গত ২৫ এপ্রিল বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম এর মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত সৈয়দ ইশতিয়াক রেজার ‘‘সাম্প্রতিক সময়ের টেলিভিশন রিপোর্টিং: কিছু প্রশ্ন” লেখাটিতে হঠাৎই চোখ আটকে যায়। কারণ গুরুর লেখা।
একটু বলে রাখি, এ দেশের প্রথম বেসরকারি টিভি চ্যানেল একুশে টেলিভিশন। আমার প্রথম টেলিভিশন সাংবাদিকতা এর জন্মকাল থেকে। চলে সে টিভির প্রথম দফা অন্ধকার নেমে আসা পর্যন্ত। সেখানে টেলিভিশন সাংবাদিকতার হাতেখড়ির চার গুরুর মধ্যে সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা একজন। আজ অব্দি আছি টেলিভিশন সাংবাদিকতায়। আগেই বলে রাখি ধৃষ্টতা নয়, তাঁর লেখার একটু উদ্বৃতি দিয়েই গুরুর উপলদ্ধি নিয়ে আমার উপলদ্ধি জানানোর চেষ্টা করছি।
‘‘সম্প্রতি সময়ের টেলিভিশন রিপোর্টিং: কিছু প্রশ্ন”- অংশ বিশেষ-
(অনেক কথা শুনেছি। অনেক উপদেশ ছিলো অনেকের দিক থেকে। কিন্তু মিনার মাহমুদের একটি কথা কানে বাজছে এখনো। তিনি বলেছিলেন, ‘‘একজন রিপোর্টারকে তথ্য বের করার জন্য অনেক প্রশ্ন করতে হবে, প্রশ্ন করতে জানতে হবে, যতক্ষণ না নিজের কাছে মনে হবে যে তথ্য সম্পূর্ণ হয়েছে, ততক্ষণ প্রশ্ন করে যেতে হবে। ’’
পশ্চিমা দেশগুলো থেকে প্রকাশিত সাংবাদিকতার অনেক বইতেই পড়েছি রিপোর্টারের অনেক গুণের একটি হলো Should have ability to ask critical questions। এই যে প্রশ্ন তা সাধারণ প্রশ্ন নয়, প্রয়োজনীয় জটিল প্রশ্নও করতে জানতে হবে। )
এ উদ্বৃতির প্রসঙ্গ টেনেই তিনি তাঁর উপলদ্ধিতে বলেছেন সমসমায়িক সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড, সৌদি দূতাবাসের কর্মকর্তা খুন, শিশু মাইশার অপহরণ, ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় সরকার, বিরোধী দল ও বিশিষ্ট জনদের প্রেস ব্রিফিংকারীদের টেলিভিশন রিপোর্টারদের প্রশ্ন করার অদক্ষতা নিয়ে। লেখাটা পড়ে নিজের মনেই প্রশ্ন জাগলো কেন এই অদক্ষতা। উত্তর খুঁজতে থাকলাম। তবে যা খুঁজে পেলাম তা আমার মত করেই।
আমার মনে হয়- যে কোনো ঘটনার গভীরে নামার জন্য চিন্তার গভীরতা ও বাস্তব অভিজ্ঞতা একজন রিপোর্টারের প্রধান নিয়ামক শক্তি। সে প্রিন্ট মিডিয়ারই হোক বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ারই হোক। ঘটনার পেছনের ঘটনা বের করা জন্য রিপোর্টারকে আগে নিজের চিন্তা চেতনায় ঘটনার গভীরে যেতে হয়। তাহলেই তো নানা প্রশ্নের সাথে মূল প্রশ্নটা মাথায় সংরক্ষিত হয়। তারপর তো শুরু হবে তার উত্তর খোঁজার পালা।
