বাংলাদেশের রাজনৈতিক আকাশে এখন শুধুই ইলিয়াস। এখন রাজনীতি ঘুরছে ইলিয়াস নিয়ে।
এভাবে যতই প্রলম্বিত হচ্ছে ইলিয়াসের ফিরে আসা নিয়ে নাটক, ততই যেন হরতালের ডাকে অচল আর তা-বময় হয়ে উঠছে দেশের প্রধান সব নগরী। এরই মধ্যে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে একজন বাসচালককে। তাড়া খেয়ে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন আরেকজন। ফুঁসে উঠছে সিলেট। রক্ত ঝরছে ইলিয়াসের জন্মস্থান বিশ্বনাথে। এরই মধ্যে বিশ্বনাথে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে হারিয়ে গেছেন দুজন, লাশ আর রক্তে যেন আন্দোলন গতিময় হয়।
ইলিয়াস আলী সিলেটের রাজনীতিতে এক অনিবার্য নাম। সেটা বলতেই হয় নির্দ্বিধায়। বিএনপি‘র সিলেট বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক হবার সুবাদে তার একটা বিরাট প্রভাব বৃহত্তর সিলেটের সব জেলায়। কিন্তু প্রশ্ন থাকে বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে ইলিয়াস আলী আদৌ কি কোনো ফ্যক্টর ? ইলিয়াস আলী নিয়ে অনেক কথা আছে। তার অতীত নিয়ে অসংখ্য প্রশ্ন চারদিকে ঘুরপাক খায়। তার ছাত্ররাজনীতি, স্বৈরশাসক এরশাদের ছাত্রসমাজের নেতা থেকে পরে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক হ্ওয়া---কোনো কিছুতেই ইলিয়াস স্বচ্ছ কিংবা ক্লিন ইমেজের অধিকারী নন। কিন্তু রাজনীতিতে শক্ত লবির কারণে হোক বা তার জেদী বা দৃঢ়চিত্ত হ্ওয়ার কারণে হোক বিএনপি‘র কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে তিনি অত্যন্ত পরিচিত এক নেতা। সিলেটের রাজনীতিতে প্রচ- বিতর্ক আছে তাকে নিয়ে। এবং এই বিতর্কটা দলের ভেতরেই বেশি। আর সেকারণেই তার এই নিখোঁজ হবার পর উঠে আসছে সিলেটের আরো দুজন ছাত্রদলনেতার গুম হবার অপ্রকাশিত রহস্যটিও, যারা তার নিখোঁজ হবার মাত্র ষোল দিন আগে নিখোঁজ হয়েছিলেন।
স্বাভাবিকভাবেই যেকোনো সরকারের আমলেই হোক একজন মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব সরকারেরই। এর আগে ঢাকায় নিখোঁজ হওয়া ছাত্রদলনেতাদেরও কোনো হদিস দেখেনি সিলেটের মানুষ। আবার ইলিয়াস নিখোঁজ হবার পর এখনও সরকার কোনো কুল-কিনারা করতে পারছে না এই রহস্যের। জামায়াতে ইসলামীর সাথে বিএনপি‘র সখ্য থাকলেও সিলেটের রাজনীতিতে জামায়াত কোনঠাসা। অনেকেই বলেন তা-ও ইলিয়াসের কারণেই। এসব প্রসঙ্গ ব্রিটেনেও বিভিন্নভাবে উচ্চারিত হচ্ছে। প্রতিদিনই সংবাদমাধ্যমে আসছে সব চটকদার নতুন খবর। এই সংবাদ মাধ্যমগুলোতে কখনো সরকার, কখনো তার দলের অন্তর্দন্দ্ব,কখনো ব্যবসা এইভাবে বিভিন্ন ব্যাপার উঠে আসছে। দলের নেতাদের শধু আন্দোলন-হরতালের ডাক, “তার নেত্রী হয়ত লুকিয়ে রেখেছেন" মর্মে প্রধানমন্ত্রীর করা শিশুসুলভ উক্তি অন্যদিকে র্যাব-পুলিশের ব্যর্থ অভিযান----- সব মিলে ইলিয়াস নিয়ে সৃষ্টি হওয়া ধূ¤্রজাল যেন ক্রমে অন্ধকারের দিকেই পা রাখছে। সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য প্রেসনোট জারি করে বলা হয়েছে, ভিত্তিহীন সংবাদ প্রকাশ/প্রচার করা থেকে বিরত থেকে ইলিয়াস আলীকে খুঁজে বের করার জন্যে, এমনকি বিরোধী দলকেও, সহযোগী হতে আহবান করা হয়েছে। সময়ই বলে দেবে ইলিয়াসের নিখোঁজ হওয়ার আসল রহস্য ।
তার মা-পতœী-সন্তান-ভাই কিংবা দলের কর্মী-নেতার মতো আমরাও প্রতীক্ষায় আছি, কামনা করছি ইলিয়াস ফিরে আসবেন। কিন্তু তার ফিরে আসার পূর্বমুহুর্ত পর্যন্ত যতই উৎকন্ঠা-উদ্বেগ বাংলাদেশ দেখবে, আমাদের বিশ্বাস ততই যেন ইলিয়াস জনপ্রিয় হতে থাকবেন, এমনকি সারা বাংলাদেশে। বিএনপি‘র রাজনীতিতে হয়ে উঠবেন তিনি অপ্রতিরোধ্য একজন, যা তাকে হয়ত করে দেবে সিঁড়ি না ভেঙ্গেই উপরে ওঠার মোক্ষম সুযোগ। এটাও কি দলের ভেতরে ঈর্ষার জ্ম দেবে না ? ইলিয়াস যদি ফিরে আসেন, আমরা আগামীতে তাকে দেখতে চাই তার অতীতের সকল মলিনতা ঘুচিয়ে আবির্ভূত এক নতুন ইলিয়াস আলী হিসেবে।
বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক ডামাডোলই ব্রিটেনে বাজে। এবারেও বাজছে, ভালোভাবেই। বিএনপি‘র একটা শক্ত ভিত আছে ব্রিটেনে। এই ভিতের কারণেই এখানে ইলিয়াস আলীকে নিয়ে প্রতিবাদটা আরও বেশি জোরালো হচ্ছে। অন্যদিকে ইলিয়াসের বাড়ি সিলেটের হবার কারণেও এখানে রাজনৈতিক কর্মী ছাড়াও হরতাল-মিছিল –বিক্ষোবে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো। মানুষের একটা টান তৈরি হয়ে গেছে তার প্রতি। রাজনৈতিক আড্ডায় কিংবা দোকানে, বাংলাদেশি মালিকানাধীন হাজার হাজার রেস্তোরাঁয়। ইলিয়াস প্রসংগে সবাই যেন আবেগতাড়িত। নতুন কমিটি গঠন নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত যুক্তরাজ্য বিএনপি। এ নিয়ে মাত্র ক’দিন আগে তুমুল হাতাহাতি কা- ঘটে গেছে। তাদের প্রকাশ্য চুলোচুলি থামাতে শেষ পর্যন্ত পুলিশ পর্যন্ত ডাকতে হয়েছে। এই বিভক্তরা ইলিয়াস ইস্যু নিয়ে একত্র হতে না পারলেও আলাদা আলাদাভাবে কর্মসূচি পালন করেছে। বিএনপি‘র একটি পক্ষ লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ করেছে। তাদের দাবি, হাইকমিশনের সামনে তাদেও এই বিক্ষোভ স্মরণকালের এক বৃহৎ বিক্ষোভ। এরাই ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিসেও স্মারকলিপি দিয়েছে। এতে তারা বাংলাদেশের সরকার মানবাধিকার লংঘন করছে বলে অভিযোগ এনে ‘গুম’ হওয়া ইলিয়াসকে ফিরিয়ে দিতে ব্রিটেনকে বাঙলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্ঠির জন্যে অনুরোধ করেছে।
আরেকটা গ্রুপ ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে স্মারকলিপি দিয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশি বংশোদ্ভ’ত একমাত্র এমপি রোশনারা আলী সহ আরও দু’একজন এমপি দিয়ে চাপ সৃষ্টির চেষ্ট্ওা লক্ষ্যণীয়।
চাপ দিয়ে কি হবে। সরকার বিভিন্নভাবে বোঝানোর চেষ্টা করছে, এটা তাদের কোনো গোয়েন্দা শাখারই কাজ নয়। আমরাও চাই এটাই যেন সত্যি হয়। একটি গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে এরকম গুম নাটক কেউ প্রত্যাশাও করে না।
সরকারের হাত না থেকে এর পেছনে যদি থেকে থাকে কোনো দলীয় অন্তর্দন্দ্ব, জামায়াত ফ্যাক্টও, ব্যবসা বা লেনদেন জাতীয় কিছু , তাহলে বিদেশি চাপে কি কোনো কাজ হবে বা হলে কতটুকু হবে ? তখনতো সরকার বড়জোর শুধু অপরাধীদেরই ধরতে পারবে। অথচ কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকারও যে ব্যর্থতার চোরাবালিতে হাতড়াতে থাকে, তা কিন্তু হালের একটি ঘটনা থেকেও আমরা উদাহরণ টানতে পারি। সৌদি দূতাবাসের কর্মকর্তার হত্যা-পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকার কম বিব্রত নয়। প্রায় ত্রিশ লাখের মতো বাংলাদেশি সৌদি আরবে কর্মরত। শুধু বন্ধুত্ব বা সুসম্পর্ক টিকিয়ে রাখার দায় থেকেই নয়, বাংলাদেশের একটা গুরুত্বপূর্ণ একটা বড় অর্থনৈতিক কারণেও এই হত্যাকান্ডের একটা সুরাহা করা সরকারের প্রয়োজন। কিন্তু সবকিছু দেখেশুনে মনে হচ্ছে, এখানেও যেন কাজ করছে অন্ধকারের কোনো প্রেতাত্মা গ্রুপ,যে প্রেতাত্মারা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। ইলিয়াস আলীকে গুম করা কি সেই অন্ধকারের প্রেতাত্মাদেরই কোনো কাজ ? সে প্রশ্নটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে।
[email protected]
ফারুক যোশী: যুক্তরাজ্যপ্রবাসী সাংবাদিক ও কলাম লেখক;
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর।