ব্রিটেন থেকে: কোনো না কোনোভাবে বাংলাদেশের মানুষের একটি অংশ আওয়ামী লীগের ওপর ক্ষেপে আছে, এ ব্যাপারটা কমবেশি সবাই জানেন। দলের ভেতরের কিছু ব্যক্তিও অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জড়িয়ে আছেন, যার পরিণাম হয়তো এমনিতেই ভোগ করতে হতো চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে।
দেশের চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হারলো। বিএনপি জিতলো এবং ভালো করেই জিতলো। কিন্তু একটি প্রশ্ন এ নির্বাচনের পর যেন আমাদের ধাক্কা দিয়ে গেলো- আসলে জনগণ কি বিজয়ী হলো এ নির্বাচনে?
২
সিলেটের নির্বাচন নিয়েই যদি কথা বলি, তাহলে আমরা দেখি, এখানে দীর্ঘ ১৮ বছরের মেয়র কিংবা চেয়ারম্যান বদরুদ্দিন কামরান এ নির্বাচনে হেরেছেন প্রায় ৩৫ হাজার ভোটের ব্যবধানে। বিশ্লেষকরা বলছেন, মেয়রের এ হেরে যাওয়ার কারণ, সিলেট শহরের বিভিন্ন সঙ্কট যেমন- জলাবদ্ধতা, হকার উচ্ছেদ। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতিরও শত অভিযোগ আছে। আছে অঢেল অর্থের মালিক হওয়ার অনেক গল্প-গাঁথা। এছাড়া দলীয় নেতা-কর্মীদের অনুযোগ-অভিযোগ, জামায়াতিদের সঙ্গে ব্যবসা কিংবা হেফাজতে ইসলামে সঙ্গে সখ্য ইত্যাদি ইস্যু তাকে তলে তলে কুঁরে খেয়েছে ভোটের রাজনীতিতে। এমনকি দলের অভ্যন্তরেও তিনি প্রতারিত হয়েছেন।
কিন্তু কথা হলো, কামরানের বিপরীতে যার উত্থান এবং যিনি এবারে নির্বাচনে জয়ী হলেন তাকে নিয়ে। তার ব্যাপারে অন্য কোনো আলোচনায় না গিয়ে শুধু যদি তার দলের নেত্রী খালেদা জিয়ার কথাটিই ধরে নিই, তা-ই বোধহয় যথেষ্ট। দলনেত্রীর কাছে আরিফের দলের অন্য প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর অভিযোগই যদি আমরা প্রমাণ হিসেবে নিই, তাহলেই দেখা যাবে দুর্নীতির পাল্লায় তার এগিয়ে থাকা। নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার দৌড়ে যখন খালেদা জিয়া তার দলের চার প্রার্থীকে ডেকেছিলেন, তখন নেত্রী অন্য তিনজনকে বলেছিলেন, আরিফুল হক চৌধুরীকে তিনি মনোনীত করেছেন এবং তারা যেন আরিফের হয়ে কাজ করেন। তখন অন্য তিনজনই নেত্রীকে বলেছিলেন, আরিফ সিলেটে দুর্নীতি করে শত শত কোটি টাকা বানিয়েছেন। এমন একজন দুর্নীতিবাজকে মনোনয়ন না দিয়ে তাদের মাঝ থেকে কাউকে যেন মনোনয়ন দেন।
এর বেশি বিচার-বিশ্লেষণে আমি যেতে চাই না। কারণ, আরিফ এখন জনগণের ভোটে নির্বাচিত মেয়র। এবং আমরা বিশ্বাস করতে চাই, খালেদা জিয়া যেভাবে বলেছিলেন, “আমি জানি আরিফের সবকিছু, তবে সে বলেছে আগামীতে এসব আর করবে না”, তা-ই হবে। প্রকারান্তরে খালেদা জিয়াও জেনেশুনেই একটি বিশাল পদে মনোনয়ন দিয়েছিলেন আরিফুল হক চৌধুরীকে। খালেদার কথাগুলোই (আরিফ ভবিষ্যতে দুর্নীতি করবেন না) এখন জনগণের আস্থার জায়গা। নবনির্বাচিত মেয়র জনগণের কিংবা তার নেত্রীর এ আস্থার জায়গাটুকুতে সম্মান দেখাবেন কিনা, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
দুর্নীতি কিংবা নৈতিকতায় কেউই কাউকে পেছনে ফেলার নয়। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিটা যেন এভাবেই ক্রমশ এগুচ্ছে। যেন শত শত কোটি টাকার দুর্নীতির পরিপ্রেক্ষিত না থাকলে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাই করা যায় না। আর এ ধারাবাহিকতায় সাবেক মেয়র কিংবা বর্তমান মেয়রের মাঝে শ্রেণিগত কোনো ফারাক নেই। তবে রাজনৈতিক ব্যবধান আছে। এ ব্যবধানের কারণেই হয়ত আরিফের জয়।
সাবেক মেয়র কামরান কাদের নিয়ে এগিয়েছিলেন? সিলেটের আওয়ামী লীগার এবং অন্য ছোট ছোট দলগুলোর কিছু মানুষ। কিন্তু মহাজোটের প্রধান অংশীদার জাতীয় পার্টি তাদের সঙ্গে ছিল না। অর্থাৎ জোটের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ এখানে মার খেয়েছে। অন্যদিকে, রাজনৈতিক মোকাবেলায় আরিফ এগিয়েছিলেন অনেক। জামায়াত-হেফাজত তথা ডান কিংবা দক্ষিণপন্থীদের নিয়ে জোট বেঁধে তিনি সিলেটের রাজনীতিতে একটা বড় ধাক্কা দিতে পেরেছেন এবং বিজয়ীও হয়েছেন।
রাজনীতিটা এ রকমই। জামায়াত কিংবা হেফাজতে ইসলামের মতো সংগঠন, যারা রাজনীতিতে নিজেদের ইসলামী দর্শন, আল্লাহর আইন কিংবা সৎ লোকের শাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের কথা বলে সভা-সমাবেশে, তারাই উচ্চারিত দুর্নীতিবাজকে (এমনকি দলীয় নেত্রীও স্বীকার করেছেন) নিয়ে নির্বাচন করলেন! জামায়াতের নিজস্ব শক্তি-ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তারা ভোটের রাজনীতি থেকে সরে গিয়ে আরিফকে সমর্থনই দিল, যদিও তারা তিনটি কাউন্সিলর পদও বাগিয়ে নিয়েছে। অর্থাৎ, রাজনীতির প্রয়োজনে তারা আবারও সেই মিথ্যাচার করে আরিফকে সমর্থন দিল।
সারাদেশে কিন্তু এ রকম ঘটনাই ঘটছে। চারটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের চিত্রও মূলত এ রকমই। এমনকি কাউন্সিলর পদগুলোতেও আওয়ামী লীগ আগের চেয়ে ভালো করেনি। সব মিলিয়ে রাজনৈতিকভাবে এ এক বড় ধরনের ধাক্কা আওয়ামী লীগের জন্য। তাদের কর্মীরাও যেন এজন্য প্রস্তুত ছিলেন। জাতীয় রাজনীতিতে শেয়ার মার্কেট, হলমার্ক, ডেসটিনি ইত্যাদি মধ্যবিত্তদের নানাভাবে আঘাত করেছে। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ ব্যর্থ হয়েছে তাদের সার্থকতার কথাগুলো মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে। সেজন্যেই বলতে হয়, এ নির্বাচন আসলেই আওয়ামী লীগের জন্যে অশনি সংকেত। প্রগতিশীলদের জন্যেও এটি একটি দুঃসংবাদ।
আওয়ামী লীগ কিংবা দলীয় নেত্রী কি আগামী নির্বাচনে মাসলম্যান কিংবা বাণিজ্য নির্ভর রাজনীতিবিদদেরই মনোনীত করবেন, নাকি আওয়ামী লীগ থেকে সরিয়ে দেওয়া কিছু দক্ষ নেতা কিংবা তৃণমূলের সঙ্গে কাজ করা আওয়ামী লীগ নেতাদের দিয়ে আগামী সংসদের প্রার্থী মনোনয়ন দেবেন, তা-ই এখন দেখার পালা। সিটি করপোরেশন নির্বাচন দলের জন্যে একটি রেড সিগন্যাল। এই সিগন্যাল থেকে যদি দলটি শিক্ষা না নেয়, তাহলে দলও চলে যাবে বিরোধী দলের সারিতে আর দেশটার বহু কাঙ্ক্ষিত এজেন্ডাগুলোর বাস্তবায়নও অপূর্ণই থেকে যাবে।
ভোটের মধ্য দিয়ে জনগণ আওয়ামী লীগকে সরালো ঠিকই, কিন্তু তারা কি জয় ছিনিয়ে আনতে পারলো? কেবল অনেক ক্ষোভ বা অপ্রাপ্তি থেকে ব্যক্তিবদল করলেন। ব্যক্তির এ পরিবর্তনকে কোনোভাবেই জনগণের বিজয় বলা যাবে না। এ ভোটও যেন প্রমাণ করলো, ষোল কোটি মানুষের মাঝে আর অন্য কোনো সংগঠিত শক্তি নেই। নেই কোনো স্বচ্ছ-সুন্দর কণ্ঠ কিংবা বিপ্লবী কোনো আহবান, যারা আসলেই মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে পারে।
৩
নির্বাচন হয়েছে। এ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়েছে এবং বিজয়ী হয়েছে। অথচ ইতোমধ্যে কয়েকটি সংসদীয় উপ-নির্বাচন হয়েছে। সেগুলোতে তারা অংশ নেয়নি। যুক্তি দেখিয়েছে নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিয়ে, নিরপেক্ষতা নিয়ে, স্বচ্ছতা নিয়ে। কিন্তু সিটি নির্বাচনে তারা অংশ নিলো ঠিকই। অনেকেই হয়তো প্রশ্ন তুলতে পারেন, এ নির্বাচন তো দলীয় ব্যানারে হয়নি, তাই অংশ নিয়েছ। কিন্তু মানুষকে আর কত বেকুব ভাববেন আমাদের নেতা-নেত্রীরা?
