ঢাকা, শনিবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

জীবাণুনাশক স্প্রে থেকে বিস্ফোরণ, মুহূর্তেই ঝলসে যান সবাই

শেখ জাহাঙ্গীর আলম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫৪ ঘণ্টা, আগস্ট ১২, ২০২২
জীবাণুনাশক স্প্রে থেকে বিস্ফোরণ, মুহূর্তেই ঝলসে যান সবাই

ঢাকা : তুরাগ ধানাধীন কামারপাড়ার রাজাবাড়ি পুকুরপাড় এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা মাজহারুল ইসলাম। এলাকায় ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে রিকশার গ্যারেজ পরিচালনা করতেন তিনি।

বাড়তি আয়ের আশায় গত এক বছর হলো ভাঙারি মালামাল কেনা-বেচা শুরু করেছিলেন। রাজাবাড়ি পুকুরপাড় সড়কের পাশে একই সেডের নিচে রিকশার গ্যারেজ ও ভাঙারির দোকান ছিল তার।

গত শুক্রবার (৫ আগস্ট) ভাঙারির মালামাল হিসেবে একাধিক কার্টন ভর্তি জীবাণুনাশক স্প্রে বোতল (হ্যান্ড স্যানিটাইজার) এনে দোকানে মজুদ করেন মাজহারুল ইসলাম। শনিবার (৬ আগস্ট) ভোর থেকে বোতল থেকে দাহ্য পদার্থ ও টিনের অংশ আলাদা করার কাজ চলছিল দোকানে। সাতজন কর্মী এ কাজ করছিলেন মাজহারুল। এ সময় বোতল থেকে নিঃসৃত গ্যাস পুরো দোকানকে গ্যাস চেম্বারে পরিণত করে ফেলে। দুপুর ১২টার দিকে সিগারেটের আগুন অথবা বৈদ্যুতিক স্পার্কের কারণে সেখানে ঘটে ভয়াবহ বিস্ফোরণ। এরপর পুরো দোকানে আগুন ধরে যায়। মুহূর্তেই ঝলসে যান মাজাহারুল ইসলমাসহ ৮ জন।

এ ঘটনার প্রাথমিক তদন্ত করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের কর্মীরা। তারা জানান, ভাঙারির দোকানে মজুদ থাকা জীবাণুনাশক স্প্রেগুলো ছিল মেয়াদোত্তীর্ণ। এসব বোতল ভাঙার সময় গ্যাস বের হয়, যা থেকেই মূলত বিস্ফোরণ ও আগুনের সূত্রপাত।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, কামারপাড়ার রাজাবাড়ি পুকুরপাড় এলাকার গুদাম থেকে ড. রাজেশ জার্ম কিল স্প্রে ফোম ও লাফজ বডি স্প্রে’র বোতলগুলো কিনেছিলেন মাজহারুল ইসলাম। প্রতিটি পণ্যই ছিল মেয়াদোত্তীর্ণ।

এ বিষয়ে ডিএমপির উত্তরা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম বাংলানিউজকে বলেন, গ্যারেজ ও ভাঙারি দোকানের মালিক মাজহারুল ইসলাম নিজেই জীবাণুনাশক এসব স্প্রে ও ফোমের বোতল কিনে এনে তার দোকানে মজুদ করেন। গর্দা হিসেবে এনে পণ্যগুলো বিক্রির উদ্দেশ্য ছিল তার। যে কারণে ৭ কর্মীকে দিয়ে বোতলগুলো ভাঙার কাজ করছিলেন।

বিস্ফোরণ ও আগুনের এ ঘটনায় প্রত্যেকেই দগ্ধ হন। পরে  মাজহারুল ইসলামসহ সাতজনের মৃত্যু হয়। তুরাগ থানায় এ ঘটনায় অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলা বাদি পুলিশ।

আবাসিক এলাকায় এসব দাহ্য পদার্থ গুদামজাতের বিষয়ে পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে কিনা জানতে চাইলে ডিসি মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম বলেন, মেয়াদোত্তীর্ণ স্প্রে বোতল ও দাহ্য পদার্থ যেকোনো জায়গায় মজুদ করা যায় না। কিন্তু মাজহারুল তা-ই করেছিলেন। তিনি যেহেতু মারা গেছেন, তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া সুযোগ নেই। অপমৃত্যুর যে মামলাটি হয়েছে, সেটি তদন্তাধীন।

