প্রতিবারই ‘নাইন ইলেভেন’ চলে আসে যখন, হঠাৎ করেই যেন সেই পুরনো স্মৃতিতে এক ঝলক ঘুরে আসি। স্মৃতির আয়নায় স্পষ্ট দেখতে পাই ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের সেই জমজ দুটো দালান ঠিক যেন জড়াজড়ি করেই দাঁড়িয়ে আছে।
মঙ্গলবার, সেপ্টেম্বর, ২০০১। নিউইয়র্কের আকাশে তখন ঝলমলে রোদ। ঠিক সকাল নয়টার দিকেই আমাদের প্রতিদিনের ‘স্ট্যান্ড আপ’ মিটিং শুরু হয়। অন্যান্য দিনের মতই আমরা সেদিন কফি, ডোনাট আর বেগেল সহযোগে কনফারেন্স টেবিলে বসে আছি। আমার অফিসের নাম ডিয়াম ইউএসএ। নিউইয়র্কের ইস্ট রিভারের ঠিক নদীর পাড়ে অর্থাৎ কুইন্সের দিকে ছিল এর অবস্থান। নদীর ওপারেই ম্যানহাটন। ফলে, আমরা অফিসে বসেই নদীর ওপারের টুইন টাওয়ার স্পষ্ট দেখতে পেতাম। সত্যি বলতে প্রতিদিন ভোর বেলায় অফিসে বসে নিউইয়র্কের আকাশ ফুঁড়ে এমন দুটো জমজ উচু দালান দেখতে কার না ভালো লাগে? অফিসের মিটিং যথারীতি শুরু হয়ে গেছে। আমি তখন সেখানকার ফাইনান্সিয়াল এনালিস্ট। হঠাৎ করেই অফিসের বাইরে একটা মৃদু হৈচৈ শোনা গেল। আমাদের অনেক সহকর্মীদেরকেই দেখছিলাম হন্তদন্ত হয়ে ছুটোছুটি করছেন, আর ফিসফাস করে কীসব যেন বলছেন। এমন সময় আমাদের অফিসের ভারতীয় দারোয়ান বাসু থাম্পাই দরজায় টোকা দিয়ে কনফারেন্স রুমে ঢুকে আমাদের জানালেন, বিমানের পাখা লেগে টুইন টাওয়ারের একটা দালানে আগুন ধরে গেছে। সে আরো বললো, বিমানের পাখা উঁচু দালানের চূড়ায় বাড়ি খাওয়ার কারণে নাকি বিমানটি ম্যানহাটনের রাস্তায় পরে গেছে। আমাদের সবার চোখ সপ্তম আকাশে উঠে যায়। বলে কি লোকটা? তখন কিসের আর মিটিং?
অফিসের আমরা সবাই জড়ো হলাম ইস্ট নদীর পারে। তাইতো! টুইন টাওয়ারের একটা দালান থেকে আগুন আর কালো ভুসভুস ধোঁয়া বেরিয়ে আসছে। ভয়ে তখন আমাদের সবারই বুকের রক্ত জমে গেল। বিমানের হতভাগা যাত্রীদের করুণ ভাগ্য নিয়ে তখন আমরা পারস্পরিক বলাবলি করতে লাগলাম। সবাই ধরে নিয়েছিলাম যে ওটা একটা বড় ধরনের দুর্ঘটনা ছাড়া আর কিছুই না। আর সেই সময় এর চেয়ে বেশি কোনো তথ্য আমাদের জানবার কথাও ছিল না। টিভি, রেডিওর ব্রেকিং নিউজগুলোতে আমরা সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। মিডিয়াও ঠিক এ ধরনের সংবাদই পরিবেশন করে যাচ্ছিল। আর সে কারণেই হয়তো উপস্থিত সবাই কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে নিজেদের মতো মনগড়া তথ্য দিতে লাগলেন। কিন্তু ভয়াবহ আরেকটি মুহূর্তের জন্য খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হলো না। মিনিট পনেরোর মধ্যেই চোখের সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে একটা উড়োজাহাজ এসে দাঁড়িয়ে থাকা দ্বিতীয় দালানের পেট বরাবর ঢুকে পড়লো। কি সাংঘাতিক সে দৃশ্য! রুপালি ইলিশের মতো ঝকঝকে একটা আস্ত উড়োজাহাজ ঢুকে পড়ছে টুইন টাওয়ারের দাঁড়িয়ে থাকা দ্বিতীয় দালানের ভেতরে, তাও আবার পৃথিবীর রাজধানী ম্যানহাটনের মতো ব্যাস্ততম একটা শহরে? এবার সত্যিই সবার চোখে নেমে এল আতঙ্কের ছায়া।