নৌকা আর ধানের শীষের বদলে আনারস, তালা, কলস দিলেই কি রাজনৈতিক চরিত্র বদলে যায়? বলা হয়ে থাকে, স্থানীয় এ নির্বাচন কোনো দলীয় পক্ষপাতিত্বে হবে না। অথচ সবকিছুই পরিচালিত হয় দলের কিংবা দলনেতাদের নির্দেশে। মিডিয়াকেও তো কোনোরকম বাধ্যবাধকতা মানতে হয় না, কারণ তথ্য মন্ত্রণালয় কিংবা সরকার এমনকি নির্বাচন কমিশন থেকেও কোনো শক্ত নির্দেশনা দেওয়া হয় না। সেজন্যেই দলীয় পরিচিতি দিয়েই নির্বাচনী নিউজগুলো প্রচারিত হয়। জনগণও রাজনৈতিকভাবেই বিচার-বিশ্লেষণ করেছে এ নির্বাচনকে। সুতরাং, দলের বাইরে এ নির্বাচন হয়েছে বলে পার পাওয়া যাবে না।
দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এ নির্বাচনকে মূল্যায়ন করে হিসাব-নিকাশ করা হচ্ছে আগামী নির্বাচনের। সরকার প্রমাণ করে দিয়েছে, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন দিয়ে নির্বাচন সম্ভব এবং এ জায়গায়ই তারা বিজয়ী হয়েছে। সেজন্যেই দেশে-বিদেশে তা প্রশংসিত হয়েছে। বিএনপির এখন কি সন্দেহের মধ্যে থাকা উচিত হবে?
তত্ত্বাবধায়ক ইস্যু সংসদেই মীমাংসা হয়ে গেছে। দেশ-জনগণও এ ইস্যুর দিকে আর গুরুত্ব সহকারে তাকাতে চাইবে না। কারণ, এ পর্যন্ত যতোগুলো নির্বাচন করেছে সরকার, স্থানীয় নির্বাচনগুলোর সব কটিতেই স্বচ্ছতা দেখাতে পেরেছে। তাই সরকারেরও আর তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে ফিরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। এবং এর দাবিটিও আর কল্কে পাবে না দেশে, এমনকি দাতাগোষ্ঠীগুলোও এতে আর পাত্তা দিতে চাইবে না। সুতরাং অহেতুক এ ইস্যু নিয়ে রাজনীতি আর টকশো’র মাঠ ঘোলা করে হরতাল-মিছিল করা মানে জনগণের আকাঙ্খার বিপরীতে অবস্থান নেওয়া।
এ প্রসঙ্গে বিবিসি সংলাপের একটি উক্তি তুলে ধরতে চাই। সম্প্রতি বিবিসি সংলাপে বিএনপির আ স ম হান্নান শাহ সরকারের সাম্প্রতিক সন্ত্রাস দমন আইন প্রসঙ্গে পুলিশের অত্যধিক ভূমিকার কথা তুলে একে কালো আইন হিসেবে অ্যাখ্যায়িত করেন। তখন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াৎ হোসেন একটা পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন- আপনারা ক্ষমতায় গেলে এ আইনটি কি তুলে নেবেন? উত্তরে হান্নান শাহ্’র কাঁচুমাচু ভাব তখন আমাকে বিস্মিত করলো। তিনি বললেন, “আমরা বিবেচনায় নেবো। ” অর্থাৎ যে আইন দলকে যতোক্ষণ শক্তি দেবে, ততোক্ষণ তারা এর পক্ষে।
৪
রাজনীতিতে এখন চলছে আরেক নতুন মেরুকরণ। খালেদা জিয়া কিংবা এরশাদের বৈঠক নিয়ে যে প্রচার-প্রচারণা ডানা মেলেছে রাজনীতির আকাশে, তা আর গুজবে সীমাবদ্ধ থাকবে না। এরশাদ এবার মরণ কামড় দেবেন তার মূল্যায়নের জন্য। তিনি এবার সিঙ্গাপুর সংলাপে একটা নির্দেশনা নিয়েই আসবেন।
তবে কোন পাল্লায় উঠবেন এরশাদ? বিএনপি ধানের শীষ এখন আন্দোলিত হচ্ছে ফুরফুরে হাওয়ায়। আওয়ামী লীগকেও ভাবতে হবে। রাজনীতিতে জনগণের কাছে যেতে আবারও তাদের সামনে নতুন পরীক্ষা। সময় মাত্র পাঁচ মাস।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক
ই-মেইল: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৩১৮ ঘণ্টা, জুন ১৯, ২০১৩
সম্পাদনা: হাসান শাহরিয়ার হৃদয়, নিউজরুম এডিটর ও অশোকেশ রায়, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর, জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর- [email protected]