বুধবার রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র রেজওয়ানুল ইসলাম সানি হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায় হলো। সবার আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটল এই রায়ে।
২০১০ সালের ৪ জানুয়ারি অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের আক্রমণে খুন হয়েছিল সানি। হত্যাকাণ্ডের পর সানির বাবা সুষ্ঠু বিচার চেয়ে মামলা করেছিলেন। গত বুধবার দুপুরে রাজশাহীর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক একরামুল হক চৌধুরী এ মামলার রায় ঘোষণা করলে বুক থেকে একটা স্বস্তির নি:শ্বাস বেরিয়ে এসেছিল। রায়ে রাজশাহী পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি নিজাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম তুষারকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। তুষার এখনো পলাতক রয়েছে। এছাড়াও আরো পাঁচজনকে যাবজ্জীবন ও ৩ জনকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। ছাত্রলীগ কর্মী ওহিদুজ্জামান বাবু, মেসবাউর রহিম সুমন, খালেছুর রহমান রোকন, জাহিদুল ইসলাম ও কৌশিকুর রহমান অনিককে যাবজ্জীবন এবং উজ্জ্বল, মাসুম ও আব্দুল মতিনকে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় এই মামলার আসামি শরিফুল ইসলাম, নাজমুল হুদা নবীন ও নাহিদ সারোয়ারকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়। যদিও খালাস পাওয়া এই তিনজনকে সানির ওপর হামলার ঘটনার পরপরই দায়িত্ব পালনরত পুলিশ কনস্টেবল শহিদুল ইসলাম ও আশরাফ আলী ঘটনাস্থল থেকে আটক করেছিলেন। যাই হোক, ঘটনার মূল নায়ক যারা তারা সবাই শাস্তি পেয়েছেন, এতেই আমি সন্তষ্ট। কারণ, এরা একেকজন শুধু সন্ত্রাসীই নন, কসাইও বটে।
শোকের পাশাপাশি অন্য রকম এক আনন্দ হচ্ছে। এই বিচার পাওয়ার লগ্নে বারবার সানির হাসি মাখা চেহারাটা চোখে ভাসছে। ভাল লাগছে, তার পরিবারের সদস্যদের সন্তষ্টিভরা মুখগুলো কল্পনা করে। খুশি লাগছে, তার সহপাঠীরা এই বিচারের রায় জানতে পেরেছে বলে। কারণ, বর্তমান সরকারের আমলে প্রথমবারের মত কোনো ছাত্র হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায় দেয়া হলো।
রাজশাহী পলেটেকনিক ইনস্টিটিউটের অদূরেই রেলগেট। আমরা কয়েকজন বন্ধু রেলগেটে নিয়মিতই আড্ডা দিতাম। আমাদের সাথে আড্ডায় অংশ নিতেন খুসবু ভাই। খুসবু ভাই আমার এক বছরের বড় হলেও আমরা একই স্কুলে পড়াশুনা করার সুবাদে এবং প্রতিবেশী হওয়ায় সম্পর্কটা বন্ধুর মতই। পলেটেকনিক শাখা ছাত্রমৈত্রীর সভাপতি কাজি মোতালেব হোসেন জুয়েল এবং খুসবু ভাই রুমমেট ছিলেন। তাদের রুমে নিয়মিত আসা যাওয়া ছিল। রেজওয়ানুল ইসলাম সানি খুসবু ভাইদের রুমে আসতো মাঝে মাঝে। সেই সুবাদেই পরিচয়, অতঃপর ঘনিষ্ঠতা।
