ঢাকা, বুধবার, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ০১ মে ২০২৪, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

যেখানে এসে নিজ হাতে খেতে শিখছেন তারা

তৈয়বুর রহমান সোহেল, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ৮, ২০২২
যেখানে এসে নিজ হাতে খেতে শিখছেন তারা

কুমিল্লা: নয় বছরের শিশু জান্নাতুল মাওয়া। একসময় ঠিকভাবে খেতে পারতো না।

ভাতসহ অন্য খাবার চিবুতে পারতো না। দিতে পারতো না হামাগুড়িও।

মাওয়ার মা ফেরদৌস আক্তার একটি কলেজে শিক্ষকতা করতেন। কিন্তু সন্তানের এমন অবস্থা তাকে অসহায় করে তোলে। এক পর্যায়ে কলেজের চাকরি ছেড়ে সন্তানকে নিয়ে দূর-দূরান্তে ছোটাছুটি করেন। একের পর ডাক্তার বদলান, কিন্তু মেয়ের অবস্থার কোনো উন্নতির হয় না। সর্বশেষ বাধ্য হয়ে তিনি আসেন কুমিল্লা নগরীর প্রতিবন্ধী সাহায্য ও সেবা কেন্দ্রে।

মাওয়ার মা ফেরদৌস বলেন, আমাদের বাড়ি কুমিল্লার তিতাস উপজেলায়। সেখান থেকে এ সেবা কেন্দ্রটিতে নিয়মিত আসি। অনেক ডাক্তার, হাসপাতাল বদলেছি। চাকরি ছেড়ে তাকে নিয়ে অনেক যায়গায় ঘুরেছি। কিন্তু কোনো কিছুতেই লাভ হয়নি। এরপর ছয় মাস আগে এ সেবা কেন্দ্রে তাকে নিয়ে আসি। এখন আমার মেয়ে সুন্দরভাবে কথা বলতে পারে। খাবার খেতে তার কোনো অসুবিধা হয় না। অনেক উন্নতি হয়েছে তার।

তিনি আরও বলেন, কুমিল্লার এই সেবা কেন্দ্রে বিনামূল্যে সেবা পাচ্ছি। তাদের ব্যবহার, সেবা দানের পদ্ধতি ও মানসিকতার কারণে মেয়ের অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। প্রতিবন্ধী ও প্রতিবন্ধিতার ঝুঁকিতে থাকা সন্তানদের নিয়ে বাবা-মায়েরা দুর্ভাবনায় থাকেন। অনেক সময় তারা লজ্জায় পড়ে সঠিক চিকিৎসক কিংবা সঠিক জায়গায় যেতেও অস্বস্তি বোধ করেন। তাদের জন্য আমি বলব, অস্বস্তিতে না থেকে সেবা কেন্দ্রগুলোতে নিতে। সঠিক ফিজিওথেরাপি প্রতিবন্ধিতার ঝুঁকি বহুগুণ কমিয়ে দেয়।

কুমিল্লা নগরীর প্রতিবন্ধী সাহায্য ও সেবা কেন্দ্রটিতে এসে প্রতিবন্ধী ও প্রতিবন্ধিতার ঝুঁকিতে থাকা প্রায় ১৩ হাজার মানুষের অবস্থার উন্নতি হয়েছে। শুধু কুমিল্লা ও বাংলাদেশের অন্যান্য হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে ব্যর্থ হওয়া লোকজন নয়, দেশের বাইরে থেকেও চিকিৎসা নিতে এসে ভালো হতে দেখা গেছে।

সেবা কেন্দ্রের ফিজিওথেরাপিস্ট ডা. মামুন হোসেন জানান, এক সময় মানুষ এ সেবাকেন্দ্রটির বিষয়ে ভালোভাবে জানতো না। আমি অবাক হয়েছি, ভারতের ব্যাঙ্গালোর, চেন্নাই, কলকাতা, তামিলনাড়ু ও সিঙ্গাপুরে গিয়ে চিকিৎসা করানো এমন কিছু প্রতিবন্ধী এসে এখানে সেবা নিয়ে উপকার পেয়েছেন। এটা আমাদের সফলতা।

এই সেবা কেন্দ্রটি ২০১৫ সালের মার্চে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটিতে প্রতিবন্ধী ও প্রতিবন্ধিতার ঝুঁকিতে থাকা ১৩ হাজার ৪২৬ জন এক লাখ ৮৫ হাজার ৮৪০ বার সেবা নিয়েছেন। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় পরিচালিত কুমিল্লা নগরীর প্রতিষ্ঠানটিতে ১০জন লোকবল আছে। বাংলাদেশে এমন ১০৩টি প্রতিবন্ধী উন্নয়ন কেন্দ্র আছে। যেখানে প্রতিবন্ধী ও প্রতিবন্ধিতার ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিরা বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করতে পারেন। সাধারণত প্রতিবন্ধিতার ধরন, শ্রবণ, দৃষ্টি মাত্রা নির্ণয়, ফিজিওথেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি, অটিজম বিষয়ক সেবা, কাউন্সেলিং, সহায়ক উপকরণ বিতরণ, সচেতনতা কার্যক্রম, পক্ষাঘাতগ্রস্তদের সেবা ও পুনর্বাসন করে থাকে সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রটি।

প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কুমিল্লা কেন্দ্রটিতে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিবন্ধী ও প্রতিবন্ধিতার ঝুঁকিতে থাকা বাচ্চারা খেলাধুলা করছে। কেউ থেরাপি দিচ্ছেন। কেন্দ্রের দেয়ালে দেয়ালে আঁকা হয়েছে বর্ণ ও শিক্ষামূলক আলপনা। বাচ্চাদের খেলার জন্য রাখা হয়েছে নানা উপকরণ।

কুমিল্লা নগরীর কাপ্তানবাজার এলাকার বাসিন্দা শাহিনূর আক্তার বলেন, আমার ছেলে আবীর ঘাড় নাড়াতে পারতো না। এক মাস আগে সেবা কেন্দ্রটিতে আসি। এখন আবীর ঘাড় নাড়াতে পারে।

দৌলতপুর এলাকার বাসিন্দা রিয়া আক্তার বলেন, আমার ছেলে মিনহাজুলের ছয় বছর বয়স। সে কথা বলতে পারে না, বসতে পারে না। সেবাকেন্দ্রটিতে আসার পর আমার ছেলে টুকটাক কথা বলতে শিখেছে। তবে বসতে না পারার সমস্যাটি এখনো কাটেনি। আশা করি, সেটাও কেটে যাবে।

কুমিল্লার বুড়িচংয়ের আজ্ঞাপুর গ্রামের বাসিন্দা আবদুর রউফ বলেন, রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে পা পিছলে খেতে পড়ে যাই। সে সময় স্পাইনাল কর্ডে সমস্যা দেখা দেওয়ায় প্যারালাইজড হয়ে পড়ি। ছয় মাস হয় এখানে আসছি। অবস্থার উন্নতি হয়েছে। তবে আরও কিছু যন্ত্রপাতি এখানে আছে, যেগুলো নষ্ট হওয়ায় ব্যবহার করতে পারছি না। এগুলো ঠিক করলে এবং আরও কিছু যন্ত্রপাতি সংযোজন করা গেলে ভালো হতো।

কেন্দ্রটির প্রতিবন্ধী বিষয়ক কর্মকর্তা হাসান আহম্মেদ কামরুল জানান, প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদির জন্য মন্ত্রণালয়ে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে। আশা করি, এগুলোর ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

তিনি আরও বলেন, লজ্জা না পেয়ে প্রতিবন্ধী সন্তানদের নিয়ে এখানে আসতে হবে। কুমিল্লায় ৭০ হাজার প্রতিবন্ধী আছে। প্রতিবন্ধিতার ঝুঁকিতে আছে কয়েক লাখ মানুষ। সচেতনতার অভাবে অনেকে ভুল জায়গায় চলে যান। আমরা চাই, সবাই এখানে এসে বিনামূল্যে সেবা গ্রহণ করুক। পাশাপাশি সেবামূলক নানা উপকরণও আমরা বিতরণ করছি। মানুষ এ সুবিধাটিও নিতে পারেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৪১৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৮, ২০২২ 
এফআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।