন প্রতারণা করে তারা টাকা তুলেছে।

এ ব্যাপারে শাহিন খানের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।

তবে বেলগাছি রেলস্টেশন এলাকায় গিয়ে মিরাজ নামে একজনকে খুঁজে পাওয়া যায়। তার বাড়িও সদর উপজেলার খানগঞ্জ ইউনিয়নে। তিনি জানান, তার বাড়ি ছাড়া চাষাবাদের কোনো জমি নেই। ২০১৫ সালের দিকে বেলগাছি বাজারে কৃষি ব্যাংকের তৎকালীন মাঠকর্মী রেজাউল হকের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তখন রেজাউল কথায় কথায় বলে আপনাকে কৃষি ব্যাংক থেকে ঋণের ব্যবস্থা করে দেব। তবে এর মধ্যে থেকে আমাকেও ভাগ দিতে হবে। পরে রেজাউল নিজেই জমির জাল কাগজপত্র বানিয়ে ব্যাংক থেকে আমার নামে ৮০ হাজার টাকা ঋণ তোলেন। পরে রেজাউল হক ৫০ হাজার টাকা রেখে তাকে ৩০ হাজার টাকা দেন। এরপর কিছু দিন রেজাউল তার কাছে ফোনে ঋণের টাকা চান। আমি তাকে জানিয়ে দিয়েছি ঋণ ব্যাংক থেকে নিয়েছি, ব্যাংকে টাকা দেব। আপনার কাছে দেব না।

তিনি আরও জানান, আমি ব্যাংকের কোনো নোটিশও পাইনি, টাকাও দেইনি। আমাদের এলাকায় কৃষি ব্যাংকে থেকে এমন ঋণ রেজাউল হকই করে দিয়েছেন, সেখান থেকে টাকার একটি অংশ তিনিই নিয়েছেন। অভিযুক্ত রেজাউল হক বর্তমানে কৃষি ব্যাংক শরীয়তপুর আঞ্চলিক অফিসে কর্মরত। তার সঙ্গে কথা বলতে একাধিকবার মোবাইলে কল দিলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।

এ ব্যাপারে কথা হয় খানগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আতাহার হোসেন তকদিরের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমি দীর্ঘ ১১ বছর এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলাম। চেয়ারম্যান থাকাকালীন গোবিন্দপুর ও হরিহরপুর এলাকার বেশ কয়েকজন কৃষক ঋণ খেলাপির লাল নোটিশ পায়। পরে তারা আমার কাছে এসে বলে তারা কখনো ব্যাংক থেকে ঋণের জন্য আবেদন করেনি। পরে আমি তাদের সঙ্গে নিয়ে ব্যাংকে গিয়ে দেখি আমার সই, ইউনিয়নের প্যাড জাল করে ভুয়া ওয়ারিশনামা বানিয়ে ঋণ তোলা হয়েছে।

তিনি আরও জানান, এ রকম শতাধিক কৃষকের নামে ঋণ খেলাপির নোটিশ এসেছে। স্থানীয় কিছু প্রতারক চক্র ও তৎকালীন কৃষি ব্যাংকের মাঠকর্মী রেজাউল প্রকৃত কৃষকদের নামে টাকা তুলে নিজেরাই ভাগ বাটোয়ারা করে নেয়। এ ধরনের প্রতারক চক্রের কারণে প্রকৃত কৃষকরা ঋণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ ধরনের প্রতারক চক্রের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাই।

কৃষি ব্যাংক রাজবাড়ী শাখার ব্যবস্থাপক মো. মোতাহার হোসেন বলেন, এ ঋণগুলো ২০১৫ সালে বিতরণ করা। আর আমি রাজবাড়ীতে যোগদান করেছি পাঁচ মাস আগে। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে তার সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। সে এখন শরীয়তপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ে কর্মরত। তবে এই ঋণ খেলাপির বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তদন্ত শুরু করেছে। ঋণের কাগজপত্র তাদের কাছেই আছে। তাই আমি এর বেশি কিছু বলতে পারব না।

এ বিষয়ে শরীয়তপুর কৃষি ব্যাংকের আঞ্চলিক কার্যালয়ের সহকারী মহা-ব্যবস্থাপক (এজিএম) খোন্দকার রফিকুল ইসলাম জানন, রাজবাড়ী কৃষি ব্যাংক শাখায় ঋণ প্রদানে অনিয়মের অভিযোগে রেজাউল হকের বিরুদ্ধে গত ২৭ জুলাই নোটিশ পাওয়ার পর তাকে ওইদিন থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ প্রমাণিত হলে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৪৮ ঘণ্টা, জুলাই ৩১, ২০২২
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।