গেঁয়ো যোগী যেমন ভিখ পায় না তেমনি গেঁয়ো ঠাকুর পেন্নাম পায় না। আমরা স্বগোত্রীয়কে প্রণাম করতে হীনমন্যতায় ভুগি।
হুমায়ূনের মতো লেখককে আমাদের দেশের সাহিত্যসেবী ছ’ টাকার লিটলম্যাগ সম্পাদক, কাঁধে ব্যাগবাহী, ভারী শব্দের লেখকগণ কখনো ঐপন্যাসিকই মনে করেন নি। তারা শুধুমাত্র সুনীল, সমরেশকে ঐপন্যাসিক জ্ঞান করেন। বাংলাদেশে সুনীল, সমরেশ এলে তারা পদধুলি নিতে লাইন ধরেন। অথচ সুনীল বলেন- ‘হুমায়ূন আমার চেয়ে অনেক ভালো লেখক। সে শরৎচন্দ্রের জনপ্রিয়তাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। ’ উপন্যাস লিখে শরৎচন্দ্র জীবদ্দশায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। বাংলা সাহিত্যে হুমায়ূনের আগে তিনিই ছিলেন জনপ্রিয়তম সাহিত্যিক।
শুধু কাঁধে ব্যাগ ঝোলানো লেখকগণ কলকাতার লেখকদের পীরজ্ঞান করতেন না, কলকাতার লেখকগণও বাংলাদেশের তুলনায় নিজেদের অতি উচ্চস্তরের সাহিত্যিক বলে মনে করতেন। তারা মনে করতেন তাদের রচিত নাটক, উপন্যাস, বাংলাদেশের নাটক, উপন্যাসের তুলনায় উত্তম। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদই প্রথম এই ধারনা ভেঙ্গে দেন। শুধু বাংলাদেশিদের মননে নয়, কলকাতার লেখকদের বিশ্বাসেও তিনি আঘাত করেন। হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তার ধাক্কা যখন কলকাতার দেয়ালে আঘাত করে জ্যোতির্ময় দত্ত তার ব্যাথায় কোঁকাতে কোঁকাতে কলকাতার ম্যাগাজিন ‘টেলিভিশন’ এপ্রিল ১৯৮৯ সংখ্যায় তিনি লিখেছিলেন-
“ঢাকার রাস্তাঘাট কলকাতার চেয়েও চওড়া এবং মসৃন হবে এটা মানা যায়। ঢাকা কি একটা যেমন তেমন শহর। ঢাকা একটি স্বাধীন রাজ্যের রাজধানী। যেখানে একজন রাষ্ট্রপতি আছেন, প্রধানমন্ত্রী আছেন, আছে নিজস্ব যোজনা-কমিশন এবং মহানগর উন্নয়ন সংস্থা। কলকাতার প্রয়োজন দিল্লীর প্রায়োরিটি লিস্টের খুবই নিচের দিকে। বাংলাদেশে ঢাকাই হচ্ছে টপ। কিন্তু ঢাকা কলকাতার চেয়ে এগিয়ে যাবে নাটকে, কবিতায়, টিভি সিরিয়ালে... এতে ভয়ানক আঘাত লাগে। এটা মানা যায় না। অথচ সত্য তা’ই। ”
১৯৮৯ সালে হুমায়ূন আহমেদের বহুব্রীহি নাটকটি খুব জনপ্রিয় হয়। তার ধাক্কা সইতে না পেরে এই মন্তব্য করেন তিনি। তিনি আরো লিখেছিলেন-
“চ্যানেল ঘুরালেই মন ভালো করে দেয় বাংলাদেশের নাটক। বাংলাদেশ নাটকের স্ট্যান্ডার্ডই আলাদা। যেমন স্ক্রিপ্ট তেমন গল্প তেমনি অভিনয়। কলকাতার প্রযোজকদের উচিত বাংলাদেশে গিয়ে কিভাবে নাটক প্রযোজনা করতে হয় সে ব্যাপারে কয়েকমাস ট্রেইনিং নেয়া। ” - টেলিভিশন, এপ্রিল ১৯৮৯, কলকাতা
