আমরা একটু পিছনে ফিরে তাকাই। এই ধরুন দশ বছর পেছনে, ২০০১ সালের দিকে।
তারপর নির্বাচন এলো, বাধ্য হয়েই, জনগণের প্রবল চাপে। পশ্চিমা “চাপ-গোষ্ঠি” (প্রেশার গ্রুপ) সম্পর্কে একটি কথা এখানে বলে রাখতে চাই। তারা সব সময়ই সংশ্লিষ্ট দেশের হাওয়ার গতি বোঝার চেষ্টা করে, যদি তারা দেখে, যে হাওয়া বইছে সে হাওয়ায় জনসমর্থন রয়েছে তবে তারাও সে হাওয়ায় পাল তুলে দেয়। বেশিরভাগ সময়ই তারা হাওয়া চিনতে ভুল করে, একথাও সত্য। কিন্তু তারপরও নিজেদের দেশের উদার চাপ-সম্প্রদায়ের কথা ভেবেই তারা দেশে দেশে জনগণ-সমর্থিত হাওয়ার প্রতি সমর্থন দেয়। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। একারণে ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে তৎকালীন সেনা সমর্থিত ও বিশ্বব্যাংক নিয়ন্ত্রিত সরকার একটি সুষ্ঠু সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই বিএনপি-জামায়াত জোট সেই নির্বাচনে নিরঙ্কুশ পরাজয় বরণ করেছিল। কারণ জনমনে তাদের দুষ্কর্মের স্মৃতি তখনও জ্বলজ্বলে। আর এও সত্য যে, বাঙালির কোমল হৃদয় সব সময়ই নিপীড়িতের প্রতি সহানুভূতিশীল। আওয়ামী লীগ তখন জোট সরকারের রোষপীড়িত এবং ২১ আগস্টের মতো ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার শিকার হওয়া রাজনৈতিক দল। স্বাভাবিকভাবেই সে সময় আওয়ামী লীগ ছিল জনগণের প্রাণের দল এবং নির্বাচনে তার প্রমাণ পাওয়া গেলো নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের ভেতর দিয়ে।
আবারও সেই আশা-র কথা বলতে হয়। মানুষ আশা করে দিন বদলের। আওয়ামী লীগ এই স্বপ্নই মানুষকে দেখিয়েছিল। কিন্তু স্বপ্ন প্রথম হোঁচট খেলো সরকারের ক্ষমতায় আসার পর পরই সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের কর্মকান্ডে। তারপর ক্রমশঃ স্বপ্নভঙ্গের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকলো। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা জরুরি। তাহলো বাংলাদেশের মতো একটি দুর্বল অর্থনীতির দেশে যে কোনো সরকারের পক্ষেই জনগণকে রাতারাতি সবকিছু দিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। মানুষ আশা করতেই পারে এবং সেটাই স্বাভাবিক কিন্তু সেই স্বাভাবিক স্বপ্ন পূরণ খুব সহজ নয়। রয়েছে হাজারো প্রতিবন্ধকতা। কিন্তু এই প্রতিবন্ধকতা থেকে বেরুনোর সবচেয়ে বড় উপায়, আমার মতে সদিচ্ছা। সরকারের যদি সদিচ্ছা থাকে তাহলে খুব দ্রুত না হলেও ক্রমশঃ জনগণের স্বপ্ন পূরণে ব্রতী হতে পারে।
আমরা ভেবে দেখতে পারি যে, জনগণ আসলে কী চায়? প্রাথমিক বিচারে জনগণ আসলে তার মৌলিক চাহিদা পূরণে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ দেখতে চায়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার এই জায়গায় কিছুটা সফলতার প্রমাণ দিয়েছে। মানুষের মৌলিক চাহিদা বিশেষ করে খাদ্য নিরাপত্তা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপ দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। এমনিতেই বাংলাদেশে বস্ত্র-মূল্য পৃথিবীর অন্য অনেক দেশের তুলনায় কম। এক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা কতোটুকু সে বিশ্লেষণে আমি যাবো না, কিন্তু গৃহায়নের মতো মৌলিক সুবিধা দেয়ার প্রশ্নেও সরকারের ভূমিকার প্রশংসা করতেই হবে।
হ্যাঁ, একথা সত্য যে, সরকার তার প্রতিশ্রুত পরিমাণ বিদ্যুৎ দিতে পারেনি, পারেনি দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার অবকাঠামোতে সম্যক উন্নয়ন ঘটিয়ে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা নিশ্চিত করতে। বিশেষ করে শহুরে নাগরিক জীবনের সুবিধা সরকার নিশ্চিত করতে পারেনি। এখানেও সরকারের সীমাবদ্ধতা সব সরকারের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য কিন্তু আবারও সেই সদিচ্ছার প্রশ্নটি উল্লেখ করতে হচ্ছে। আমাদের কাছে এমন কোনো ব্যারোমিটার নেই যার থেকে আমরা বলতে পারি যে, কোনো সরকারের সদিচ্ছার সূচক কেমন? তবে বিগত দু‘বছরের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে একথা জোর দিয়েই বলা যায় যে, সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে নাগরিক জীবনযাত্রাকে সহজ করার জন্য। কিন্তু সেসব বাস্তবায়িত হতে কেন দেরি হচ্ছে সে প্রশ্ন করার সময় এসেছে। আর এই প্রশ্নের সঙ্গেই সম্পূরক প্রশ্ন হলো, তাহলে বর্তমান সরকার কি কেবল “স্বপ্ন দেখানো” সরকার? তারা কেবল স্বপ্নের কথা বলে কিন্তু সেসব বাস্তবায়নে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয় না? এ রকমটি কেউ ভাবলে তাকে দোষ দেয়া যাবে কি?
