ঢাকা, রবিবার, ২১ আশ্বিন ১৪৩১, ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ০২ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

প্রাইমার্কের ক্ষতিপূরণ ও রক্তচোষার সমর্থকরা

ফারুক যোশী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ৩০, ২০১৩
প্রাইমার্কের ক্ষতিপূরণ ও রক্তচোষার সমর্থকরা

ব্রিটেন থেকে: বাংলাদেশে রানা প্লাজার ভবন ধসের ঘটনায় হতাহতদের ক্ষতিপূরণের দাবিতে ব্রিটেনের খ্যাতনামা চেইন স্টোর প্রাইমার্কের সামনে প্রতিবাদ প্রদর্শিত হয়েছে। মূলত বিদেশিরাই এ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন কর্মসূচিতে উপস্থিত ছিলেন।



এসব কর্মসূচিতে বাংলাদেশিদের উপস্থিতি বলতে গেলে চোখেই পড়েনি। বাংলাদেশে এযাবৎ কালের এক ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর ব্রিটেনসহ সারা পৃথিবীতেই এ নিয়ে চলেছে আলোচনা-সমালোচনার ঝড়। শ্রমিকদের ব্যাপারে নজরদারি, তাদের হেল্থ এন্ড সেফটি, পারিশ্রমিক, ফায়ার এন্ড বিল্ডিং ইস্যুসহ বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কথা উঠেছে এই সুদূর ব্রিটেনেও। এমনকি গণমাধ্যমগুলোও অন্তত তিন-চারদিন তাদের ব্রেকিং নিউজগুলোতে বাংলাদেশে রানা প্লাজার ভবন ধসের ঘটনাকে গুরুত্বের সঙ্গে স্থান দিয়েছে।

এ ঘটনায় স্বাভাবিকভাবেই প্রাইমার্ক কিছুটা বেকায়দায় পড়েছে। যদিও তাদের দাবি, বাংলাদেশের হেল্থ এন্ড সেফটি ইস্যুসহ আনুসাঙ্গিক সব কিছু মেনেই তারা কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি প্রাইমার্কের পক্ষ থেকে এটাকে নিছক একটি দুর্ঘটনা হিসেবেই মিডিয়ায় উল্লেখ করা হয়েছে।    

খোদ ব্রিটেনেরই প্রটেস্টার বা প্রতিবাদীরা বলছে ভিন্ন কথা। সেন্ট্রাল লন্ডনের অক্সফোর্ড স্ট্রিটের প্রাইমার্কের সামনে প্ল্যাকার্ড-ফেস্টুন নিয়ে একটি মানবাধিকার সংগঠন ‘ওয়ার অন ওয়ান্ট’র নেতারা বলছেন ভিন্ন কথা। সংগঠনটির একজন সদস্য মোরি ওয়ার্থি বলেছেন, “এটা একটা হত্যাকাণ্ড, এবং এর দায়ভার প্রাইমার্ককেও বহন করতে হবে। ”

তিনি বলেন, “প্রাইমার্ক যদি সব ইস্যু মেনে চলতো, তাহলে এই শ্রমিকদের এমন ভয়াবহ পরিণতি হতো না। সেজন্যেই এটাকে দুর্ঘটনা বলে কোনোভাবেই প্রাইমার্ক এ দায় এড়াতে পারে না। ”

নিহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথাও সংগঠনটি তাদের দাবিতে উল্লেখ করেছে। একইসঙ্গে ব্রিটেনের আরও দু’টো চেইন সুপারস্টোর ’ম্যাটালান’ এবং ‘ম্যাংগো’রও হেলথ এনড সেফটি ইস্যু নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

এদিকে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে আছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। ক্ষমতাশীল দল কিংবা ক্ষমতাপিপাসু দলগুলোর কর্মী, ব্রিটেন প্রবাসী পেটি-ব্যবসায়ীরা বলছেন প্রাইমার্কের সামনে বিক্ষোভ করা বাংলাদেশের জন্যে, বিশেষ করে গার্মেন্টস ব্যবসার জন্যে সফলতা বয়ে আনবে না। বরং ব্রিটেন-আমেরিকার পোশাক আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কাপড় তৈরির জন্যে বাজার খুঁজবে পৃথিবীর অন্য কোথাও।

বাংলাদেশের বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলো সবসময়ই লুটেরা শ্রেণীর স্বার্থ দেখে। এমনকি এরা মাত্র চার মাস আগে ঘটে যাওয়া তাজরীন ফ্যাশনের জ্বলন্ত মানুষের শোকও ভুলে গেছে তাদের স্বার্থ সিদ্ধির প্রয়োজনে। তাজরীনের এ হত্যাকাণ্ডের পরই সরকার এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে পারতো। নতুন আইন নিয়ে আসতে পারতো, নিরাপত্তা ও বিল্ডিং রেগুলেশন নিয়ে নতুন আইন প্রণয়ন করতে পারতো। তাজরীনের হত্যার দায় যাদের উপর বর্তায়, তাদের শাস্তির মুখোমুখি করতে পারতো। কিন্তু তারা তা করেনি।

এ নিয়ে বিরোধী দলও খুব একটা মাথা ঘামায় না। এই ব্যবসায়ীরাই আওয়ামী লীগ-বিএনপি চালায়। তাদের অনেক প্রতিনিধিরাই সংসদে এখন গলাবাজি করেন। বাইরে অনেকেই হয়ত দিন গুনছেন আগামী নির্বাচনের পর সংসদে আসার।

বিরোধী দল কথায় কথায় প্রতিদিন হরতাল দিতে পারে, কিন্তু তারা কি পেরেছিলেন একদিনও শ্রমিকদের মৌলিক দাবির প্রশ্নে কোনো হরতাল দিতে?

গার্মেন্টস শ্রমিকদের নিয়ে আন্দোলনের মোক্ষম সময় এটা। কারণ এখনকার এই জ্বলন্ত সময়েই শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য দাবিকে সামনে নিয়ে আসতে পারবে। তাদের সামনে জ্বলন্ত উদাহরণ বিধ্বস্ত রানা প্লাজা, হাজারো মানুষের লাশ, হাজার হাজার পঙ্গু খেটে-খাওয়া মানুষ। তাদের সামনে জ্বলন্ত উদাহরণ তাজরীন ফ্যাশন। সুতরাং এ সময়ে আর চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেবার সময় নয়, গার্মেন্টস শ্রমিকদের কি প্রয়োজন। শ্রমিকরা জেনে গেছে, তাদের কি অধিকার। শ্রমিকের পরিবার জেনে গেছে কি তাদের অধিকার? এরা জেগে উঠবেই। সরকার জানে, রাজনৈতিক দলগুলো জানে এখন গার্মেন্টগুলোতে কোন ইস্যুগুলো উঠে এসেছে। এই ইস্যুগুলো বিবেচনায় এখন নিতেই হবে। সরকার যদিও সবসময় রাঘব-বোয়ালদের চাপে থাকে, কিন্তু রানা প্লাজার ঘটনা সরকারের সেই চাপ কমিয়ে দিয়েছে।

গার্মেন্টস মালিকরা এখন দেশে এবং আন্তর্জাতিকভাবে চাপের মুখে। সরকার আন্তরিক হলে এবং  দৃঢ় পদক্ষেপ নিলেই গার্মেন্টস শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তা বিধান সম্ভব।

এদিকে ব্রিটেনে গত শনিবার প্রাইমার্ক-এর সামনে অনেক অবাঙালি প্লেকার্ড-ফেস্টুন নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তাদের দাবি ছিল, প্রাইমার্ককে বাংলাদেশের শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এই প্রতিবাদের কারণেই আন্তর্জাতিক শ্রম আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে প্রাইমার্ক সোমবার ঘোষণা দিয়েছে তারা মৃত শ্রমিকদের পরিবার এবং আহতদের ক্ষতিপ‍ূরণ দেওয়ার জন্যে একটা বড় অংকের বাজেট নিয়ে এগুচ্ছে তারা।  

শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্যে আমাদের বিরোধী দলগুলো ডাউনিং স্ট্রিট কিংবা পার্লামেন্টের সামনে বিক্ষোভ করেন। যে কাজটি বিএনপি ক্ষমতায় এলে আওয়ামী লীগও করে।

কতিপয় রক্তচোষা খুনিদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্যে তারাই আবার বলেন, দেশের বদনাম হবে, গার্মেন্টস এর বাজার চলে যাবে পৃথিবীর অন্য দেশগুলোতে।

যে বাজার টিকিয়ে রাখার জন্যে হাজারো মানুষের জীবন্ত কবর হয়, শত শত মানুষ জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়, সে বাজার কি আমাদের জন্য জরুরি? আমাদের ব্যবসা প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক অঙ্গণে আমাদের পোশাক শিল্পের সুনাম আছে। তবে এরই সঙ্গে সে সুনাম ধরে রাখাও আমাদের দায়িত্ব। শ্রমিকের রক্ত দিয়ে ডলারের পাহাড় বানালে সে বাজারের কি কোনো প্রয়োজন আছে? আমরা স্বীকার করি পঁচিশ-ত্রিশ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান করেছে ঐ পোশাক শিল্প। কিন্তু কর্মসংস্থানে অর্থ কি শ্রমিকের উপর অমানবিক শোষণ কিংবা নির্যাতন কিংবা তাদের জীবন নিয়ে নৃত্য করা? প্রাইমার্ক যেখানে এই ভয়াবহতার কথা বিচেনায় এনে বিশাল অংকের ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে, সেখানে সরকার কিংবা পোশাক শিল্পের মালিকরা কেন একটা দীর্ঘমেয়াদী শ্রমিক নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা করতে পারবে না?

ফারুক যোশী: ব্রিটেন প্রবাসী সাংবাদিক

বাংলাদেশ সময়: ১০৪০ ঘণ্টা, এপ্রিল ৩০, ২০১৩
সম্পাদনা: মীর সানজিদা আলম, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।