জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিবিরোধী আন্দোলন সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত বিষয়গুলোর একটি। দীর্ঘ সাড়ে চার মাস আন্দোলনের পর অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবীরের পদত্যাগের মধ্য দিয়ে এ আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটলো।
দীর্ঘদিন ধরে জাহাঙ্গীরনগরে ভিসিবিরোধী আন্দোলনের কারণে সর্ব মহলে এমন এক অসন্তুষ্টির পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিলো যে,শরীফ এনামুল কবীরের বিদায় ছাড়া অন্য কোনো সমাধানের পথ আর ছিলো না।
তিনি অনেক উন্নয়নকাজ পরিচালনা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি সুন্দর গেট নির্মাণসহ কয়েকটি লাল ইটের গাঁথুনি বাড়িয়েছেন, কোনো সংঘর্ষ হলেই বহিষ্কার করেছেন, সেশন জট কমিয়েছেন এবং নতুন অনেক ডিপার্টমেন্ট খোলাসহ অনেক ভালো কাজই তিনি করেছেন।
অপরদিকে অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ, ক্যাম্পাসের পরিবেশ ধ্বংস করা, ছাত্র রাজনীতিকে ধ্বংস করে ভিসিলীগ গঠন, সাংবাদিকদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করা, সন্ত্রাসীদের প্রশ্রয় দেয়া ইত্যাদি কাজের মধ্য দিয়ে শরীফ এনামুল কবীর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশকে বিষিয়ে তুলেছিলেন। তার বিরোধিতার আরেকটি বড় কারণ হলো, তার যখন কোনো প্রয়োজন হতো তখন সকল দাবি মেনে নেবার আশ্বাস দিতেন। বিভিন্ন ব্যক্তিকে নিয়োগসহ নানান সুবিধা দেবার প্রতিশ্রুতি দিতেন কিন্তু কোনো কথাই তিনি পরে আর মনে রাখতেন না যা তার সমালোচকদের উস্কে দিয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যই ভিসির পদত্যাগকে স্বাগত জানিয়েছে। সন্ধ্যার পর ক্যাম্পাসে আনন্দ-উল্লাস হয়েছে, অনেকে একে অপরকে মিষ্টিও খাইয়েছেন। ফেসবুক, ব্লগ ইত্যাদি সামাজিক যোগাযোগ সাইটগুলোতে আনন্দের বন্যা বইছে। ভিসিপন্থি যারা ছিলেন তারা অবশ্য চুপ থাকার চেষ্টা করছেন। তাদের দু একজনের সাথে যোগাযোগ করে জানতে পারলাম যে তারাও খুশি হয়েছেন। তারাও বিশ্বাস করতেন যে ভিসির পদত্যাগ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। কিন্তু তাদের খুশি হবার কারণ হলো নতুন ভিসি জাহাঙ্গীরনগরের বাইরে থেকে আসছেন। এতে অবশ্য খুশি হতে পারেনি ভিসিবিরোধী শিক্ষক সমাজ।
অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভিসি ধার করে আনার কারণে শুধু শিক্ষক সমাজ নয়, জাহাঙ্গীরনগরের কেউই আসলে খুশি হতে পারেনি। বিশ্ববিদ্যলয়ের ৩৩ তম ব্যাচের ছাত্র ওমর ফারুক সুজন ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন: “কি লজ্জা!!! জাবির ভিসি হওয়ার মতো কোনো নির্ভরযোগ্য জাবি শিক্ষক আচার্য মহোদয় খুঁজে পেলেন না। অবশেষে অন্য যায়গা থেকে হাওলাত করতে হলো। এ লজ্জা আমাদের দুধ-কলায় লালিত ভিসিলীগের? নাকি ক্ষমতাশীল শিক্ষক মণ্ডলীর। ” এরকম মতামত হাজারো শিক্ষার্থীর।
জাহাঙ্গীরনগর নতুন কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নয় যে, অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপককে নিয়ে সেখানে ভিসি হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে। অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভিসি ধার করার মাধ্যমে মূলত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে অপমান করা হলো। জাহাঙ্গীরনগরে ভিসি হবার মত অসংখ্য শিক্ষক রয়েছেন যারা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন। শিক্ষকদের কোনো পক্ষই তাকে স্বাগত জানায় নি। কেউ বিরোধিতা করছেন আর কেউ বাধ্য হয়ে চুপ থাকছেন।
জাহাঙ্গীরনগরকে এড়িয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেন ভিসি নিয়ে আসা হলো তার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণের প্রথমটি হলো প্রধানমন্ত্রীর কাছে অত্যন্ত প্রভাবশালী শরীফ এনামুল কবীরের অনুরোধ। জাহাঙ্গীরনগর থেকে কাউকে ভিসি হিসেবে নিয়োগ দিলে শরীফ এনামুল কবীরকে অত্যন্ত চাপের মুখে থাকতে হত। সেক্ষেত্রে বাইরে থেকে ভিসি নিয়োগ দেবার ফলে নতুন ভিসি তার উপর খবরদারি করবেন না বরং তার পরামর্শ নিয়েই ক্ষমতা চালাবেন। দ্বিতীয়ত, জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষকদের দলাদলির কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামীপন্থি কোনো শিক্ষককেই পরিপূর্ণ আস্থায় আনতে পারেননি। তৃতীয়ত, বিভিন্ন রাজনৈতিক কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনকে একটি বড় পোস্ট দিয়ে সেখান থেকে সরানোর খুব প্রয়োজন ছিলো।
