ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

শাহবাগ: লন্ডন থেকে সংহতি

জাবির আল মাহমুদ, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৯, ২০১৩
শাহবাগ: লন্ডন থেকে সংহতি

লন্ডন থেকে:  আমাদের দেশে তরুণদের মাঝে মূলত দু’টি ধরন আছে। সক্রিয় আর নিষ্ক্রিয়।

সক্রিয়তে আবার দুই ধরন, স্বাধীনতার পক্ষে সরব বা নীরব। আরেক পক্ষ কারা বুঝতেই পারছেন।

৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩; ২৬ মাঘ, ১৪১৯ শুক্রবার। দিন হিসেবে হয়ত খুবই সাধারণ। কিন্তু বাংলাদেশি হিসেবে আজ বড় গর্বের দিন। শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরের (গণজাগরণ মঞ্চ বলছেন অনেকে) সঙ্গে এক হয়ে এই সুদূর প্রবাসে গলা মিলিয়েছিলেন শত শত মানুষ।

যেখানে ঘণ্টা মানেই পাউন্ড রোজগার, সেখানে একটি দিন যারা উ‍ৎসর্গ করেছেন তাদের অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে শ্রদ্ধা জানানোর ভাষাও আমার জানা নেই। এই সক্রিয় মানুষগুলো কারা? এই মানুষগুলো আপনি, আমি, আমরা। আমরা টাকা কেনো কোনো স্বার্থের জন্যেই কাজ করছি না। আমাদের একটাই লক্ষ্য, লাখো শহীদের রক্তের বাংলায় রাজাকারদের ঠাঁই নাই।
 
এবার আসি লন্ডনের আলতাফ আলি পার্কে। যেখানে আমি দেখেছি জামায়াত-শিবিরের ঘেরাওয়ের ভেতর থেকেও সাহসী মানুষের স্লোগান। চার দিক থেকে জামায়াতের কর্ডনের ভেতরে থেকেও যারা প্রতি মুহূর্তে চিৎকার করে স্লোগান দিচ্ছিলেন, “তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা”, “একাত্তরের হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার”, “ক-তে কাদের মোল্লা, তুই রাজাকার তুই রাজাকার”, “পাকিস্তানের দালালেরা, হুঁশিয়ার সাবধান। ” কী ভয়হীন সেই সব মুখ। মাঝে মাঝেই জাতীয় সঙ্গীত গায়ে ‌উদ্দীপ্ত করা হচ্ছিলো সবাইকে।

মানুষের সবচেয়ে স্পর্শকাতর জায়গা হচ্ছে ধর্ম আর দেশ। এসব লোক ধর্মব্যবহার করে দেশের ১২টা বাজাবে, সেটা এই তারুণ্য মেনে নেয়নি। এরা মনে করেন, ’৭১-এর ইতিহাস মানুষ ভুলে গেছে। ভুলে গেছে এই দেশের তরুণেরা যখন জেগে ওঠে তখন পৃথিবীর ভয়ংকরতম সেনাবাহিনীও তাদের নৃশংসতা দিয়ে আটকাতে পারেনি, আর এরা কোন ছার!
 
এদিক-ওদিক যখন ছোটাছুটি করছিলাম তখন আয়োজকদের মাঝে এক বোনকে দেখ মনে হয়েছিল তিনি যেন এটাই প্রমাণ দিচ্ছেন বঙ্গ ললনারা যেমন মায়ের মমতায় পরম আদরে সবাইকে জড়িয়ে রাখেন, তেমনি দরকার হলে শক্ত হাতে লাগামও ধরতে জানেন। প্রতিবাদে মুখর হতে পারেন।

জামায়াতিদের কাছে শুরু থেকেই মাইক ছিল, ওদের মাইকের আওয়াজও আমাদের গলার আওয়াজকে হারাতে পারেনি। একের পর এক স্লোগান দিয়েই গিয়েছে আমার ভাইয়েরা। শুধু ভাইয়েরা না আমার বোনেরাও সমান তালেই গলা মিলিয়েছেন।

লন্ডনে আলতাফ আলী পার্কে এসেছিলেন আমাদের বাবারা, মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম, এসেছিলেন আমাদের ভাইয়েরা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও শহীদ জননী জাহানারা ইমামের জ্বালানো অগ্নিশিখা নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন আমাদের পাশে। তিন প্রজন্ম এক হয়ে একটাই দাবির কথা ঘোষণা করছিলেন, “রাজাকারদের ফাঁসি চাই। ”