দুই ভাই এক বোনের মধ্যে সানি দ্বিতীয়। বাবা মনোয়ার হোসেন, মা শাহিন মনোয়ার। সানি মিশুক প্রকৃতির ছিল। সানি সবার সাথেই মিশতো, মানুষকে আপন করে নেওয়ার সহজাত গুণ ছিল তার। এজন্য তাকে আমার খুব ভাল লাগত। ২০১০ সালের ৪ জানুয়ারি`অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় সানির মৃত্যুর দু`দিন আগে নগরীর বালিয়া পুকুর এলাকায় একদিন দেখা, চায়ের স্টলে অনেকক্ষণ গল্প হলো তার সঙ্গে। একাডেমিক ছুটি থাকায় এর পরদিনই আমি চলে আসি চাঁপাইনবাবগঞ্জে। সানির সঙ্গে সেটাই ছিল শেষ দেখা, শেষ কথা। এরপরে সানির খুন হওয়ার খবর শুনে আমি হতবাক হয়ে পড়ি। লাশ দেখতে গিয়েছিলাম, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কিন্তু সানির লাশ নিয়ে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। যুবলীগ ছাত্রলীগ এলাকায় ত্রাসের সৃষ্টি করে লাশ ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে।
ঐদিন ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা হাসপাতালের ভেতর ককটেল বিস্ফোরণ করলে রোগীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। নিরাপত্তার স্বার্থে চিকিৎসকরা অপারেশন থিয়েটারের বাইরে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর হাসপাতাল চত্বরেই ছাত্রমৈত্রী নেতাকর্মীদের ওপর আবার চড়াও হয়েছিল যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতারা। এসময় পুলিশ লাঠিপেটা করে সংঘর্ষে জড়িতদের ছত্রভঙ্গ করে। হাসপাতাল চত্বরে ছাত্রমৈত্রী ও ছাত্রলীগ-যুবলীগ কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ এবং পুলিশের লাঠিপেটায় অনেকেই আহত হয়েছিলেন সেদিন।
এখানে একটা বিতর্কের বিষয় যে, সানিকে ছাত্রমৈত্রী নেতা বলা হচ্ছে। গত ৪ জানুয়ারি সানির দ্বিতীয় মৃত্যবার্ষিকীতে রাজশাহী নগরীতে সানির ছবি সম্বলিত পোস্টার ছেপেছিল ছাত্রমৈত্রী। সে কখনও ছাত্রমৈত্রী করত বলে আমি শুনিনি। সে নিজেও কখনও আমাকে বলেনি। তার বাবা মনোয়ার হোসেন নগরের মতিহার থানা আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক এবং মা শাহীন মনোয়ার রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভানেত্রী। পারিবার রাজনীতির সাথে জড়ালেও সে নিজে কখনও রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না। ঐ সময় আমি ব্যক্তিগতভাবে অন্য একটি বাম ছাত্র সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলাম। সেটা সানি জানত। কিন্তু রাজনৈতিক বিষয়ে আলোচনায় সানির কখনই কোনো আগ্রহ দেখিনি। সে সবসময়ই ঝামেলামুক্ত থাকতে চাইত। কোনো প্রকার রাজনীতিতে জড়াতে চাইত না।
অবাক করার মতো ব্যাপার হলেও একথা সত্য যে, সানির মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি করে ছাত্রলীগ এবং ছাত্রমৈত্রী। উভয় ছাত্র সংগঠনই তাকে নিজেদের নেতা বলে প্রচার করে আসছিল। ছাত্রমৈত্রী তাকে পলিটেকনিক শাখার সহ-সভাপতি বলে দাবি করেছিল। যদিও সে সময়ে সানির সহপাঠী ও স্থানীয় বন্ধুদের কাছ থেকে জেনেছিলাম, সে কোনোদিন ছাত্ররাজনীতিতে জড়িত ছিল না। ঐ সময় মিডিয়াতেও এই তথ্যটি প্রকাশ হয়েছিল। তবে এটা সত্য যে, সানি এবং তৎকালীন ছাত্রমৈত্রীর ইনষ্টিটিউট সভাপতি জুয়েল দু`জন খুব ভাল বন্ধু ছিল। সানির এক ঘনিষ্ঠ সহপাঠীর মতে, রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্যই ছাত্রমৈত্রী সানিকে নিজেদের নেতা বলে পরিচয় দেয়।