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার সম্পর্কে একটি স্বাভাবিক ধারণা হচ্ছে, এখানে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা কারোরই নেই। এমনকি সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী-এমপি পর্যন্ত একথা বলে থাকেন যে, তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। সিদ্ধান্ত আসে একটি মাত্র জায়গা থেকে। যদি এটাই সত্য হয়ে থাকে তাহলে নিশ্চিতভাবেই দুঃশ্চিন্তার বিষয়। কারণ বাংলাদেশ এখন আর সত্তর বা আশির দশকে নেই। দেশের অর্থনীতি বিশাল আকার নিয়েছে এবং দেশের জনসংখ্যার আয়তনও বিশাল। এমতাবস্থায় ক্ষমতার বিকেন্দ্রিকরণ-নেটওয়ার্ক যতো বিস্তারিত হবে ততোই মঙ্গল। এটি একটি স্বাভাবিক কথা মাত্র।
আমার ধারণা অনেকেই আমার সঙ্গে একমত হবেন যে, বর্তমান সরকারের সবচেয়ে বড় দুর্বলতার জায়গা হচ্ছে, নিয়ন্ত্রনহীন আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি। এক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা সত্যিই চোখে পড়ার মতো এবং সাধারণ মানুষ বিশেষ করে নাগরিক জীবন সবচেয়ে বড় ভ’ক্তভোগী। মানুষ চড়া দামে নিত্যপণ্য কিনতে তবু প্রস্তুত, কিন্তু বিনা দোষে দুষ্কৃতকারীর হাতে প্রাণ হারাতে কে প্রস্তুত বলুন? আমি নিশ্চিত যে, আওয়ামী লীগ শাসনামলের এই ব্যর্থতাই মানুষকে স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় আহত করে চলেছে সবচেয়ে বেশি। জননিরাপত্তা এখন মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম মৌলিক উপাত্ত, একে উপেক্ষা করে বেশিদূর যে এগুনো যায় না তার প্রমাণ বিএনপি-জামায়াত জোটের আমল। যখন দেশে কয়েকটি সমান্তরাল সরকার কার্যকর ছিল এবং একেক জায়গা থেকে একেক রকম পৃষ্ঠপোষকতায় একটি বিশাল সন্ত্রাস-স্বপ্নরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, মানুষ তখন প্রার্থনা করতো এ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য। বর্তমান সরকার হয়তো দোষ চাপানোর চেষ্টা করবে অন্য পক্ষের ওপর, তাতে ব্যর্থতা ঢাকবে না, বরং অক্ষমতাই প্রকাশ পাবে।
আগেই বলেছি, আমরা সব সময়ই আশা করি, যেদিনটি চলে গেলো সেদিনটির চেয়ে যে দিনটি আসছে সেদিনটি যেনো খুউব ভালো হয়। বাংলাদেশেও বিগত দিনগুলির দিকে তাকিয়ে আমরা ভাবি, সামনের দিনগুলি যেনো ভালো হয়। সে কারণে এ দেশে নির্বাচনে বিকল্প খোঁজার প্রবণতা অনেক বেশি দেখা যায় অন্য অনেক দেশের চেয়ে। দেশে নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে কিন্তু আমার বিশ্বাস সব প্রশ্নের শেষে একটি নির্বাচন অবশ্যই হবে। সেক্ষেত্রে মানুষ বিকল্প খুঁজতে চাইবে, একথাও সত্য। প্রশ্ন হলো, সে পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দল মানুষকে আশাভঙ্গের বেদনাঘন পরিবেশ থেকে কতোটা মুক্ত করতে সক্ষম হবে? মানুষ আশাহত--এই চরম সত্য মেনে নিয়ে মানুষকে আশাবাদী করার কাজটি শুরুর সময় এখনই। কারণ আশাহত মানুষ বিকল্প হিসেবে প্রত্যাখ্যাতদের বেছে নিতেও দ্বিধা করবে না। কিন্তু প্রত্যাখ্যাতরা যে চরম প্রতিশোধপরায়ণ হয় সে-ও নির্মম সত্য; বাংলাদেশের মানুষ যেন সেই নির্মমতার নতুন শিকার না হয় তা-ও নিশ্চিত করা জরুরি।
লেখক: সম্পাদক, একপক্ষ।
[email protected]
সম্পাদনা:জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর