২৭ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার সময়টি পেরিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরেই রাত আরও ঘনিয়ে আসবে।
একটু আগেই ফেইসবুকে ঢুকলাম। দেখলাম প্রিয় ছোটভাই সাংবাদিক শরিফুল হাসানের একটি পোস্ট। রক্তাক্ত হুমায়ুন আজাদকে ধরে সেকি উদ্বেগের চেহারা হাসানের। সঙ্গে একটি নোট এরকম: “হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে আমার জীবনের একটি ঘটনা আছে। আছে একটি ছবি। রক্তাত্ব হুমায়ুন আজাদকে জড়িয়ে ধরে আছি আমি। এটি ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির ঘটনা। সেদিন জনপ্রিয় লেখক হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলা চালিয়েচিলো জঙ্গিরা। লিখবো লিখবো করেও কখোনো লেখা হয়নি ঘটনাটা। সবসময় মনে হয়েছে, মানুষকে জানিয়ে লাভ কি? তারপরেও ২০০৯ সালের আগস্টে প্রথম ব্লগেই লিখি ঘটনাটা। সেটিই রিপোস্ট। ”
দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় সামহোয়্যারইনব্লগ-এ হাসানের সেই পোস্টটি দ্রুত পড়ে ফেললাম। মনে হলো বাংলানিউজেও প্রকাশিত হতে পারে পোস্টটি। হোক না চার বছরের পুরোনো। হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলার ঘটনা তো আর পাল্টায়নি। আরও পাল্টায়নি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট।
শরিফুল হাসান বর্তমানে দৈনিক প্রথম আলোর সিনিয়র রিপোর্টার। হাসানকে ফোন দিয়ে ওর অনুমতি চাইলাম লেখাটি প্রকাশ করার। ও বললো দেওয়া যেতে পারে, তবে সোর্স হিসাবে সামহোয়্যারইনব্লগের কথা উল্লেখ করতে হবে। দ্রুত সামহোয়্যারইনব্লগ থেকে “স্মৃতিতে হুমায়ুন আজাদ: হাসপাতাল এবং পরবর্তী ঘটনাগুলো...” শিরোনামের লেখাটি তুলে নিলাম। সেটি হুবহু প্রকাশ করা হলো বাংলানিউজের পাঠকের জন্য। তবে অবশ্যই সামহোয়্যারইনব্লগের সৌজন্যে।
- মাহমুদ মেনন, হেড অব নিউজ, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
লেখাটি এরকম:
স্মৃতিতে হুমায়ুন আজাদ: হাসপাতাল এবং পরবর্তী ঘটনাগুলো...
আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের (ডিইউএফএস) সদস্য। আমার বিশ্ববিদ্যালয় মানেই তখন এই সংগঠন। ক্লাস শেষ করেই কলা ভবন থেকে ছুটে যাই টিএসসিতে। সেখানেই আড্ডা, সেখান থেকে খেতে যাওয়া, আবার ফিরে আসা। রাতে এখান থেকে নয়টা সাড়ে নয়টা কখনো কখনো ১০ টায় হলে ফিরি।
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৪। তখন শীতকাল। বইমেলা চলছে। টিএসসি জমজমাট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন একটি গানের উৎসব হবে। টিএসসির নিচে তার মহড়া চলছে। গিটারে গান। আমি বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে সেই গান শুনছি। রাত আটটা থেকে নয়টার মধ্যে। হঠাৎ একটি বোমা ফাটার মতো শব্দ হলো। মাঝারি ধরনের শব্দ। আমার আবার সব কিছুতেই ব্যাপাক কৌতুহল। খুব সাহসী আমি সেটি বলবো না, তবে ভয় ডর নেই এটুকু বলতে পারি।
তো কোথা থেকে এলো সেই শব্দ সেটি জানতে আমি টিএসসি থেকে হাঁটা শুরু করলাম বাংলা একাডেমির দিকে। রাস্তার মাঝে যে ডিভাইডার আমি সেটি ধরে আনমনে হাঁটছি। মনে হলো সোহরাওয়াদী উদ্যান দিয়ে কেউ দৌড়ে পালাচ্ছে। একটু দূরে যেতেই দেখি এক জায়গায় জটলা। গেলাম সেখানে। দেখলাম চাঁর-পাঁচজন পুলিশ সদস্য, কিছু লোক সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সামনে পড়ে আঝছ রক্তাত্ব একটি দেহ। কিন্তু কেউ ধরছে না। বরং সবাই যেন তামাশা দেখছে। কিংবা হয়তো ঝামেলার ভয়।
আমি দ্রুত সেখানে গিয়ে উপুড় হওয়া লোকটিকে তুললাম। রক্তে ভেজা। মুখ দেখে চিৎকার করে উঠি এ তো হুমায়ুন আজাদ। আমি যখন স্যারকে তুলি স্যারের এক পাশের গাল দুই ভাগ হয়ে দুদিকে চলে গিয়েছিলো। পুরো মুখটা পুরো হা হয়ে ছিল। আমি দুই পাশে চাপ দিয়ে জোড়া লাগানোর চেষ্টা করলাম।
হুমায়ুন আজাদকে আমি সামনাসামনি আগে কখনো দেখি নাই। কিন্তু তাঁর অনেক বই পড়েছি। আমার স্কুলের এক ইংরেজি শিক্ষক যে আমাকে মানুষ হওয়ার দীক্ষা দিয়েছিল তাঁর কাছ থেকে জেনেছি হুমায়ুন আজাদ সম্পর্কে। অনেক বই পড়েছি আজাদ স্যারের। ব্যাক কাভারের সেই ছবি আর সেই চুল দেখে তাই স্যারকে চিনতে পারলাম।
মূল ঘটনায় ফিরি। স্যারকে হাসপাতালে নিতে হবে। কি করবো? আমি আমার মোবাইল ফোন থেকে একটি ফোন করলাম বিটু ভাইকে। বললাম-বিটু ভাই, হুমায়ুন আজাদকে বোমা মারছে। আপনি বাংলা একাডমেরি সামনে আসেন। বিটু ভাই তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যায় চলচ্চিত্র সংসদের অর্থ সম্পাদক এবং আমাদের খুব ঘনিষ্ঠ বড় ভাই। (আমি তখন ভেবেছিলাম স্যারকে বোমা মারা হয়েছে। আসলে তা নয়, তাকে কোপানো হয়েছিল। দুস্কৃতিকারীরা পরে পালানোর সময় বোমা ফাটায়)
বিটু ভাইকে ফোন করে আমি রক্তাত্ব হুমায়ুন আজাদকে হাপাতালে নেওয়ার জন্য একটি রিকশায় উঠানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু রিকশায় উঠানো সম্ভব হলো না।
স্যারকে কোনভাবেই রিকশায় রাখতে পারছিলাম না। আমি তখন দৌড়ে টিএসসির দিকে আসলাম। সাদা একটি প্রাইভেট কার এদিকেই আসছিলো। আমি তাকে বললাম ভাই আমাদের এক স্যার হুমাযুন আজাদকে কেউ বোমা মেরেছে। হাসপাতালে নিতে হবে। একটু আসেন। সে কিছুতেই রাজি হলো না। বরং গাড়ি ঘুরিয়ে উল্টো দিকে চলে গেলো। আমি কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এদিক ওদিক তাকিয়ে কোন দিশা পাচ্ছিলাম না। ছটফট করছিলাম।
