ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

ভয়াবহ বিপর্যয় মুক্তি ও একুশের শক্তি

অজয় দাশগুপ্ত, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭১০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৪
ভয়াবহ বিপর্যয় মুক্তি ও একুশের শক্তি

ঢাকা: ভাষা সংগ্রামে জয়ী হবার পর আমাদের দেশ স্বাধীন হতে লেগেছিল ১৯ বছর। আজ স্বাধীনতার ৪৩ বছরেও ভাষার মুক্তি মেলেনি।



যারা বই মেলা আর শহীদ মিনারভিত্তিক বাংলা চালুতে মজে আছেন তাদের কথা ভিন্ন। সাধারণ মানুষের মনে ভাষার মুক্তির জন্য যে শিক্ষা তা এখনো অধরা। অধরা আমাদের অসাম্প্রদায়িকতা। সে কারণে আজ একুশের ঠিক আগের প্রহরে আমরা আমাদের দেশের গুরুত্বপূর্ণ একটি  আঞ্চলিক পর্যায়ের নির্বাচনে জামায়াতের জয় দেখছি।

জামায়াতের এই জয় আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে, সমর সংগ্রাম এক বিষয় তাকে চিরকাল উন্নত রাখা বা বজায় রাখা আরেক। গেল বছর দেশ জুড়ে যে তাণ্ডব আর ধ্বংসলীলা তাতে দুভাগে ভাগ হয়ে পড়া দেশটি ছিল অসহায় আর একা।

এমনটি হবার কথা ছিল না। অন্তত একুশের চেতনা আর ভালোবাসা থাকলে এ জাতীয় দূর্ঘটনা ঘটার কথা নয়। ঘটেছে বা আরো যে ঘটবে তার কারণ বুঝতে খুব বেশী মেধার দরকার পড়ে না।

উপজেলা নির্বাচনের প্রথম দফায় জামাতের বিজয় বলে দিচ্ছে আমাদের জাতীয় মুক্তি বা একুশের চেতনার বিস্তার হয়নি। মিডিয়া জুড়ে তোলপাড় করা বুদ্ধিজীবী ও তার্কিকরা যে ভাবেই বিশ্লেষণ করুক না কেন আসলে আমাদের সমাজে ধর্ম ও ধর্মের নামে যে শিক্ষা ব্যবস্থা সেটাই কাল। ‍

সে কাল আজ কাল সাপ হয়ে বাংলাদেশ ও ভাষাকে দংশন করছে। একুশের চেতনা বা একুশের অবদান মিশেছে ছোট থেকে ছোট কোন বিন্দুতে। কারো কাছে তা নতুন বই প্রকাশের মাস। কারো কাছে চ্যানেলে চ্যানেলে ঘুরে টক শো করার মাস। কারো কাছে দেশ বিদেশে শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠার নামে আত্ম গর্বের মাস। কারো কাছে প্রতিভার পাশাপাশি পুরস্কার পাবার ও বটে। এই জাতীয় ধারা দেশ বিদেশে একুশের দিনটিকে ঘিরে উন্মাদনা দিলেও আখেরে আজ আমরা ঘোর র্দূদিনে আছি।

আমি মনে করি শাপলা চত্বরে যে সমাবেশটি হয়েছিল তার কাছ থেকেই এর সমাধান খুঁজতে হবে। এক দেশে দুধরনের বা তিন ধরনের পাঠক্রম মানুষকে মানুষ হতে দেয় না। শাপলা জুড়ে সমবেত যৌবনের কেউই আমাদের অচেনা বা পর নয়। এরা আমাদের সন্তান। আমাদের পরিবারের ছেলে।

যে ছেলেটি লেখা পড়ায় মন্দ যার মেধা কম তাকে মাদ্রাসায় পাঠিয়ে স্বর্গের দুয়োর খুলতে চাওয়া অভিভাবকরা আসলে জাতীয় অপমান আর সর্বনাশের দুয়ার খুলে দিয়েছেন। মাদ্রাসা বিরোধিতা নয় মাদ্রাসার আধুনিকতা আর তার অতীত গৌরবকে ঢেলে সাজিয়ে নতুন সময়োপযোগী করাই ছিল কাজের কাজ।

