পুলিশের হাতে একের পর এক সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় দেশের গোটা সাংবাদিক সমাজ যখন প্রতিবাদে সোচ্চার, তখন খোদ জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে লাগানো হয়েছে সাংবাদিক নির্মূলের উস্কানিমূলক ব্যানার!
যেখানে দেশের সর্বোচ্চ আদালত এসব ঘটনাকে আমলে নিয়ে সংশ্লিষ্টদের তলব করেছেন, খোদ পুলিশ হেডকোয়ার্টারে বৈঠক করে সাংবাদিক-মিডিয়ার সঙ্গে সংঘাতে না যেতে পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, ঠিক তখনই এ ধরনের উস্কানিমূলক ব্যানার কারা লাগাচ্ছে, তা খুঁজে বের করার দায়িত্ব কিন্তু পুলিশের, সরকারের। কিন্তু তারা তা পালন করছে কী? এ ধরনের আত্মঘাতী উস্কানি মিডিয়া-পুলিশ তথা সরকারের সম্পর্ককে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, তা কী সংশ্লিষ্টরা একবারও ভেবে দেখেছেন?
বারাক ওবামা, জুলিয়া গিলার্ড থেকে শুরু করে সারা দুনিয়াতে রাজনৈতিক নেতৃ্ত্ব ও সরকার মিডিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করে চলে।
আর বাংলাদেশে যেন উল্টো, আজব এক পরিস্থিতি! মিডিয়া সাপোর্ট যেন এ সরকারের আর দরকার নেই! ‘আমাদের বিটিভি-বিটিভি ওয়ার্ল্ড-বিএসএস আছে, এগুলোই এনাফ! আর কোনো মিডিয়া সাপোর্ট দরকার নেই!, এমন যদি মনে করা হয়, তাহলে সেটাওতো ঘোষণা দিয়ে বলা যায়। আমরা এসব নিয়ে কান্নাকাটি বা কারও হাতেপায়ে ধরার চেষ্টা করতে যাবো না। ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সারাদিন-রাত নানা সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনে ভরা থাকে! তাদের সাপোর্ট ছাড়া অথবা অগোচরে এমন ব্যানার লেগেছে, তা-ও কী বিশ্বাস করতে বলা হবে?
ঢাকার রাজপথে প্রকাশ্য দিবালোকে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় সাংবাদিকদের পুলিশ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকার অদ্ভুত একটি পরামর্শ দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু! এসব আস্কারা পুলিশ কোথা থেকে পায় তা কী তলিয়ে দেখার চেষ্টা হয়েছে? মণিপুর স্কুলে যখন এমপি কামাল আহমেদ মজুমদারের নেতৃ্ত্বে একজন নারী সাংবাদিকের গায়ে হাত তোলা হয়, সে ঘটনার কী কোনো আইনানুগ প্রতিকার করা হয়েছিল?
সর্বশেষ আগারগাঁও’র মহিলা পলিটেকনিকের সামনে বিনা উস্কানিতে তিনজন ফটো সাংবাদিককে গরু-ছাগলের মতো পিটিয়ে মাটিতে শুইয়ে দেওয়া হলো, কোর্ট পুলিশের হাতে এক তরুণীর শ্লীলতাহানির চেষ্টার ঘটনার খোঁজ নিতে গিয়ে মার খেলেন আইনজীবীদের সঙ্গে তিনজন কোর্ট রিপোর্টার, তখন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বললেন, এসব পরিস্থিতিতে পুলিশ থেকে দূরে থাকতে?
সারা জীবন দেখলাম-জানলাম ঘটনার সময় পুলিশের নিরাপত্তা বেষ্টনির কাছাকাছি থেকে সাংবাদিক-ফটো সাংবাদিকরা তথ্য ও ছবি সংগ্রহ করেন। বিদেশে সাংবাদিকরা এর জন্যে এসব পরিস্থিতিতে ‘প্রেস’ লেখা সবুজ অথবা কমলা রঙের সেফটি ভেস্টও ব্যবহার করেন। আর আমাদের ডেপুটি পুলিশ মন্ত্রী বলছেন, পুলিশ থেকে দূরে থাকতে!
এ নিয়ে দেশের সাংবাদিক সমাজ ভীতসন্ত্রস্ত প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন উল্টো মিডিয়াকে দোষ দিয়ে বলেছেন, প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যকে মিডিয়া ‘টুইস্ট’ করেছে তথা ‘বিকৃত’ করে ছেপেছে ও প্রচার করেছে!
জীবনে এই প্রথম এমপি কাম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়ে গেছেন আমাদের এই সাহারা বু’! দীর্ঘদিন তিনি রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রামে ছিলেন, আগামীতেও হয়তো সেখানে ফিরে যাবেন। কিন্তু এসব পরিস্থিতিতে একজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কীভাবে কথা বলেন অথবা তাকে কীভাবে কথা বলতে হয়, তা কী তিনি কখনো তার পূর্বসূরী আওয়ামী লীগ সম্পাদক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের কাছেও তালিম নিতে পারতেন না? মিডিয়ার সঙ্গে কী চমৎকার সম্পর্ক ছিল মোহাম্মদ নাসিমের বা এখনও আছে, তা দেখেশুনে চললে তার নিজের আর সরকারের ভালো হতো না?