নিহত ব্যক্তিকে নিজেদের কর্মী বলে মিথ্যা পরিচয় দেয়া এবং সেটার মাধ্যমে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা কোনোভাবেই কাম্য নয়। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই অপকর্মটি স্থায়ীভাবে আসন গেড়েছে। গতবছর চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মহিউদ্দিন নিহত হলে ছাত্রশিবির ও ছাত্রলীগ উভয়ই তাকে নিজেদের কর্মী বলে দাবি করে। অথচ সে এদুটির কোনোটিরই কর্মী ছিল না। তার পরিবারও দাবি করে যে, সে কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না। অতীতে লাশ নিয়ে এই ধরনের ঘৃণ্য রাজনীতি করেছে ছাত্রলীগ-শিবির-ছাত্রদল। ছাত্রমৈত্রীর মত প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনও যদি সেই অপরাজনীতিকে অনুসরণ করে তবে সেটা হবে দুঃখজনক।
যে কোনো হত্যাকাণ্ডেরই বিচার হওয়া উচিত এবং বিচারের রায়ের দ্রুত বাস্তবায়নটাও সমান জরুরি। বিচার না হওয়ায় বা বিলম্বিত হবার কারণেই যে শুধু বিচারের বাণী কাঁদে এমন নয়, রায় কার্যকর না হলে বা বিলম্বিত হলেও বিচারের বাণী কাঁদে। এমন অনেক মামলার রায় আছে, যা কার্যকর হয়নি। স্বাধীনতার পর থেকে যেসব জঘন্য অপরাধ হয়েছে সব ক`টিরই বিচার করতে হবে। সকল ছাত্রহত্যার বিচার করতে হবে। অনেক মামলা আছে যেগুলোর চার্জশিটও দেয়া হয়নি আজ পর্যন্ত। আবার এমন অনেক মামলা আছে যেগুলোর চার্জশিট দেয়া হলেও বিচারে অগ্রগতি নেই। বর্তমান সরকারের আমলে ঢাবি ছাত্র আবু বকর, রাবি ছাত্র ফারুক-নোমানী, চবি ছাত্র মহিউদ্দিন হত্যা মামলা আলোর মুখ দেখেনি।
গত জানুয়ারিতে সানি হত্যা মামলার স্থগিতাদেশ চেয়ে আপিল করেছিল মামলার আসামি পক্ষ। আদালত ঐ আপিল খারিজ করে দিয়েছিল। বুধবার রায় হওয়ার পর আমি এখনও নিশ্চিন্ত নই যে, এই রায় আদৌ কার্যকর করা হবে কিনা। কারণ, এখনও হাইকোর্টে আপিল করার সুযোগ রয়েছে। সম্ভবত বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যেখানে কুখ্যাত সন্ত্রাসীদের দণ্ডও রাষ্ট্রপতি মওকুফ করে দেন। তবু আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, এই হত্যাকাণ্ডের জড়িত সন্ত্রাসীরা যেন কোনোভাবেই দণ্ড মাফ না পায়।
বন্ধু সানি, তোকে আজ খুব মনে পড়ছে। স্মৃতির মণিকোঠায় জ্বলজ্বল করছিস তুই। তোর হাস্যোজ্জ্বল মুখখানা যতবার মনে পড়ে, ততবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলি। আজ একটা কথাই বারবার বলতে ইচ্ছে করছে, দোস্ত, তোকে আমরা বাঁচাতে পারিনি ঠিকই, তবে তোর ঘাতকদের বিচার করতে পেরেছি আমরা। যেখানেই থাকিস, ভাল থাকিস।
লেখক: কবি ও ব্লগার
[email protected]
বাংলাদেশ সময় : ১১০০ ঘণ্টা, ১৭ মে, ২০১২
সম্পাদনা : আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর
[email protected];
জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর
[email protected]