ঢাকা, রবিবার, ২৩ আষাঢ় ১৪৩১, ০৭ জুলাই ২০২৪, ২৯ জিলহজ ১৪৪৫

মুক্তমত

এই আমাদের বাংলাদেশ

শিবলী নোমান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১২৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৭, ২০১৩
এই আমাদের বাংলাদেশ

লাগাতার হরতালের হুমকির মুখেই কলকাতা গিয়েছিলাম। বাংলাদেশের শুভাকাঙ্ক্ষী অনেক মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়।

তাঁদের জানবার বিষয় একটাই- কী হচ্ছে বাংলাদেশে? আমি কী জবাব দেবো? প্রান্তিক সংবাদকর্মী আমি, খুব বেশি কিছু বলার মতো আমার ঝুলিতে ছিলো না। কিন্তু সংবাদ কি এপারেই শুধু থাকে?

কলকাতায় বসেই সেখানকার কাগজগুলো থেকে জানছিলাম, বাংলাদেশের বিভীষিকাময় সংবাদগুলো। আরও কদিন থাকার কথা ছিলো। কিন্তু আবার টানা হরতালের মুখে পড়ার ভয়ে আগেই চলে আসি।

দেশে ফেরার পর থেকে ভাবছিলাম, মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অজিত এই রাষ্ট্রটাকে আমরা দিনে দিনে কোন দিকে নিয়ে চলেছি? বাইরের গণমাধ্যমের কাছে আমরা যেনো ক্রমেই একটা নেতিবাচক দৃষ্টান্ত হয়ে উঠছি। বাইরের গণমাধ্যমের কথা আর কী বলবো? নিজের দেশেই বা আমরা কতোটা নিরাপদে আছি? ঘরে বসে ডেকে দেয়া হরতাল কিংবা অবরোধ এখন যতো না রাজনৈতিক, তার চেয়ে বেশি সন্ত্রাসী কর্মসূচি হয়ে উঠেছে। চারিদিকে বোমা-ককটেল, মানুষ মারার মহোৎসব যেনো।

একেকটা লাশ পড়ে একেকদিন আর ভয়াবহ আতঙ্ক গ্রাস করে মানুষকে। ছেলেবেলায় মুনতাসীর মামুনের একটা বই পড়েছিলাম, ‘এই আমাদের বাংলাদেশ’। অসাধারণ সেই বইটি পড়ার পর আমার মনে হয়েছিলো আমৃত্যু যেনো এই মাটিতেই থাকতে পারি। বইটার শুরুতেই ছিলো আমার প্রিয় সেই গানটি, যার কয়েকটি চরণ আমার ভীষণ প্রিয়: ‘ভায়ের মায়ের এতো স্নেহ/কোথা গেলে পাবে কেহ/ও মা তোমার চরণ দুটি বক্ষে আমার ধরি/এই দেশেতে জন্ম যেনো/এই দেশেতেই মরি/ এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না কো তুমি...’।

আমি আজো এই গান গাই, গুণগুণ করে, যখন হরতাল বা অবরোধে যেকোনো সময়ই লাশ হয়ে যেতে পারি- সেই আতঙ্ক নিয়ে কাজ করে যাই। কিন্তু তারপরেও ইদানিং যেনো মাঝে মাঝে নিজেকেই প্রশ্ন করতাম- এই কি আমাদের বাংলাদেশ? কখনো কখনো হতাশার গভীরে ডুবে যেতাম। আমার ঘনিষ্ঠ মানুষ আরিফ ভাই আমাকে প্রায়ই বলেন, ‘জনগণের ওপর আস্থা রাখতে হয়। হতাশ হবেন না। ’

আমি জনগণের মাঝে চেয়েও কোনো আশা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমি আমার নিজের দিকে তাকিয়েও বারবার হতাশ হয়ে পড়ছিলাম। রাতে বিছানায় ঘুমুতে যাবার আগে ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে ভাবতাম- ‘এই বাংলাদেশই কি রেখে যেতে হবে তোদের জন্য? তোরা কি আমাদের ক্ষমা করবি?’