হঠাৎ অন্য বুদ্ধি আসে। দেখি পুলিশের বিশাল এক ট্রাক দাঁড়িয়ে টিএসসির সামনে। আমি তখন চিৎকার দিয়ে তাদের বললাম ভাই স্যারকে হাসপাতালে নিতে হবে। আমি এখানকার ছাত্র। প্লিজ আপনাদের গাড়িটা নিয়ে আসেন। একই সঙ্গে আমি হুমকিও দিলাম। বললাম স্যারকে হাসপাতালে না নিতে পারলে ছাত্ররা আপনাদের ওপর খেপবে। চেচামেচি করলাম। এক পর্যায়ে পুলিশ সদস্যরা রাজি হলো। তারা এলো গাড়ি নিয়ে। লোকজনের সহায়তায় আমি স্যারকে পুলিশের সেই ট্রাকে তুললাম। স্যারকে গাড়িতে তুলতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। কারণ শরীরের ওপর তার কোন নিয়ন্ত্রন ছিলো না।
এদিকে স্যারকে আমি ট্রাকে উঠনোর আগেই সেখানে হাজির হলো সাংবাদিক পাভেল ভাই। (সে বোধহয় নিউ নেশন বা কোন একটা ইংরেজি কাগজে কাজ করতো। মাঝে মাঝে আমাদের সংগঠনে আসতো। তাই তাকে চিনতাম। ) স্যারকে পড়ে থাকা অবসস্থা থেকে উঠানোর সময় থেকে পাভেল ভাই তাঁর ক্যামেরা দিয়ে একের পর এক ছবি তুলছে স্যারের সঙ্গে আমার। যখন ট্রাকে উঠাচ্ছিলাম তখনো ছবি তুলছে। আমি তখনন তাকে গালি দিয়ে বলছি, পাভেল ভাই এখন ছবি তোলার সময়? [পরে বুঝেছিলাম সে তার কাজ করেছে। তাঁর তোলা এই ছবিগুলোই পরের দিন সব ফটো সাংবাদিকরা নেয়। পরে সিআইডিও তার ছবিগুলো নিয়েছিল এবং তাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করেছিল। ]
যাই হোক আমি স্যারকে পুলিশের ট্রাকে তুললাম অনেক কষ্টে। কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এতো ভীড়, চেচাচেমি, আমি খুব অস্থির বোধ করছি। পরিচিত কাউকে খুঁজছিলাম। পুলিশের ট্রাক ছাড়ার আগে আমি দেখলাম আমার পাশে বিটু ভাই আছে। চরম স্বস্তি বোধ করলাম। যাক চেনাপরিচিত কেউ আছে।
ট্রাকের মধ্যে স্যারকে জড়িয়ে ধরে আছি। ট্রাক চলছে। স্যারের হা করা মুখ দিয়ে আমি রাস্তা দেখছি। স্যার আমাকে জিঞ্জাসা করলো বাবা আমাকে কই নিয়ে যাও? আমি বললাম স্যার হাসপাতালে। আপনার কিছু হয়নি। স্যার বললো আমার চশমা কই? আমি বললাম স্যার আছ। স্যার বললো আমি পুলিশের গাড়িতে যাবো না। আমি বললাম ঠিক আছে স্যার আমরা নেমে যাবো এখুনি।
আহত রক্তাক্ত অবস্থায় আমি কোন মানুষকে এতো শক্ত থাকতে দেখিনি। অন্য কেউ হলে এতো ব্যাথা নিয়ে চিৎকার করতো। ভয় পেতো, কিন্তু স্যার খুব শক্ত দৃড় চিত্তে বসে আছে; যেন কেউ ভুল করে তাকে কুপিয়ে গেছে। বিষয়টি নিয়ে তিনি যেন খুব কষ্ট পেয়েছেন। আমি আজো স্যারের সেই শক্ত মুখ মনে করতে পারি।
যাই হোক ট্রাক চলছে। আমরা যাচ্ছি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। বাংলা একাডেমি থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ গেলে দোয়েল চত্ত্বর পেরিয়ে সোজা চলে গেলেই হয়। কিন্তু পুলিশের ভ্যান দোয়েল চত্ত্বর হয়ে অবার ডানে স্টেডিয়ামের দিকে চলে গেলো। আমি চিৎকার করলাম। পুলিশকে বললাম ভাই আপনারা ঢাকা মেডিকেল চেনেন না? পুলিশের এই সময় নষ্টে মেজাজ খারাপ হলো। ট্রাক ঘুরে শহীদ মিনার হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরী বিভাগের সামনে গিয়ে থামলো। আমি আর বিটু ভাই অনেক কষ্টে স্যারকে নামালাম ট্রাক থেকে। জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলাম।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরী বিভাগে যে কোন রুগীর জন্য পাঁচ টাকা দিয়ে স্লিপ কাটতে হয়। সেটা কাটলাম। এরপর স্যারকে নিয়ে ট্রলিতে করে রওয়ানা দিলাম সম্ভবত ৩২ নম্বর ওয়ার্ডে। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসককে বললাম উনি আমাদের স্যার। ডাক্তার স্লিপ চাইলো। আমি স্লিপ বের করতে গিয়ে দেখি সেটি রক্তে ভিজে গেছে। কান্না পেল। ডাক্তার আবারো স্লিপ আনতে বললেন। ছুটলাম আবার। এরপর শুরু হলো স্যারের চিকিৎসা। আমরা স্যারের হাত পো জোরে ধরে আছি। রক্ত থামানোর চেষ্টা চলছে।
ইতিমধ্যে ডাক্তাররা প্রাথমিক কিছু ওষুধ আনতে বললো। আমি আর বিটু ভাই নিজেদের টাকায় সেই অসুধ আনালাম। এরপর দেখি আমাদের টাকা শেষ। ছাত্র মানুষ। কতো টাকাই বা আমাদের পকেটে থাকে। যাই হোক, আমরা সেখানে থাকা এক পুলিশ কর্মকর্তাকে বললম এই অসুধগুলো আনার ব্যবস্থা করতে। আমাদের টাকা নেই। তিনি তাই করলেন।
এদিকে স্যারের চিকিৎসা শুরু হওয়ার পরপরই আমি মোবাইলে শুভকে বললাম ঢাকা মেডিকেল আয়। শুভ আসলো। (শুভ মানে আমার বন্ধু। ও তখন প্রথম আলোর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক) এরপর শুভ, তখনকার ভিসি ফায়েজ স্যারসহ আরো অনেকেই আসলো। আমাদের চলচ্চিত্র সংসদের বড় ভাইরাও আসলো। সবাই বললেন, আমি যনে এখন হলে গিয়ে রক্তে ভেজা এসব ড্রেস চেঞ্জ করি। আমার হাসপাতাল থেকে চলে আসতে ইচ্ছে করছিল না। তবুও এলাম।
এদিকে স্যারকে নিয়ে আমি যখন ট্রলিতে করে ৩২ নম্বর ওয়র্ডে যাচ্ছিলাম সেটি চ্যানেল আই তাদের খবরে দেখায়। আমার বাবা-মা আমার রক্তে ভেজা সে ছবি টেলিভিশনে দেখে ভাবলো আমার কিছু একটা হয়েছে। আমি তাদের ফোন করে ঘটনা জানাণাম। বললাম ভালো আছি। কোন সমস্যা নেই। আমার কিছু হয়নি। তারা নিশ্চিন্ত হলো।
এরপর আমি বিটু ভাইয়ের সাথে তার ফজলুল হক হলে এলাম। আমার হল জহরুল হক হল অনেক দূরে। তাই তার হলেই আমি গোসল করলাম। ড্রেস চেঞ্জ করে বের হলাম। ততোক্ষনে বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল শুরু হয়ে গেছে। হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলা কেন? বিচার চাই এই টাইপের কোন মিছিল। আমিও যোগ দিলাম সেই মিছিলে। অনেক রাতে হলে ফিরলাম। ঘুমালাম।
একটি বিষয় ভেবে খুব ভালো লাগে এখনো। পরে জেনেছিলাম, ঘটনা ঘটার মাত্র ১১ মিনিটের মাথায় স্যারকে আমি হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকেরা বলেছিলো, কোনভবে স্যারকে হাসপাতালে নিতে আরেকটু দেরি হলে রক্তক্ষরনের কারনে বাঁচানো যেতো না। এজন্য খুব ভালো লাগছিল আমাদের; যে স্যারকে বাঁচাতে পারবো।
রাতে ৩ টার দিকে ঘুমাতে গেলাম। সারাদিনের ক্লান্তি, পরিশ্রম, উত্তেজনায় দীর্ঘক্ষন ঘুমালাম।
পরদিন দুপুর ১২ টায় আমার ঘুম ভাঙ্গলো। দ্রুত টিএসসি গেলাম। জানতে পারলাম স্যারকে রাতেই সিএমএইচ নেওয়া হয়েছে। এদিকে পরদিনের প্রায় সব দৈনিকে আমার ছবি। আমি রক্তাত্ব স্যারকে ধরে আছি। সেই ছবি। যাই হোক। জনকণ্ঠ বিরাট করে খবরটা ছাপছে। একটা জনকন্ঠ কিলনাম। খবরটা পড়লাম।
যাই হোক-সারাদিন আমি মনে মনে বারবার প্রার্থনা করছি -স্যার আপনি সুস্থ্য হয়ে উঠেন। কিন্তু সারাদিন নানা গুজব। একবার শুনি স্যার বেঁচে নেই। আবার শুনি বেঁচে আছেন। এসবরে মধ্যে সময় কাটছে। এর মধ্যে বিকেলে কলকাতার তারা বাংলা বা অন্য কোন চ্যানেলের কল্যান টিএসসিতে খবর শুনলাম স্যার নাকি মারা গেছে। কথাটা শুনেই আমার প্রচন্ড মন খারাপ হলো। টিএসসির দোতালায় চলচ্চিত্র সংসদের রুমে এসে আমার মাথা ঘুরতে লাগলো। এরপর আমি অসুস্থ্য হয়ে গেলাম। বমি করলাম। কষ্টে আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আমি ব্যার্থ। স্যারকে বাঁচাতে পারলাম না।
কিন্তু কিছুক্ষন পরেই আবার জানতে পারলাম না স্যার বেঁচে আছে। ইন্ডিয়ার টেলিভিশন ভুল খবর দিছে। এও জানলাম স্যারকে চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে নেওয়া হচ্ছে। আমি স্বস্তি ফিরে পেলাম। স্যারকে ক`দিন পর যথারীতি দেশের বাইরে নেওয়া হলো।
এদিকে স্যারের উপর হামলার ঘটনার বিচার চেয়ে ক্যাম্পাসে শুরু হলো তীব্র আন্দোলন। সব জায়গায় পোষ্টার টানানো হয়েছে। তাতে একটিই ছবি-আমি স্যারকে ধরে আছি। ক্যাম্পাসের যেদিকেই তাকাই আমার ছবি। আমার হাঁটতে বিব্রত লাগে। মনে হয় সবাই আমাকে দেখছে। টিএসসিতে গেলে মনে হয় পুলিশ আমাকে ফলো করছে। ইনকিলাব সে সময় নিউজ করলো ঘটনা ঘটার কিছুক্ষনের মধ্যেই যে দুই ছাত্র স্যারকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো তাদের গ্রেপ্তার করা হোক। তাহলেই সব জানা যাবে।
ছবিটা খেয়াল করুন। দেখুন আমি চিৎকার করছি। কিন্তু কেউ কেউ ভুল করে ভাবেন, আমি হাসছি। সংগ্রাম ইনকিলাব্ সেই কথা বলে তাই নিউজ করলো এই ছেলে হাসে কেন? পরে জানতে পারলাম যথাসময়ে হাসপাতালে নেওয়ায় সংগ্রাম খুবই বিরক্ত। সে সময় স্যারের রাজাকদের বিরুদ্ধে বই নিয়ে সংগ্রাম ক্ষেপে আছে।
এদিকে ঘটনার পর থেকে আমার খালি মনে হয় পুলিশ আমাকে ফলো করে। কেমন একটা ভয় ভয়। সবাই বললো বাসা থেকে ঘুরে আয়। ভয় কেটে যাবে। ভালো লাগবে। আমি চট্টগ্রাম গেলাম।
মাস খানেক পর স্যার সম্ভবত দেশে আসলেন সুস্থ্য হয়ে। মুখে একটা দাগ হয়ে থাকলো। স্যারের ফেরা উপলক্ষ্যে অপরাজেয় বাংলার সামনে অনুষ্ঠান। সবাই সেখানে বক্তৃতা করছে। আমি দর্শকের মতো শুনছি।
স্যার বক্তৃতা করা শুরু করলো। আমি স্যারের কথাগুলো শুনলাম। মুগ্ধ হয়ে দেখছি। খুব তৃপ্ত লাগছে। মনে মনে বলছি স্যার আপনি কি জানেন রাস্তায় যখন আপনি পড়ে ছিলেন, কেউ যখন আপনাকে ধরেনি, তখন এই আমিই আপনাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমিই আপনাকে বাঁচিয়েছি। আমার মধ্যে তখন সাফল্যের আনন্দ।
আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল স্যারের সঙ্গে দেখা করতে। শুভকে নিয়ে আমি একদিন স্যারের বাসায় যাওয়ার চেষ্টাও করলাম সেদিনের ঘটনা বলতে। কিভাবে স্যারকে হাসপাতলে নিলাম সেই কাহিনী। একদিন গেলামও স্যারের বাসায়। কিন্তু জানানো হলো, স্যার বাসায় নেই।
স্যারের সঙ্গে আমার সেই আলাপ আর কখনোই করে ওঠা হয়নি। স্যার কখনো জানতেও পারিনি কে তাকে হাসপাতালে নিয়েছিলো? স্যার তখন কি বলেছিলেন।
এদিকে স্যার দেশে ফেরার পর এই ঘটনা নিয়ে দায়ের করা মামলার তদন্ত নিয়ে শুরু হলো আন্দোলন। পুলিশের বদলে মামলার তদন্তভার পড়লো সিআইডির ওপর। একদিন আমি ক্লাস করে বের হচ্ছি আমাদের জহরুল হক হলের এক কর্মচারী এসে জানালো, প্রভোষ্ট স্যার আপনাকে এখুনি তাঁর বাসায় যেতে বলছে। আমি বুঝলাম না এতো সকালে স্যার কেন আমাকে ডাকছে? সন্দেহ হলো। শুভকে জানালাম আমি প্রভোষ্টের বাসায় যাচ্ছি। কোন সমস্যা হলে খবর নিস। সে সময় আমাদের হলের প্রভোষ্ট ছিলেন আমিনুর রহমান মজুমদার।
আমি সকাল ১০ টার দিকে স্যারের বাসায় গেলাম। স্যার নানান তুচ্ছ বিষয় নিয়ে আমার সাথে গল্প শুরু করলো। কিছুক্ষন পর দেখি সেখানে দু`জন লোক এসে ঢুকলো। এরপর প্রভোষ্ট স্যার চলে গেলো। তারা দেখি কতোগুলো ছবি দেখছে। পাভেল ভাইয়ের তোলা সেই ছবিগুলো যেখানে আমি স্যারকে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছি। আমি শুনছিলাম পাভেল ভাইকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সিআইডি ধরে নিয়েছে। যাই হোক, অনেকক্ষন তারো আমার ছবিগুলো দেখলেন। এরপর নিজেদের পরিচয় দিলেন। জানালেন তারা সিআইডির কর্মকর্তা। একজনের নাম মনে আছে আব্দুল মালেক।
তারা আমাকে নানান বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলেন সেদিনের ঘটনা নিয়ে। জানতে চাইলেন স্যার কি সে সময় কারো নাম বলেছিলেন কিনা, স্যার শেষ পর্যন্ত কি বলেছিলেন এসব। বললো আপনার সঙ্গে আরেকটা ছেলে ছিলো ও কই। আমি মোবাইলে বিটু ভাইকেও আসতে বললাম স্যারের বাসায়। বিটু ভাই এল। মালেক ভাই আমাদের দু`জনের সঙ্গে কথা বললেন।
মালেক সাহেব আমাকে বললনে, আপনেকে আমাদের গ্রেপ্তার করে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার কথা ছিল। কিন্তু আপনার প্রভোষ্ট স্যার বলছে সে অপনাকে চেনে। আপনি তার হলের মেধাবী ছেলে। তাই আপনাকে অ্যারেস্ট কলা হলো না। কিন্তু আপনি আর বিটু কাল সিআইডর মালিবাগ অফিসে আসবেন। কিছু প্রশ্নের উত্তর দেবেন। এরপর মালেক ভাই দেখালেন, গত এক মাসে আমি কখনে কোথায় গেছি সব রিপোর্ট তাদের কাছে আছে। আমি দেখলাম। আমি কবে চট্টগ্রাম গেছি, কথন কি করি সব সেখানে লেখা।