তাহলে এটা তো কোনো দুর্ঘটনা নয়! আমেরিকার ওপর আক্রমণ। এ তো সাক্ষাত যুদ্ধ!! চারপাশে শত শত জনতা তাদের অফিস কক্ষ, বাড়ি-ঘর, দোকান পাট বন্ধ করে রাস্তায় নেমে এলেন। সবার চোখে-মুখে আতঙ্ক! আমাদের সিইও ফ্রেড ডিভিটো ত্বরিৎ অফিস ছুটির ঘোষণা দিয়ে দিলেন। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে কে বাড়ি যায়? সবাই তখন নদীর পার ঘেঁষে ভয়ে আর উৎকণ্ঠায় জড়ো হতে লাগলেন। এদিকে এবার টিভি/রেডিও থেকে ব্রেকিং নিউজ দিল যে টেররিস্টদের আক্রমণে টুইন টাওয়ার ধ্বংস হয়ে গেছে। কী বলবো! সত্যি বলতে সেই সময়টাকে ধারণ করার মতো সঠিক কোনো শব্দ আমি খুঁজে পাচ্ছি না। সবার চোখে মুখে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো। কেউ কেউ বললো, ম্যানহাটনের আরো অনেক বিল্ডিংয়ে নাকি এমন আক্রমণ চলবে। তার মানে আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা? কিন্তু কারা তারা?
এদিকে আমাদের চোখের সামনে বীরদর্পে উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দুটো দালানই ধীরে ধীরে মাটির সাথে ছাই হয়ে মিশে গেল। নদীর এপার থেকে দেখা যাচ্ছে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের জায়গাটা প্রচন্ড কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। গোটা ম্যানহাটনই যেন কালো ধোঁয়ার চাদরে ঢেকে গেছে। চারপাশে হাজার মানুষের ভিড় আর আর্তনাদ। রাস্তায় পুলিশের গাড়ি আর এম্বুলেন্সের সাইরেনের বিকট শব্দ। মনে হচ্ছিল যেন সাক্ষাত কেয়ামত। কেউ কেউ বলছিল যে দেশে যুদ্ধ লেগে গেছে। এরইমধ্যে টের পেলাম, আমাদের মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক কানেকশন বন্ধ হয়ে গেছে। আত্বীয়-স্বজন কারো সাথে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। শহরের নিরাপত্তা রক্ষার জন্যে সরকার সব রকম সরকারি/বেসরকারি গণ পরিবহন বন্ধ ঘোষণা করে দিল। বাস বন্ধ, পাতাল ট্রেন বন্ধ। এবার সবার দৃষ্টি ম্যানহাটনের দিকে। সবারই কোনো না কোনো আত্বীয়-স্বজন ম্যানহাটনে চাকরি ও বসবাস করেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই তাদের জন্য উদ্বিগ্ন হয় কাছের স্বজনরা। এই লোকগুলো এত দূর রাস্তা পেরিয়ে পায়ে হেঁটে বাড়ি পৌঁছাবে কিভাবে? এদিকে ম্যানহাটনের সব অফিস আদালত ছুটি হয়ে যায়। ছুটি হওয়ার সাথে সাথেই অগুনিত জনতা পায়ে হেঁটে যে যার মতো বাড়িঘরে