দেশের ভেতরে কিংবা বাইরে- সবখানেই যেনো নেতিবাচক বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু হঠাৎই আজ আমি যেনো আশার আলো খুঁজে পেয়েছি। কার কাছ থেকে? না কোনো রাজনীতিক, সুশীল সমাজের বিজ্ঞ প্রতিনিধি কিংবা মধ্যরাতের টিভি টকিস্টদের কাছ থেকে নয়? কোত্থেকে জানেন? সেই জনগণের কাছ থেকেই। আম জনতা্, যাকে বলে।

শিক্ষিত রাজনীতিকদের মুখ থেকে আসা কর্মসূচির নামে সন্ত্রাসের অংশ হিসেবে যখন দেশজুড়ে রেললাইন উপড়ে ফেলার মহোৎসব চলছে। যখন আমাদের রাজনীতিবিদরা ভুলে গেছেন, এই উপড়ে ফেলা লাইনে যে ট্রেন লাইনচ্যুত হচ্ছে, সেখানে আমরা, এই বাংলাদেশের আম জনতাই চলাফেরা করি। তারা যখন আমাদের জীবনকে গণনার মধ্যেই আনতে চাইছেন না, তখনই ঠিক দৃষ্টান্ত হয়ে দেখা দিলেন কৃষক তাজুল।

বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ অনলাইন সংবাদপত্র বাংলানিউজ ছেপেছে একেবারে অতি সাধারণ এই মানুষটির কথা। বুধবার অবরোধে চাঁদপুরের উরায়ুক ও মেহের স্টেশনের মাঝখানে এক জায়গায় লাইন তুলে রেখে দেয় অবরোধ সমথকরা। প্রতিদিনের মতো কৃষক তাজুল ভোরে ফজরের নামজ পড়ে মাঠে কাজ করার জন্য বেরিয়ে দেখতে পান লাইন উপড়ানো।

শুনতে পাচ্ছেন কোনো একদিক থেকে আসছে ট্রেন। হুঁইসেল শুনছেন তার। যাত্রীবোঝাই ট্রেনটাকে বাঁচাতে এক দৌড়ে বাড়িতে গেলেন। নিয়ে এলেন লাল রঙের একটি পেটিকোট। এরপর সবুজের সমারোহের মাঝে ছুটে চলা ট্রেনটাকে থামানোর জন্য সজোরে লাঠির আগায় সেই কাপড় বেঁধে নাড়তে থাকেন। থেমে যায় চাঁদপুর থেকে চট্টগ্রামগামী মেঘনা এক্সপ্রেস। রক্ষা পায় পাঁচ শতাধিক যাত্রীর প্রাণ। স্টেশন মাস্টার এই মানুষটিকে খুশি হয়ে কিছু টাকা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি সবিনয়ে তা প্রত্য্যাখ্য্যান করে জানান, মানুষের দোয়াটাই বড়। সেটা নিয়েই তিনি আজীবন কাটাতে চান।

খবরটি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার কী যেনো হয়ে গেলো। আমার গলায় কী যেনো আটকা আটকা লাগছিলো। ফেসবুকে খবরটিার লিংকসহ লিখলাম : ‘Hatts off to you. পল্টনের ঘরে বসে আমাদের রিজভী ভাই যে কর্মসূচির ঘোষণা দেন, তিনি আমাদের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েছেন। আরো যারা আছেন, তারাও যে উচ্চ শিক্ষিত, বলাই বাহুল্য। তারপরেও দেশের কোটি মানুষের জীবন নিয়ে ভাবার অবকাশ যে তাদের নেই, তা বোঝাই যায়।

তা না থাক। তারপরেও আমরা হতাশ হবো না। কারণ আমাদের জীবন বাঁচাতে দেশে কোটি তাজুল আছেন, যাদের ঘাম শ্রমে আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল থাকে। আমরা খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকি। এই আমাদের বাংলাদেশ। এই আমাদের জনতা। এই আমাদের শক্তি। আমরা আমজনতা বেঁচে থাকবো হয় এই শক্তির অংশ হয়ে, নইলে তাদের ওপর ভরসা করে। also thanks to banglanews...` দেশের বাইরে কিংবা ভেতরে যতোই নেতিবাচক ধারণা তৈরি হোক, যতোদিন তাজুলের মতো কোটি জনতা বেঁচে আছেন, ততোদিন বাংলাদেশ বেঁচে থাকবে মাথা উঁচু করে।

শিবলী নোমান: দৈনিক সমকালের রাজশাহী ব্যুরো প্রধান।

বাংলাদেশ সময়: ২১২৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৭, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।