যখন লোক বেড়ে গেলো একটাই যাতে স্লোগান হয় তাই মাইক কেনা হবে। সঙ্গে সঙ্গে চাঁদা উঠিয়ে আমার ভাইয়েরা মাইক কিনে এনেছেন। সর্বস্ব উজাড় করে একটাই দাবি সবার কাছে মুখ্য আর বাকি সব গৌণ।
 
অবশেষে সন্ধ্যায় যখন সমাবেশের দাবিতে পুলিশ তথাকথিত জামায়াতিদের সরিয়ে দেয়, শহীদ মিনার থেকে তখন আমাদের চূড়ান্ত জয় অর্জন হয়। তাদের এতো পয়সা খরচ, এতো কিছুর পেছনে অনেক বড় একটা উদ্দেশ্য ছিল আমাদের শহীদ মিনারে যেতে না দেওয়া। সে লক্ষ্যে তারা শহীদ মিনারে জুতা পরে উঠে দখলও নিয়ে রেখেছিল। কিন্তু হায়! ঠিকই আমরা তাদের স্বপ্নকে ধুলিস্যাৎ করে পূর্বপুরুষদের মতই জয় করে নিয়েছি আমাদের লক্ষ্য। তাদের সামনেই এরপর শহীদ মিনারে শান্তিপূর্ণভাবে ফুল দেওয়া হয়। বক্তব্য রাখা হয়। গাওয়া হয় দেশের গান। তারাও তাদের পূর্বপুরুষের মতই পরাজয় মানতে পারে না। ডেকে আনে তাদের শিবির পান্ডাদের। সমাবেশ শেষ হওয়ার পর চোরাগুপ্তা হামলা চালায় আমাদের এই ভাইয়ের উপর বোতল মারে। মারধর করে। সবই পুলিশের সামনে হলেও কেনো তারা নীরব ছিল তা আমি বুঝিনি!!!

এই পান্ডারা যখন আমাদের বোনেদের-মায়েদের গালাগাল করতে তেড়ে আসে, ঠিকই রুখে দাঁড়ায় তৌফিক নামের এক অকুতোভয় তরুণ। যাকে পরে একা পেয়ে ধরে নিয়ে মারধরও করেছে এরা। কিন্তু এদের কি ধারণা এতে আমাদের রুখতে পারবে? আজকে শান্তিপূর্ণ সমাবেশেই তাদের এতো পেরেশানি একবারও কি ভেবেছে আমরা যদি আঘাত হানি তখন তাদের কী হবে?
 
এবারও আমরাই জয়ী হবো। যে দেশের মাটি এতো অকুতোভয়, নির্ভীক, দৃঢ় সন্তান জন্ম দেয় সে দেশের আদর্শের মৃত্যু হয় না।

সব সময় নিজের ভেতর একটা হতাশা কাজ করতো, কী হচ্ছে দেশে বা কী হবে। খুবই হতাশ লাগতো। কিন্তু না, সেসবই চলে গেছে। আমার চোখে নতুন করে স্বপ্ন এঁকে দিয়েছে আমার এই ভাই বোনেরা। আজ আমি তাদের নিয়েই নতুন আশায় বুক বাধি।

যে দেশের সন্তানেরা দেশের জন্যে এভাবে লড়তে পারে তাদের কেউ আটকাতে পারবে না । কোনো ভাবেই আটকাতে পারবে না । আর নিষ্ক্রিয়দের বলি। জেগে ওঠো ভাইয়েরা আমার। প্লিজ। একটা বার কি ভেবে দেখেছো আমরা কাদের জন্যে কিসের জন্যে আন্দোলন করছি? যদি বলো “ ইটস নট মাই বিজনেস” তবে বলব জেগে ওঠো।

আমরা যদি কোনো কারণে কোনো ভাবে হেরে যাই, এর পরেই তোমাদের পালা। ওই পশুদের কাছে কারো জন্যেই ভালবাসা নেই। দয়া নেই, মায়া নেই।

আমার সহযোদ্ধা ভাইয়েরা সাহস হারিয়ো না। জয় আমাদের হবেই। কারণ আমরা ন্যায়ের পথে, সত্যের পথে। ‘৭১ –এ ওরা আমাদের বিজয় আটকাতে পারে নি, এখনো পারবে না। শুধু সাহস রেখো, ভরসা রেখো পাশের ভাইটি বা বোনটির উপর।

লেখক: ব্রিটেন প্রবাসী

বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৯, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।