আবার শুরু হয়েছে সেই পুরোনো খেলা। ১৯৭১ সালে যেভাবে ধর্মকে ব্যাবহার করে গণহত্যা আর নারী নির্যাতনের নীল নক্সা প্রনয়ন করা হয়েছিল, আজ সেই ধারা আবারো নতুন করে মাথাচারা দিয়ে উঠেছে।
‘সংখ্যালঘু’ শব্দটি আমাদের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অঙ্গনে একটি বহুল পরিচিত ও আলোচিত শব্দ। বিএনপি একা ও তার মিত্রদের নিয়ে যখনই ক্ষমতায় গেছে তখনই কথিত ‘সংখ্যালঘু’দের উপর নেমে এসেছে বৈমাত্রেয় আচরণ এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে অত্যাচার ও নির্যাতনের স্টিমরোলার। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর হিন্দু ও অন্যান্য অমুসলিম সম্প্রদায়ের উপর যে ঢালাও নির্যাতন হয়েছে তাতে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে সহিষ্ণু জাতি হিসেবে আমাদের ভিত্তিই নড়ে গিয়েছিল। আর এবারের সহিংসতা যদি এই মূহুর্তে প্রতিরোধ করা না যায় তাহলে তা আমাদের সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্যের কবর রচনা করবে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ যখন এককভাবে বা তার মিত্রদের নিয়ে ক্ষমতায় গেছে তখন এ ধরনের ঢালাও নির্যাতন বন্ধ হয়েছে বটে, কিন্তু আন্তঃ সম্প্রদায় সম্পর্কোন্নয়নে কোন সুদূর প্রসারী কার্যকর পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। এমন কি সংসদে তাদের তিন চতুর্থাংশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা থাকা স্বত্ত্বেও বাহাত্তরের সংবিধানের অসাম্প্রদায়িক চরিত্রটি পুরোপুরি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি।
এই প্রসঙ্গে জামাতের অবস্থান ও ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করা অবান্তর। আর বিএনপি’র ধারনা হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টানরা কোনদিন তাদের ভোট দেয়না, দেবেনা। সুতরাং তাদের প্রতি বৈমাত্রেয় আচরণ করলে তাদের কোন ক্ষতি বৃদ্ধি হবেনা। বরং দু’ একটি মন্দির কিংবা দেবোত্তর সম্পত্তি যদি কোন ক্যাডার ভেঙ্গে দেয় বা দখল করে নেয় তাতে দলের প্রতি তার আনুগত্য বাড়বে বহুগুনে।
আওয়ামী লীগের এক শ্রেণির নেতাও ‘সংখ্যালঘু’দের ভেবে এসেছে ‘ভোট ব্যাঙ্ক’ হিসেবে। সুতরাং তাদের স্বার্থের দিকে তেমন নজর না দিলেও চলে। তাদেরতো আর বিএনপি জামাতকে ভোট দেওয়ার অবকাশ নেই। স্বার্থ রক্ষা হোক না হোক তাদের ভোট নৌকাতেই যাবে। আওয়ামী লীগের দলীয় অবস্থান বা দৃষ্টিভঙ্গী তা না হলেও স্থানে স্থানে তাদের স্থানীয় নেতা কর্মীদের মধ্যে এ প্রবনতা স্পষ্টতই বিদ্যমান। ক্ষমতার পরিবর্তনে ‘সংখ্যালঘু’দের দূর্ভোগের ওঠানামা হয়, কিন্তু সামগ্রিক ভাগ্য পরিবর্তন নৈবচ নৈবচ।
এমনটি কিন্তু হওয়ার কথা ছিলনা। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে সংগঠিত আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ছিল একটি সমতাভিত্তিক সমাজ ব্যাবস্থা প্রতিষ্ঠার। ‘সমতা’ বলতে ধর্মীয় অধিকারের সমতা সহ সব ধরনের সমতাকেই আলিঙ্গন করা হয়েছিল। সংবিধানে প্রতিটি নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে, যদিও তার প্রয়োগ আজো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সংবিধানকে বারবার কাঁটা ছেঁড়া করে সাম্প্রদায়িক চরিত্র দেবার চেষ্টা করা হলেও বাংলাদেশকে কখনোই ‘ইসলামিক রিপাবলিক’ ঘোষনা করা হয়নি। বাংলাদেশ আজো ‘পিপলস রিপাবলিক’ ই আছে। তার অর্থ বাংলাদেশ তার প্রতিটি নাগরিকের। তাই এই দেশে ‘সংখ্যালঘু’ শব্দটি বেমানান এবং অনাকাংখিত। কারণ, এই ‘গণপ্রজাতন্ত্র’টি এদেশে বসবাসকারী সকল জনগণের।
কেবলমাত্র ধর্ম বিশ্বাসে আলাদা হলেও নৃতাত্বিকভাবে এদেশের শতকরা ৯৯ জন মানুষকে একে অপরের কাছ থেকে আলাদা করার কোন উপায় নেই। যেহেতু বাংলাদেশে কোন ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র নয় সেহেতু কেবলমাত্র ধর্মীয় ভিন্নতার কারণে কাউকে ‘সংখ্যালঘু’ হিসেবে আখ্যায়িত করার কোন অবকাশ নেই। এদেশের মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান সবাই তাদের ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে গর্বিত। কিন্তু আমাদের সবার অভিন্ন জাতীয় পরিচয় ‘বাঙালি’ কিংবা ‘বাংলাদেশি’। সুতরাং এই পরিচয়ধারী কেউই বাংলাদেশে ‘সংখ্যালঘু’ হিসেবে পরিচিত হতে পারেনা।
‘সংখ্যালঘু’ শব্দটি আমাদের স্বাধীনতার চেতনার পরিপন্থী। এই শব্দটি পরিহার করুন। প্রত্যাখ্যান করুন।
[email protected]
বাংলাদেশ সময় ১৭০৪ ঘণ্টা, মার্চ ০৫, ২০১৩
এমএমকে