ঢাকা: গ্রেফতার হওয়ার কয়েকদিন আগে জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আজম একটি বেসরকারি টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, “জামায়াতের হেড কোয়ার্টার লাহোর, তখনও ছিল লাহোর (১৯৭১), এখনও লাহোর”।
সেই সাক্ষাতকার দেখার পর থেকে তুমুল আগ্রহ ছিল, লাহোরে বা পাকিস্তানে জামায়াতের অবস্থানটা আসলে কি তা জানার? আর সেটি পরিমাপের প্রধান উপায়- নির্বাচন।
ভেবেছিলাম জামায়াত আমাদের দেশে ইসলামের নামে যেভাবে তাণ্ডব চালায়, নিশ্চয়ই পাকিস্তানে তাদের হেডকোয়ার্টারেও ভোটের বন্যা বইয়ে দিবে। কিন্তু দুঃখের ও হতাশার ব্যাপার, জামায়াত সেখানে ন্যাশনাল এসেম্বলিতে আসন পেয়েছে মাত্র ৩টি!
১৯৪১ সালে জামায়াত প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তানের প্রথম নির্বাচন হয় ১৯৫৪ সালে। সেখানে তারা অংশ নেয়নি। এরপর ১৯৬২ তেও নয়। ১৯৬৫ সালে সিওপি’র (কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টি) মাধ্যমে নির্বাচনে অংশ নেয়। তারা মূলত একক ও স্বাধীন নির্বাচন করে ১৯৭০ সালে। তখন পুরো পাকিস্তানে জামায়াতের আসন ছিল চারটি, তার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে একটিও ছিল না!
৪৩ বছর আগে তারা আসন পেয়েছিল ৪টি, এখন ৩। এই দীর্ঘ সময়ে জামায়াতের অগ্রগতি কি?
তারা আসলে একই জায়গায় স্থির হয়ে চার দশক দাঁড়িয়ে আছে। ভোটে যেমন, মননেও তেমন। ১৯৪১ সালে জামায়াত প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ পর্যন্ত তাদের চলনে, বলনে, কর্মে এবং ধর্মে কোনো পরিবর্তন হয়নি। যা কিছু পরিবর্তন তাদের চর্মে। অর্থাৎ চামড়ার রঙ পরিবর্তন করে, মুখে এনামেল মেখে, মুখোশ পরে বারবার তারা আমাদের সামনে আসে। কিন্তু ভাগ্য এতোটাই খারাপ যে, প্র্রতিবারই তাদের ধরাশায়ী হতে হয় ভোটারদের কাছে। পাকিস্তানের ভোটার হোক, কিংবা বাংলাদেশের। বাংলাদেশের চেয়ে পাকিস্তানে তাদের অবস্থা বেশি মুমূর্ষু।
প্রশ্ন হতে পারে, হেডকোয়ার্টারে জামায়াতের এই দুর্দশা, কিন্তু বাংলাদেশে তাদের এতো লম্ফঝম্প কিভাবে? এর কারণ আমাদের গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থার ধর্মান্ধতা, মাদ্রাসামুখী অনাধুনিক তরুণ সমাজকে ইসলামের ভয় দেখিয়ে প্রতারিত করা, মানসিকভাবে প্রভাবিত করা।
কিন্তু তাই বলে পাকিস্তান কি ধর্মান্ধ রাষ্ট্র নয়? তারা কি আমাদের চেয়ে বেশি অগ্রসর? আমি বলবো, নির্বাচনের ফলাফলে চোখ রাখুন, সেখানেই উত্তর খুঁজুন।
জামায়াত আমাদের দেশে যে খুব শক্তিশালী অবস্থানে আছে, সেটাও নয়। তারা সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসন পেয়েছে দু’টি। জন্মের পর জামায়াত এখানে নিষিদ্ধ হয়েছিল একবার, স্বাধীনতার পর। পাকিস্তানেও একবার আইয়ুবের আমলে দাঙ্গা বাধানোর দায়ে নিষিদ্ধ হয়েছিল।