দাহ্য পদার্থ মজুদ রয়েছে- এমন কিছু গুদামের তথ্য পাওয়া গেছে। যারা মজুদ করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও তিনি জানান।

৬ আগস্ট বিস্ফোরণ ও আগুনের ঘটনায় নিহতরা হলেন- গাজী মাজহারুল ইসলাম (৪৭), তার ভাগিনা আলমগীর হোসেন আলম (২৩), অটোরিকশা চালক নূর হোসেন (৬০), অটোরিকশা চালক মো. মিজান (৩৫), শফিকুল ইসলাম (২৫), আল আমিন (৩৫) ও মাসুম (৩৮)। তাদের মধ্যে প্রথম তিনজন শনিবার রাতেই শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। একই হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন বাকিরাও।

আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন অটোরিকশা চালক মো. শাহীন (২৫)। তার শরীরের ৩৫ শতাংশ দগ্ধ হয়। এ ছাড়া নুর হোসেনের ৯৫ শতাংশ, শফিকুল ইসলাম ৮০ শতাংশ, আল আমিনের শরীরের ৭৫ শতাংশ দগ্ধ হয়েছিল।

কী হয়েছিল সেদিন
সরেজমিনে ঘটনাস্থল ঘুরে ও ক্ষতিগ্রস্ত ওই গ্যারেজের আশপাশের দোকানি ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাজহারুল ইসলাম এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা ছিলেন। গত এক বছর ধরে তিনি ভাঙারির ব্যবসা চালু করেন। যারা তার রিকশা চালাতেন, তাদের মধ্যে অনেকে ভাঙারির দোকানেও কাজ করতেন।

স্থানীয়রা জানান, হ্যান্ড স্যানিটাইজারের কার্টন কিনে আনার পর মাজহারুল কাউকে তার দোকানে ঢুকতে দিতেন না। কেউ গেলেও সরিয়ে দিতেন। ঘটনার দিন দুপুর ১২টার দিকে বিকট শব্দ পান তারা। এরপরই লোকজনের চিৎকার শোনা যায়। তারা গ্যারেজের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে দেখেন, সেখান থেকে একজন-দুজন করে বেরিয়ে আসছেন। কারও শরীরে কাপড় নেই, কারও শরীর থেকে ঝলসে যাওয়া মাংস-চামড়া খসে পড়ছে। গ্যারেজ মালিক মাজহারুলের ভাগনে আলমগীর হোসেন ছিলেন অটোরিকশার মেকানিক। তার মুখের নিচ থেকে চামড়া খসে পড়ছিল।

ঘটনার খরব পেয়ে এদিন উত্তরা স্টেশন থেকে ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট এসে আগুন নিয়ন্ত্রণ করে। এ সময় পর্যন্ত কারও মৃত্যু হয়নি। তাই প্রাথমিক তদন্তে তারা নিহত নেই বলে জানান।

শুক্রবার (১২ আগস্ট) এ ব্যাপারে জানতে দুপুরে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের কন্ট্রোল রুমে যোগাযোগ করা হয়। এ সময় সেখানে দায়িত্বরত টেলিফোন অপারেটর নজরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, তুরাগের রিকশা গ্যারেজ ও ভাঙারির দোকানে আগুনের ঘটনায় আমরা কোনো পাইনি। ওই এলাকার বাসিন্দা মাজহারুল ইসলামের রিকশা গ্যারেজ ও ভাঙারির দোকানে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয় বলে আমাদের প্রতিবেদনে এসেছে। এ ঘটনায় ৫ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া ফায়ার সার্ভিস প্রায় ১৫ লাখ টাকা মূল্যমানের বিভিন্ন সামগ্রী উদ্ধার করে।

বাংলাদেশ সময় : ১৬৫৩ ঘণ্টা, ১২ আগস্ট, ২০২২
এসজেএ/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।