এখন টেলিভিশন সংবাদ মাধ্যমগুলোতে ঢাকায় যাঁরা রিপোটিং এর কাজ করছেন তাঁদের বেশিরভাগই টগবগে তরুণ-তরুণী। এরা পুঁথিগত বিদ্যার দিক থেকে অত্যন্ত মেধাবী, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে তাদের অধিকাংশরই বেড়ে ওঠা নির্দিষ্ট একটা গণ্ডির ভেতর। যেখানে নেই তৃণমূল মানুষের সম্পৃক্ততা, সমাজকর্ম, রাজনীতি ও বাস্তবের ঘাত প্রতিঘাতের সাথে পথচলার অভিজ্ঞতা। যার ফলে তাদের বাস্তব জ্ঞানের পরিধিটাও অনেক ছোট। চিন্তার গভীরতাটাও কম। অনেকেই বাস্তবের ঘাত প্রতিঘাতে সাহসী হয়নি বলেই পাল্টা চ্যালেঞ্জের ভয়ে জটিল প্রশ্ন করা থেকে থাকে নিশ্চুপ। কেউবা তাঁর টিভি কর্তৃপক্ষের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে দৃষ্টি মিলিয়ে প্রশ্ন করতে বাধ্য হন। অতীত পর্যবেক্ষণে বিপদের সময় কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতার উদাহরণ চোখের সামনে ভেসে এলে অনেকেই তখন সাহসী হয়ে ঝামেলায় জড়াতে চান না। সব মিলিয়ে এ প্রজন্মের তরুণ-তরুণী রিপোর্টারদের বেশিরভাগই পেশাগত ও সামাজিক দায়বোধের তুলনায় চাকুরীজীবী হিসেবে প্রকট আত্ম মানসিকতায় নিজেদের গড়ে তুলেছেন।
এ অবসরে অন্য পিঠের কথা বললে, বলতে হয় টেলিভিশনের নিউজ রুমের যাঁরা এ তরুণ-তরুণী রিপোর্টারদের পরিচর্যা করেন তাঁদের কথা। তাঁদের ক’জনই চাঞ্চল্যকর অথবা রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রীয় ঘটনার সম্প্রচারিত রিপোর্টে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বক্তব্য নিয়ে পরবর্তী সময়ে মূল্যায়ন করেন? কি ধরণের প্রশ্ন করে কি তথ্য বের করে আনা উচিৎ ছিল। ভবিষ্যতে এমন ঘটনা ঘটলে এ ধরণের প্রশ্ন করবে --এমন উপদেশ দেন? অথবা রিপোর্টার অ্যাসাইনমেন্টে যাওয়ার সময় কখনও কি বলা হয় এমন তথ্য বের করার চেষ্টা করবে। আসলে টেলিভিশনের হাউজগুলোতে এমন অভিবাবকের সংখ্যাও এখন অনেক কম। হয়তো ব্যস্ততার জন্য নয়তো স্রেফ অবহেলা। আগামীর জন্য এ প্রজন্মের রিপোর্টারদের গড়ে তোলার ব্যাপারে তাঁদের অনেকে যে গড়ার চেষ্টা করছেন না, ঠিক তা-ও নয়। কেউ কেউ হয়তো করছেনও।
টেলিভিশন হাউজগুলোর অভিভাবকদের প্রতি সবিনয় অনুরোধ করছি চৌকস রিপোর্টার গড়ে তুলুন। যাঁদের প্রশ্নবানে তটস্থ থাকবে সমাজের অপকর্মের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা তথাকথিত সজ্জন ব্যক্তিরা। যারা যুগে যুগে ক্যামেরার সামনে আসেন পক্ষ নিয়ে। কারণ আগামীর সুন্দর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে মিডিয়াকেই প্রধান ভূমিকা রাখতে হবে।
আমার লেখাটা পড়ে অনেকের মনে হতে পারে আমি কারো কারো ব্যক্তিত্বের প্রতি আঘাত হেনেছি। তা মোটেই নয়। আমি কাউকে আঘাতের জন্য লিখিনি। আমি লেখকও নই। আমি আমার গুরুর সাথে উপলদ্ধি বিনিময় করেছি মাত্র।
বখতেয়ার মুন্না, ইনচার্জ, ব্যুরো অফিস, ফেনী, সময় টেলিভিশন
email: [email protected]
বাংলাদেশ সময় ১১৪৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৭, ২০১২