যদি কোন সাংবাদিক অন্যায় করেন, অপরাধ করেন- তবে তার শাস্তির বা বিচারের প্রক্রিয়াটা কী হবে? তাকে কী গ্রেফতার করা যাবে, নাকি যাবে না?
যদি কোন সম্পাদক তার সংবাদপত্র ব্যবহার করে দেশে ধর্মীয় দাঙ্গা লাগান এবং তাতে শত শত লোক মারা যায়, তখন সেই সাংবাদিকের বিচার প্রক্রিয়া কী হবে? তাকে কী গ্রেফতার করা রাষ্ট্রের জন্য ন্যায়, নাকি সেটা অন্যায় হবে? নাকি তাল পাতায় বাতাস করে রসগোল্লা খাইয়ে আলতো করে বকে দিতে হবে- ছি, দুষ্টু এমন করে না।
আমার দেশ পত্রিকার বিতর্কিত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের মুক্তির দাবিতে দেশের খ্যাতনামা ১৫ সম্পাদকের বিবৃতি দানের পর অনেকের মনে এমন প্রশ্ন জেগেছে।
আরো কিছু প্রশ্ন হতে পারতো, আপাতত থাক। বিবৃতিদাতা ১৫ সম্পাদক সবাই শ্রদ্ধেয়, স্বনামখ্যত। বিতর্কিত একজন সম্পাদকের জন্য এরুপ বিবৃতি পুরো সাংবাদিক সমাজকে এমন অনেক প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। তারা হয়তো বলবেন- সম্পাদক হয়ে আরেক সম্পাদকের জন্য সমবেদনার রেওয়াজ মেনে ভদ্রতা দেখিয়েছেন।
তারা স্বগোত্রীয়’র প্রতি সমবেদনা জানানোর হুজুগে যে কাজটি করেছেন তা হিতকর নয়, যৌক্তিক নয়। কেননা তাদের দাবি গণতন্ত্র ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি অবজ্ঞা দেখিয়েছে।
তারা যে দাবি করেছেন- সেটা গ্রহণযোগ্য নয়, অবিবেচনা প্রসূত। তারা বড়জোর মাহমুদুর রহমান যাতে সুবিচার পায় তার দাবি তুলতে পারতেন, স্বগোত্রীয়’র শাস্তি যাতে কম হয় তার দাবি করতেন। কিন্তু তা না করে সরাসরি মাহমুদুর রহমানের মুক্তি দাবি করলেন!
মাহমুদুর রহমান সংবাদ প্রকাশের নীতিমালা ভঙ্গ করেছেন কি না সেটা তারা আমার চেয়ে নি:সন্দেহে ভালো বোঝেন এবং জানেন।
মাহমুদুর রহমান হলুদ সাংবাদিকতার ইতিহাসে নক্ষত্র। একের পর মিথ্যাচার, সংঘর্ষ বাধানোর চেষ্টা সাংবাদিকতার শত বছরের ঐতিহ্যকে লজ্জা দিয়েছে। মাহমুদুর রহমানের উস্কানির প্রেক্ষিতে দেশে যে পরিমাণ রক্তক্ষয় হয়েছে তার দায় আজ ১৫ সম্পাদক তাকে সমর্থন দিয়ে পরোক্ষভাবে কিছুটা হলেও নিজেদের কাঁধে নিয়েছেন।
দেখলাম, তারা পরমতে সহিষ্ণু হওয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন সরকারকে। পরমত বলতে তারা কী বুঝিয়েছেন- জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষকতা, পরমত কি উস্কানী, পরমত কী তরুণদের নাস্তিক বলে বিভেদ তৈরি করা, পরমত কি উত্তরার গোপন বৈঠক, পরমত কি দেশবিরোধী কর্মকাণ্ড, পরমত কি শাহবাগের নামে অশ্লীল রটনা, পরমত কি রাজাকারের মুক্তি চাওয়া? সম্পাদকদের কাছে অবশ্যই এর জবাব চাই। যে কোন একজনও যদি এর জবাব দেন কৃতজ্ঞ থাকবো।
আমার ধারণা, মাহমুদুর রহমান কী বলেছেন কী লিখেছেন তা শ্রদ্ধেয় সম্পাদকরা স্মৃতি বিভ্রাটে বিস্মৃত হয়েছেন। আপনরা কী দয়া করে দৈনিক আমার দেশের পুরোনো সংখ্যাগুলোর প্রধান শিরোনামগুলো আবার পড়ে দেখবেন?
৯ ফেব্রুয়ারি আমার দেশের শিরোনাম ছিল- ‘শাহবাগে ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি: গৃহযুদ্ধের উস্কানি’।
১৮ ফেব্রুয়ারি প্রধান শিরোনাম ছিল- ‘ভয়ঙ্কর ইসলামবিদ্বেষী ব্লগারচক্র’।
১৯ ফেব্রুয়ারি- ‘ব্লগারদের ইসলামবিদ্বেষী প্রচারণায় আলেমদের ক্ষোভ: নাস্তিকদের প্রতিরোধে সর্বাত্মক আন্দোলনের ঘোষণা’।
২০ ফেব্রুয়ারি- ‘ব্লগে নাস্তিকতার নামে কুৎসিত অসভ্যতা’।
২১ ফেব্রুয়ারি- ‘শেখ হাসিনাকে নিয়ে কটূক্তির জন্য শাস্তি : রাসুল (সা.) অবমাননাকারীদের বাহবা!’।
২২ ফেব্রুয়ারি- ‘ধর্ম ও আদালত অবমাননা করছে ব্লগারচক্র’।
২৫ ফেব্রুয়ারি- ‘পুলিশের নির্বিচারে আলেম হত্যা: স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল’।
২৩ ফেব্রুয়ারি সংবাদ প্রকাশ হয়- ‘রাসুল (সা.) অবমাননার প্রতিবাদে গণবিস্ফোরণ: গাইবান্ধায় নিহত ৩ সিলেটে ১ ঝিনাইদহে ১ সারাদেশে আহত ৪ হাজার’।
এভাবে মাহমুদুর রহমান ধর্মপ্রাণ সরল মানুষগুলোকে হিংস্র করে তুলেছেন দিনের পর দিন ভুল আর মিথ্যা তথ্য দিয়ে। আজ আপনারা যেসব শ্রদ্ধেয় জন এই সম্পাদকের মুক্তি দাবি করেছেন তারা এই উস্কানির দায় নেবেন কী?
আজ মাহমুদুর রহমানের জন্য যে ভাষায়, যে প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে কিছু শব্দ ব্যয় করেছেন, মুক্তি চেয়েছেন সেই একই কারণে কী প্রেসক্লাব সদস্য কামারুজ্জামান (এককালের সংগ্রাম সাংবাদিক) এবং মীর কাসেম আলী (দিগন্ত মিডিয়ার মালিক) এর মুক্তি চাইবেন না? তা না হলে আপনাদের সাংবাদিক-সুশীলত্ব আর থাকে না! আশা করি সেই বিষয়টা ভেবে দেখবেন। এই কাজটি করে আপনারা নিরপেক্ষতার জ্বলজ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকুন- এটাই আমাদের কামনা।
বিবৃতির সবচেয়ে উপহাসমূলক, হাস্যকর লাইনটিতে আপনারা লিখেছেন- “আইন তার নিজস্বগতিতে চলবে”।
প্রিয় সম্পাদকগণ, আইন যদি তার নিজস্বগতিতে চলে তবে আপনারা সরকারের কাছে মাহমুদুর রহমানের মুক্তি চান কিভাবে, কিভাবে আপনারা তার বিরুদ্ধে আনীত মামলা প্রত্যাহারের কথা বলেন! আইন নিজস্বগতিতে চলতে দিলে তাকে কি আইনের মাধ্যমেই মুক্ত হয়ে আসার সুযোগ দেওয়া উচিত নয়? নাকি সাংবাদিক সাইনবোর্ড থাকার কারণে তাকে মুক্তি দেওয়াটাই আইনের নিজস্বগতি। আইন কোন গতিতে, কোন মতিতে চলবে সে বোঝা ভারী ভার হয়ে পড়লো, প্রিয় সম্পাদকবৃন্দ?
প্রিয় সম্পাদকগণ,
মাহমুদুর রহমান যখন দিনের পর দিন উস্কানি দিয়েছেন- আপনারা তখন কোন বিবৃতি দেন নি। যখন শাহবাগের হাজার হাজার তরুণকে নাস্তিক বলে গালাগাল করেছে তখন কিছু বলেন নি, মাহমুদুরের প্রবঞ্চনায় যখন ইসলাম গেলো বলে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নামে, বিশৃঙ্খলা করে, অত:পর পুলিশের গুলি খেয়ে মরে- তখন কোন বিবৃতি দেন নি, যখন রাজীব নামে এক ব্লগারের মৃত্যুকে নিয়ে শুকরিয়া করা হলো তখন কিছু বলেন নি, যখন শাহবাগে আগত তরুণীদের পতিতা বলে চালাতে চাইলো তখন কিছু বলেন নি, মাহমুদুরের কোন অপকর্মের বিরুদ্ধেই তো কিছু বলেন নি। আজ কেন বিবৃতি দিলেন?
তবে কি একজন সম্পাদক মানেই আরেকজন সম্পাদক গ্রেফতার হলে তার ন্যায় অন্যায় বিবেচনা না করে মুক্তির দাবি তোলার অধিকার? সম্পাদক মানে কী আরেকজন সম্পাদকের প্রতি একচোখা ভালোবাসা? হোক সে পাপী, অপরাধী। তবে কি সম্পাদক একটি আলাদা গোত্র?
বিবৃতিদাতা যে কোন একজন সম্পাদকও যদি আমার মতো হাজারো তরুণের এসব প্রশ্নের জবাব দেন, কৃতজ্ঞ থাকবো।
লেখক: ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিস্ট
ইমেইল: [email protected]
[এ নিবন্ধের ভাষারীতি, মতামত ও বিশ্লেষণ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। কোন মতামত বা বিশ্লেষণের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়। কেউ এ নিবন্ধ নিয়ে বাংলানিউজ সম্পাদকের কাছে কোন মতামত পাঠাতে চাইলে মেইল করুন [email protected] ঠিকানায়। ]
বাংলাদেশ সময়: ২০৪৬ ঘণ্টা, মে ১৯, ২০১৩
জেডএম/