যাওয়ার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তখন সকাল দশটা কি এগারটা হবে। ম্যানহাটন থেকে কুইন্স বা ব্রুকলিনে আসার জন্যে কয়েকটা বড় বড় ব্রিজ রয়েছে। কুইন্সে আসার জন্য ৫৯ স্ট্রিট কুইন্স ব্রিজ এবং উলিয়ামবার্গ ব্রিজ, ম্যানহাটন থেকে ব্রুকলিনে আসার জন্যে ম্যানহাটন এবং ব্রুকলিন ব্রিজ। ব্রিজগুলোতে তখন হাজার হাজার মানুষের লম্বা লাইন। দেখলে মনে হবে যেন রিফিউজির দল। যুদ্ধের ভয়ে অন্য কোনো দেশে পালিয়ে যাচ্ছে।
সবাই উদভ্রান্তের মতো ছুটছে। রাস্তার পাশেই তখন দাঁড়িয়ে গেল কিছু স্বেচ্ছাসেবক দল। তারা পানির বোতল, জুস ইত্যাদি খাবার পরিবেশন করছিল। কেউ কেউ বয়স্কদেরকে রাস্তা পারাপারে সহযোগিতা করতে লাগলো। সে এক অন্যরকম দৃশ্য। তখন পর্যন্ত এই আক্রমণের মূলহোতা কে তা জানা যায়নি। তাছাড়া কাজটা যে মুসলমানরাই ঘটিয়েছে সেরকম নিশ্চিত কোনো তথ্য মিডিয়া তখনও দেয়নি। আমরা যারা মুসলমান ছিলাম সত্যি বলতে সেই সময়টায় আমরা আমাদের ধর্ম নিয়ে খুব একটা শঙ্কিত ছিলাম না। (যদিও এর চূড়ান্ত খেসারত আমাদেরকে পরে দিতে হয়েছে এবং এখনো দিতে হচ্ছে) । স্পষ্ট মনে আছে তখন আমি আমার পুরাতন পনটিয়াক সানবার্ড গাড়িটাকে নিয়েই জনসেবার কাজে নেমে পড়েছিলাম। তখন বয়সটা ছিল অল্প আর প্রাণে ছিল সাহস। মনে হচ্ছিল মানবতার জন্যে কাজে নেমে পরার এই তো সুবর্ণ সুযোগ! কাজটা ছিল সহজ। বেছে বেছে যারা বৃদ্ধ বা অসুস্থ তাদেরকে গাড়িতে উঠিয়ে তাদের নিজনিজ বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া। অনেকটা ফেরি পারপারের মতই। আর শুধু আমি কেন? আমার মতো অসংখ্য লোকজন যে যার মতো করে এই কাজে নেমে পড়েছে ততক্ষণে। সেসব স্মৃতি ভোলা যায়? নাকি ভোলা সম্ভব?
প্রতি বছরই নাইন ইলেভেন এলেই এ নিয়ে অনেক আলাপ আলোচনা হয়, সেমিনার হয়, স্মৃতিচারণ হয়। যুদ্ধবিরোধী কথা বার্তা হয়। মানবতার জন্য জয়গান হয়। তারপরও অবাক হয়ে লক্ষ্য করি যে মানুষ মানুষকে মারার জন্যে প্রতিদিনই কত রকম ফন্দি ফিকির করেই যাচ্ছে। প্রতিদিনই কত রকম আধুনিক অস্ত্র আবিষ্কার হচ্ছে! এদিকে নাইন ইলেভেনের ঘটনা নিয়ে অনেক কানাঘুষা বাতাসে ভেসে আসে। কেউ কেউ দাবি করে ওই ঘটনার জন্য নাকি খোদ আমেরিকানরাই দায়ী। কেউ বলে টেররিস্ট মুসলমানরাই দায়ী। আর আমি বলি, এর পেছনের নায়ক যেই হোক না কেন ওই ঘটনাটা ছিল মানবতার প্রতি এক চরম হুমকি আর অন্যায়। এই অন্যায়ের প্রতিবাদ জানানোর ভাষা কি আমাদের সত্যি জানা আছে?
লেখক: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী, [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ০০২০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১১, ২০১৩
টিকে/জিসিপি