উল্টো তিনি যে একবারের ফুল মন্ত্রিত্ব পেয়েই কখনো ব্যারিস্টার রফিকের মতো দেশের অন্যতম শীর্ষ আইনজীবী, কখনো মিডিয়াকে তালিম দিয়ে চলেছেন, এসবের পরিণতি তাকে আর সরকারকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, তা কী ভেবে দেখার চেষ্টা করেছেন কখনো?
এর আগে একবার বিগত তত্ত্বাবধায়ক আমলে শেখ হাসিনার কারাবাসের সময়কার প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিকুল হককে কিছুদিন আগে আইন দেখে কথা বলতে বলেছিলেন সাহারা খাতুন! আর ব্যারিস্টার রফিক রসিক জবাবে বলেছিলেন, সাহারা খাতুন সারাজীবন আইন দেখাদেখি নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলেন যে, নিজে বিয়ে করারও সময় পাননি। দেশের আইন আদালতে ব্যারিস্টার রফিক আর অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের অবস্থান সবাই জানেন।
সাহারা খাতুনেরও তাই আর সে বক্তব্যের জবাব দেবার পথ ছিলনা। এখন বক্তব্য পক্ষে না গেলে রাজনীতিকদের অভ্যাস, ‘আমি এভাবে বলিনি বা মিডিয়া বিকৃত করেছে’, এভাবে নসিহত করলে কিন্তু ভবিষ্যতে সাংবাদিক নেতাদের তার চায়ের দাওয়াত রক্ষা করতে যাওয়াও আর সম্ভব হবে না! এমনিতে সাগর-রুনি ইস্যুতে একবার মন্ত্রীর বাসার চা খেয়ে আন্দোলনে ঢিলা দিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েছেন সাংবাদিক নেতারা! সাগর-রুনি খুনের রহস্য উদঘাটনে তার ৪৮ ঘণ্টার সময়সীমার ২৮ হাজার ঘণ্টার বেশি পেরিয়ে গেলেও কোনো কিছুরই কূলকিনারা করতে পারেন নি! এসব নিয়ে তার বিন্দুমাত্র লজ্জাও হয় না?
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য বুধবার সংসদে এনেছিলেন স্বতন্ত্র সদস্য ফয়জুল আজিম। ‘স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সাংবাদিকদের সঙ্গে রসিকতা করে কথাটি বলেছেন’ আর স্বতন্ত্র সদস্যের পয়েন্ট অর্ডার বিধিসম্মত হয়নি বলে তাকে থামিয়েছেন আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিম! ডেপুটি স্পিকার কর্নেল (অবঃ) শওকত আলীও তার মাইক বন্ধ করে দিয়েছেন! আমাদের নেতারা প্রায় সময় সংসদকে সব আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু করতে বলেন, আর ইস্যুটি নিজেদের পছন্দের না হলে তেমন আলোচনা থামিয়েও দেন! শেখ ফজলুল করিম সেলিম এক সময় দৈনিক বাংলার বাণী, সাপ্তাহিক সিনেমা নামের দুটি পত্রিকা চালাতেন।
মিডিয়ার সাবেক একজন মানুষ হিসাবে কতিপয় উচ্ছৃংখল পুলিশের আচরণকে কেন্দ্র করে সরকার আর মিডিয়ার সম্পর্ক যে মুখোমুখি অবস্থায় দাঁড়িয়েছে, তা তিনি কী বিধিসম্মত কোন নোটিশের মাধ্যমে সংসদে নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিতে পারতেন না? না এসব বিষয়ে চোখ বন্ধ করে থাকলে প্রলয় বন্ধ হবে বা থাকবে? নাকি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে সাংবাদিকদের শ্যালক-দুলাভাই’র রসিকতার সম্পর্ক? প্রেসক্লাবের সামনে লাগানো ব্যানারে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ঢালাও যে সব অভিযোগ করা হয়েছে, সে সব নিয়ে আমি নিজেও বিভিন্ন সময়ে লিখেছি, আগামীতেও লিখবো।
কিন্তু এখন পুলিশের পোশাকে থাকা কতিপয় দুর্বৃত্তকে শায়েস্তা করার কাজটা এড়িয়ে উল্টো সাংবাদিক নির্মূলের আওয়াজ তোলার মানে কী? মিডিয়া-পুলিশ-সরকারের মুখোমুখি এ অবস্থার অবসানের উদ্যোগতো সরকারেরই নেওয়ার কথা। এখনও কী সে চেষ্টা কোথাও কেউ দেখেছে? পার্লামেন্টে সুযোগ পেয়ে সে উদ্যোগটিও নিলেন না শেখ সেলিম! তার ছেলে শেখ ফাহিম দায়িত্ব পেয়েছেন সাহারা মাতৃভূমি গ্রুপের বাংলাদেশের পরিচালকের । শুধু সরকারের জন্যে নয়, শেখ সেলিমের ছেলের এই দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালনেও কিন্তু দেশের মিডিয়ার সাপোর্ট লাগবে, এ বিষয়টিও যেন তিনি বা তারা ভুলে না যান।
ফজলুল বারী, সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময়: ১০৩০ঘণ্টা, মে ৩১, ২০১২
সম্পাদনা: নূরনবী সিদ্দিক সুইন, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর [email protected]