তখন বই মেলার মানেও ছিল কলকাতার লেখক (যদিও কলকাতার বই মেলায় বাংলাদেশী লেখকরা উপেক্ষিত সবসময়, তবু আমরা খুশি)। আমাদের ঔপনিবেশিক শাসনে গড়ে উঠা হীনমন্যতায় আত্মবিশ্বাসে গুনে ধরা পদলেহনের বৃত্ত থেকে আমরা তখনও বেরুতে পারিনি। তখনও ঢাকার বইমেলায় তাদের পদধুলি আমরা সার্টিফিকেট হিসেবে ধরে নিতাম। প্রকাশকরা তাঁদের ভাগ্য বিধাতা বলে মানতেন। হুমায়ুন এই বৃত্ত ভাঙেন। তিনি একাই টেনে ধরেন প্রকাশনা শিল্পের হাল। ১৯৯৩ সালে সমরেশ মজুমদার হুমায়ুনের বই বিক্রি পরিমান শুনে থ মেরে যান। ঢাকা বই মেলায় হুমায়ুনের বই বিক্রির হাল দেখে কলকাতায় গিয়ে “দেশ” পত্রিকায় ২৫শে সেপ্টেম্বর ১৯৯৩ সংখ্যায় লিখেছেন-
“৮৭ সালে সচিত্র সন্ধানী সম্পাদক একুশে বই মেলায় আমার সঙ্গে একটি রোগা খাটো চেহারার ছেলের আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। সে সময় মেলার সম্পাদক মেলার পাঠকদের সম্পর্কে তেমন আগ্রহী হতে দেখিনি। কিন্তু ওর নম্র ব্যবহার আর উজ্জল চোখের কথা ভুলিনি। ৯৩ এর একুশের বইমেলা চেহারায় বিশাল। মানুষের ভিতরে হাটতে হয়েছে গুটিগুটি। মাইকে ঘোষণা হয়েছিল যারা হুমায়ূন আহমেদের সই সংগ্রহ করতে চান তারা ওর জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় এসে লাইন দিক। গেলাম সেখানে। এতো বড় লাইন শুধু স্বাক্ষর সংগ্রহের জন্য হতে পারে তা আমার কল্পনার বাইরে। শুনলাম আগে হুমায়ূন স্টলে বসে সই দিতেন। কিন্তু ভীড়ের চাপ প্রবল হওয়ায় কর্তৃপক্ষ এই ব্যবস্থা করেছেন। যে প্রকাশক আমার সঙ্গে ছিলেন তিনি আফসোস করেছিলেন। জানেন? এবারের বই মেলায় একটুর জন্য হুমায়ূনের বই পেলাম না। মাত্র চারটি বই লিখেছেন। আর সেই চারটি বই প্রকাশক দশ লক্ষ টাকা আগাম দিয়ে নিয়ে গেছে। কথাটি শুনে আমি স্তম্ভিত। বলে কি লোকটা! চারটি বইয়ের জন্য দশ লক্ষ টাকা আগাম! কী বই, কতো মোটা, কী পরিমান বিক্রি হয়? ভদ্রলোক দু তিনটি বই এনে দেখালেন। পঞ্চাশ থেকে আশি পাতার বই। ত্রিশ থেকে চল্লিশ টাকার মধ্যে দাম। যদি একজন লেখক কুড়ি পার্সেন্ট রয়েলেটি পান তাহলে কতো কপি বিক্রি হলে দশ লক্ষ টাকা উঠবে। শুনলাম, প্রথম সপ্তাহে ওর প্রতিটি বই প্রায় কুড়ি হাজার বিক্রি হয়েছে !”
এই হচ্ছেন হুমায়ূন আহমেদ। আমাদের দেশের “নিজের দু’কপি বইও বিক্রি না হওয়া সাহিত্যসেবী”গণ যাদের সাহিত্যদেব ভাবেন, তাদের উদ্দেশ্যে কিছু ভিন্ন ভিন্ন সময়ের মন্তব্য তুলে ধরলাম মাত্র। যা হোক হুমায়ূন আহমেদকে মহান করে দেখানোর জন্য নতুন করে সার্টিফিকেটের প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। তবু এই বেলায় অনেকের লেখা পড়ছি। গিলছি। যারা হুমায়ূনকে লেখকই মনে করেন নি, তারাও আজ পত্রিকায় নিজের দুটো লেখা ছাপার অক্ষরে দেখার জন্য হুমায়ূন নিয়ে লিখছেন।
হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুতে আমার এক ভার্সিটি পড়ুয়া ছোট ভাইয়ের একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস উদ্ধৃত করে লেখা শেষ করছি- “আজ কোন সাহিত্য-সুশীলের শোক করার দরকার নেই। এ শোক আমাদের। আজ শুধু আমরা আনাড়ি পাঠকরা মাতম করব। ”
লেখক: ব্লগার ও ব্যাংক কর্মকর্তা।
[email protected]
এমএমকে- [email protected]