উল্লেখ্য, সম্প্রতি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন সাহেব আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক সাহেবের বিরুদ্ধে ভিসি নির্বাচনের দাবিদারদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।
এখন দেখার বিষয় হলো অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন জাহাঙ্গীরনগরকে সুষ্ঠভাবে চালাতে পারেন কিনা। জাহাঙ্গীরনগরের সাথে তার ওঠাবসা হয়েছে খুব কম। জাহাঙ্গীরনগরের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ সম্পর্কে তিনি ভালো ধারণা রাখেন বলেও মনে হয় না। এমনকি গত সাড়ে চার মাসের আন্দোলনের সময়ে কোনো পক্ষেই তার কোনো ধরণের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। জাহাঙ্গীরনগরে বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে যে বৈরিতা তৈরি হয়েছে তিনি তা সঠিকভাবে সমাধানের দিকে নিতে পারবেন কি? যারা ভিসি-পদ প্রত্যাশী ছিলেন তারা কেউই খুশি নন। অপরদিকে আন্দোলনকারী শিক্ষকরা চুপ থাকলেও তারা আসলে মেনে নিতে পারছেন না। তাহলে জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষকদের সহযোগিতা তিনি কিভাবে পাবেন? সাধারণ ছাত্ররাও নিজেদের ক্যাম্পাসে অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা একজনের খবরদারি মেনে নেবে কিনা সেব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তাছাড়া যেকোনো অপছন্দনীয় ইস্যুতে জাহাঙ্গীরনগরের ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলনে নেমে পড়ার ঐতিহ্যবাহী প্রবণতাও ভাবনার বিষয়।
নতুন ভিসি আসাতে ছাত্রলীগের বাইরের গ্রুপ ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছে। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগও এবার মূলধারার ছাত্রলীগকে প্রবেশ করানোর চেষ্টা চালাবে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের পরিচয় দেয়ার মতো কেউ থাকবে না এটা তারাও সম্ভবত আর মেনে নিতে চাইবে না। আবার সাংস্কৃতিক জোটের নেতাদের মারার অপরাধে ভেতরের গ্রুপের নেতারাও সব অপরাধী। এদের বিচার করার দায়িত্ব নতুন ভিসির। তার কাছে সাংস্কৃতিক কর্মীদের প্রথম দাবিও সেটি। সুতরাং ছাত্র রাজনীতি নিয়েও নানামুখি চাপ তাকে সহ্য করতে হবে। শরীফ এনামুল কবীর তার প্রশাসনে কোনো যোগ্য লোককে ঠাঁই দেননি। অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন কি তার প্রশাসনে সেই সেট আপ রাখবেন? নাকি পরিবর্তন করবেন? ভিসি হবার খবর প্রকাশের পর এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন ’৭৩-এর অধ্যাদেশ অনুযায়ী তিনি প্রশাসন চালাবেন। ’৭৩-এর অধ্যাদেশ অনুযায়ী অস্থায়ী ভিসি নিয়োগের ৪৫দিনের মধ্যেই ভিসি নির্বাচন দিতে হবে। তিনি কি আদৌ নির্বাচন দেবেন!
সর্বোপরি তিনি যদি সব পক্ষের সহায়তা পাবার পরিবেশ তৈরি করতে পারেন এবং অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সমস্যাগুলো বুঝে সেসবের সমাধান করতে পারেন তাহলে হয়তো তিনি একজন যোগ্য ভিসি হিসেবে পরিচিতি পাবেন। শরীফ এনামুল কবীর বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে বিভাজন তৈরি করেছেন, বিভাজন জিইয়ে রেখেছেন এবং কিছু মানুষকে বাড়তি সুবিধা দিয়ে সবসময় কাছে রেখেছেন। এদের পরামর্শ নিয়ে তিনি বিরাট একটি পক্ষকে শত্রু বানিয়ে ফেলেছেন। আশা করছি, অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন তা থেকে বেরিয়ে এসে সত্যিকার অর্থে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে ভূমিকা পালন করবেন।
লেখক: এম ফিল গবেষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
e-mail: [email protected]
বাংলাদেশ সময় : ১২৪৬ ঘণ্টা, ১৯ মে, ২০১২
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর
[email protected]