শুধু তাই নয়, জন্মের পর থেকে এখন পর্যন্ত এই দলটি আমির-ওমরা পর্যায়ের সব নেতাই হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত। পাকিস্তানে জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মওদূদী কাদিয়ানি-মুসলিম দাঙ্গা লাগিয়ে প্রায় হাজার লোক হত্যার দায়ে বিচারের সম্মুখীন হয়ে মৃত্যুদণ্ড পেয়েছিলেন। পরে রাজনৈতিক কারণে সাধারণ ক্ষমা পান।
বিভিন্ন সময়ে জামায়াতকে নিয়ে পাকিস্তান চরম বিপদে ছিল এবং এখনও আছে। সেখানে জামায়াতকে নিয়ে সবচেয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হয় ১৯৭০ সালের পহেলা নভেম্বর। ফিরোজ খান নামে এক জামায়াত কর্মী ট্রাক ড্রাইভার করাচি বিমানবন্দরে পাকিস্তান সফরে থাকা পোলান্ডের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জিগফ্রিড ওলনিয়াকসহ চারজনকে গাড়ি চাপা দিয়ে হত্যা করে। যদিও পরে জামায়াত নেতারা ওই ড্রাইভার তাদের কর্মী নয় বলে দাবি করেন। পাকিস্তান বৈদেশিক সম্পর্ক রক্ষার্থে একে স্রেফ দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দিতে চাইলেও পরে এ নিয়ে পানি কম ঘোলা হয়নি।
শুধু এটিই নয়, ইতিহাসে জামায়াত দিয়ে যতোগুলো হত্যাকাণ্ড হয়েছে, তার সবগুলোরই দায় অস্বীকার করে দলটি। তারা অত্যন্ত কৌশলে মানুষের ভেতরের পশুটিকে জাগিয়ে দেয়। পরে তাকে সরাসরি জঙ্গিতে পরিণত করে। ১৯৭০ সালের সেই ফিরোজ খান থেকে শুরু করে ২০০৭ সালের বাংলা ভাই পর্যন্ত জঙ্গি তালিকায় যুক্ত প্রায় সবাই কোনো না কোনো বয়সে জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। এছাড়া সরাসরি হত্যাকাণ্ডের মদদ দিয়েছেন জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ আবুল আলা মওদূদী, একেএম ইউসুফ, গোলাম আজম, মতিউর রহমান নিজামী, কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান, চৌধুরী মঈনুদ্দীন প্রমুখ।
ধর্মীয় বিভ্রান্তমূলক অপব্যাখ্যা দিয়ে এসব হত্যাকাণ্ড ও সামাজিক অস্থিতিশীলতা তৈরি করা হয়।
এদেশ, ওদেশ- দু’দেশেই নির্বাচনে জামায়াতের পরাজয়ের আরেকটি কারণ হলো সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারা। একাত্তরে যেমন জামায়াতের বাংলাদেশ বিরোধী ভূমিকা ছিল, তেমন ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাজনের প্রথম ভাগেও তাদের পাকিস্তান বিরোধী ভূমিকা ছিল। তারা বরাবরই স্বাধীনতা ও পরিবর্তনের ব্যাপারে গোঁয়ার, নিজেরাই নিজেদের নিয়ে বিভ্রান্ত।
‘মাদ্রাসার দেশ’ পাকিস্তানে জামায়াতের লোকজনকে ধর্মীয়ভাবে বিভ্রান্ত বা গাফেল মনে করা হয়। মওদূদীকে গাফেল বা ভ্রান্ত ধারণার অনুসারী মনে করা হয়। মুসলমান হলেও তারা ইসলামের অনেক তত্ত্ব বিকৃত ও নিজের সুবিধার মতো করে প্রচার করে। সম্ভবত এসব কারণেই জামায়াতের মতো ভ্রান্ত নীতির দলগুলো পরাজিত হয় দেশে দেশে। পরাজিত হয় তাদের হেডকোয়ার্টারেও।
এবার আমাদের পালা তাদের পরাজিত করার। সামনে নির্বাচন তো আসছেই।
লেখক: ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিস্ট
ইমেইল: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ২০০০ ঘণ্টা, মে ১৪, ২০১৩
সম্পাদনা: হাসান শাহরিয়ার হৃদয়, নিউজরুম এডিটর/জেডএম