সিআইডি জিজ্জ্ঞাসাবাদ করবে শুনে ভালোই ভয় পেলাম। বুঝতে পারলাম না আমি কি করলাম। আমাকে কেন জিজ্ঞেস করবে। কেন অ্যারেষ্ট করবে। রাতে আমি আমার বিভাগের এক শিক্ষকের বাসায় গেলাম। পুলিশের সাবেক আইজি এনামুল হক তাঁর ঘনিষ্ঠ। তাই তাকে দিয়ে ফোন করানোর চেষ্টা করলাম। লাভ হলো না। ওই আইজি জানিয়ে দিলেন, তিনি এ বিষয়ে কাউকে ফোন করতে পারবেন না। তাতে নাকি তার মান যায়, অথচ আমি তাঁর ছাত্র ছিলাম। সে আমাদের একটা কোর্স পড়াতো।
ভয় নিয়েই কাটলো বাকি রাত। পরদিন সকাল ১১ টায় কিছুটা ভয়েই বিটু ভাইকে নিয়ে পৌছালাম মালিবগে সিআইডির প্রধান অফিসে। কিছুক্ষন পর মালেক সাহেব আমাকে নিয়ে গেলেন সিআইডির উর্ধ্বতন এক অফিসারর রুমে। তিনি সম্ভবত বড় কোন পোষ্টে। দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক। এখন আর নাম মনে করতে পারছি না।
তিনি আমাকে ভালো করে দেখলেন। তারপর বললেন, ঘটনার পরদিন যখন আপনার এই ছবিটা পত্রিকয়া ছাপা হলো তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ সাহেব আমাকে বলেছিলেন এই ছেলেটা রক্তাত্ব স্যারকে জড়িয়ে ধরে আছে। তাকে অ্যারেস্ট করে জিজ্ঞাসাবদ করেন। কিন্তু আমি সেটা করি নাই। কারন আমার কাছে মনে হয়েছে, যারা হামলা করে, তারা কখনোই তাকে উদ্ধার করে না। সেখানকার সব পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমি কথা বলেছি, সবাই বলেছি, স্যারকে যে ছেলেটা জড়িয়েছিলো ছবিতে সেই স্যারকে উদ্ধার করেছেন। কাজেই আপনাকে আমি গ্রেপ্তার করি নাই। আমি সব জানতাম।
এরপর তিনি নানান বিষয়ে জানতে চাইলেন। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এক কথা। সার শেষ মুহুর্তে কি কি বলেছিলেন মনে করার চেষ্টা করেন। স্যার কারো নাম বলেছেন কিনা মনে করার চেষ্টা করেন। আমি একই ঘটনা বললাম। এরপর তিনি বললেন, আপনি সব বর্ণনা একটা লিখিত স্টেমেন্ট হিসেবে দিয়ে যান। আমি সেটা দিয়ে সেখান থেকে এলাম। আর মনে মনে ভাবলাম এসব কারনেই মানুষ বোধহয় মানুষের উপকার করে না। একজন মানুষকে আমি বাঁচালম আর এজন্য আমাকে এখন ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
মেজাজ খারাপ হলো হুমায়ুন আজাদ এবং তার পরিবারের প্রতিও। কারন তারা গত দুই মাসে একবারও খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করে নাই কে স্যারকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলো। উল্টো তারাও সংগ্রাম পত্রিকবার সুরে বলছেন এমনকি স্যারও নাকি বলেছেন, এই ছেলেটা হাসছে কেন? স্যার চাইলেই হয়তো খোঁজ নিতে পারতেন। কথা বলে সেদিনের ঘটনা জানতে পারতেন। কিন্তু তাদের সেই ইচ্ছাটাই হয়নি। উল্টো আমাকে স্যারের বাসায় গিয়ে না পেয়ে ঘুরে আসতে হয়েছে।
অরেক অধ্যায়:
আজাদ স্যারকে জড়িয়ে আমার গল্পটা এখানেই শেষ হলো ভালো হতো। কিন্তু হলো না। গল্প আরো জড়িয়ে আছে। ২০০৪ সালেরই আগস্ট মাস। আমি তখন একটি দৈনিকের সাংবাদিক। ১১ বা ১২ আগষ্ট শুনতে পেলাম জার্মানে স্যার মারা গেছেন। সেদিন সম্ভবত শুক্রবার ছিলো। খুব মন খারাপ হলো। স্যারের সঙ্গে আমার আর কথা বলা হয়ে উঠল না।
সেদিন অফিসে ক্রাইমের কেউ ছিলো না। তখন চীফ রিপোর্টার ছিলেন আশরাফ ভাই। তিনি কি করবেন কিভাবে লিখবেন এই স্টোরি বুঝে উঠতে পারছিলেন না। আমি তাকে বললাম ভাইয়া, আমি স্টোরিরা লিখে দিচ্ছি। আমার পুরো ঘটনা জানা। আমি লিখলাম। আশরফ ভাই বললেন, আমি তারিখ, সময়সহ স্যারের ওপর হামলার ঘটনার এতো বিস্তারিত জানলাম কি করে? তাকে বললাম আমি তখন ঘটনাস্থলে ছিলাম।
পরদিন এই স্টোরিটা লিড হলো। এরপর টানা কয়েকদিন আমি স্টোরিটা ফলোআপ করলাম। আমার কাছে মালেক ভাইয়ের নাম্বার ছিল, তার সঙ্গে যোগযোগ করে মামলার সব তথ্য দিলাম। সব মিলিয়ে আশরাফ ভাই খুব খুশি ছিলেন স্টোরিগুলো দেখে।
যাই হোক, পরে যখন একটি জঙ্গি সংগঠনের হত্যার লিষ্টের তালিকায় হুমায়ুন আজাদের নাম এবং এ সংক্রান্ত কাগজপত্র পাওয়া গেলো, তখন প্রমানিত হলো জঙ্গিরাই স্যারকে হত্যা করতে চেয়েছিল। সে সময় আমি প্রথম আলোতে। সেবারও আজাদ স্যারের নিউজে পুরোনো ঘটনার ইতিহাস টানলাম আমি।
আমার পরিবার এবং শিক্ষকরা শিখিয়েছেন নিজের শতো সমস্যা হরো মানুষের উপকার করবে। গাধা বলেই হয়তো খনো সেটি মানার চেষ্টা করি। বারবার মানুষের কাছ থেকে কষ্ট পাই, তবুও মানুষকেই ভালোবাসি। চেষ্টা করি মানুষের পাশে থাকার। এজন্য আমি ব্যাক্তিগতভাবে তৃপ্ত। আমি জানি মানুষের মুখে হাসি ফুটানোর কি আনন্দ। কিন্তু আফসোস স্যারকে আমরা বাঁচিয়ে রাখতে পারলাম না। অরেকটা আফসোস আজ পর্যন্ত স্যারের পরিবারের কেউ কখনো খোঁজ করে সেদিনের ঘটনাটা জানার চেষ্টা করেনি।
আমি দীর্ঘদিন রক্তে ভেজা ক্যাটস আইয়ের সেই গেঞ্জিটা যেটি ভিজে গিয়েছিল আজাদ স্যারের রক্তে সেটি সংরক্ষন করে রেখেছিলাম। এ বছর হল ছাড়ার সময় আর আনিনি সেটা। তবে স্মৃতিগুলো এখনো আছে জ্বলজ্বেলে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কালে শামসুন্নাহার আন্দোলন, দুর্ঘটনায় হ্যাপির মারা যাওয়া এবং এ নিয়ে আন্দোলন, ২০০৭ সালের আগস্টের আন্দোলন, শিক্ষকদের গ্রেপ্তার ও মুক্তি, বিডিআরের ঘটনাসহ আরো অনেক ইতিহাসের প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী আমি। সর্বশেষ বকরের মৃত্যুর ঘটনার নিউজগুলো করলাম। প্রায়ই ভাবি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ঘটনাগুলো নিয়ে একটা বই লিখি। হয়ে উঠে না আলসেমিতে কিংবা সারাদিনের ব্যস্ততায়। তাই ভাবলাম এবার ব্লগেই লিখে ফেলি ডিজিটাল ডায়েরি। ভালো লাগছে লেখাটা শেষ করে। মনে হলো ইতিহাস চেপে রাখার দায় থেকে মুক্ত হলাম।
শরিফুল হাসান, সিনিয়র রিপোর্টার, দৈনিক প্রথম আলো- [email protected]
বাংলাদেশ সময় ২০১৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০১৩
এমএমকে