সেটা করিনি আমরা। পরিবারে চার পাঁচ জন সন্তান থাকলে মেধাবীকে ভালো স্কুল কলেজে পাঠিয়ে যেটাকে অচল মনে করা হয় সেটিকে মাদ্রাসায় পাঠানো নিশ্চয়ই ধার্মিকের কাজ নয়।

অথচ ধর্মের নামে সেটাই করা হচ্ছে আকছার। যার ফলে শাপলার সমাবেশ মুক্তিযুদ্ধের বিপরীতে দাঁড়ানোর স্পর্ধা দেখাতে পেরেছে। যারা এসেছিল তারা মূলত অসহায়। তাদের না আছে বোধ না বিবেক জাগানোর মত লেখা পড়া। সমাজের এক বিশাল অংশকে দিনের পর দিন অন্ধত্ব আর কুসংস্কারে ঠেলে দিয়ে একুশের গৌরব বা ভাষা ভিত্তিক রাষ্ট্রের অগ্রযাত্রা অসম্ভব।

একটা কথা বলতেই হবে আমরা বাঙালিরা নিজেদের কোন ধর্মাচারণ করিনা। আমাদের সকলের ধর্ম বিশ্বাস ও আচরণ অন্য কোন দেশ বা ভূমি থেকে পাওয়া। সেটা দোষের কিছু নয়। রাজতন্ত্র সামন্ততন্ত্র এমনকি সাম্যবাদ বা গণতন্ত্র ও নানা দেশ বা জাতির কাছ থেকে আসা বিশেষ বিশেষ ব্যবস্থা ধর্মগুলোও তাই।

ফলে এর সবটাই আমাদের মত নয়। কোনটার কিছু মেলে কোনটার অনেক কিছুই মেলেনা।
এজন্যে ইন্দোনেশিয়া মালয়েশিয়া বা ভারতে বসবাসকারী একই ধর্মের মানুষদের নাম খাবার গান বাজনা আচার আচরণ সব পৃথক। এই পৃথক সত্তা তাদের আরো সুন্দর করেছে। দিয়েছে বৈশিষ্ট্য আর পরিচয়। আমাদের দেশেও তাই ছিল। ছিল বলেই আমরা এক দেশ হবার পর ও তখনকার অবিসংবাদিত নেতা জিন্নাহর কথা মানিনি। মানলে তো ভাষা থাকত না আর বাংলাদেশ? তার প্রয়োজনই পড়ত না কোন কালে।

আজকে হঠাৎ করে আমাদের দেশের এক শ্রেণীর মানুষ ১৮০ ডিগ্রি এঙ্গেলে ঘুরে দাড়াতে চাইছে, এদের কাছে জীবন ও ধর্ম একাকার। আমাদের যে কোন অর্জন বা অতীতের চাইতে দামী স্বর্গ নরক। বলাবাহুল্য এরা সবকালে সবসময়ই ছিল কিন্তু এতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। আজকের সমাজে এরাই হয়ে উঠছে নির্ণায়ক। এ বাস্তবতা কেবল রাজনীতির কারণে এটাও ঠিক নয়। এর জন্য দায়ী আমাদের গোটা সমাজ ব্যবস্থা।

চল্লিশ পেরুলেই ভোল আর আদল পাল্টানো মধ্যবিত্তকে খুশী করতে গিয়ে রাজনীতি তার আদর্শকে বিসর্জন দিয়েছে। ভোটের বাক্সে টান পড়ার ভয়ে ধর্মকে এমন জায়গায় এনেছে আজ আর তাকে কিছু বলার সাহস বা শক্তি কোনটাই অবশিষ্ট নেই। শাপলার কথা বলছিলাম। সেই স্রোত একুশের শক্তি বা মর্যাদা বোঝে না। শহীদ মিনার তাদের কাছে বেদী।

ফুল মানে পূজা আর মিনার ভাঙ্গা মানে পূণ্য। এদের শক্তিকে ছোট করে দেখার কারণ নেই। এরা আমাদের সমাজের অনিবার্য অংশ। এদের বাদ দিয়ে আমরা আরেক পাশে সমবেত হলেই সমাধান মিলবে না। যে দিকটা আধুনিক যে দিকটা মুক্তিযুদ্ধের জন্য গৌরবান্বিত যে দিকটা আমরা দেখতে ভালোবাসি। মিডিয়ায় দেখাই তার প্রচার জরুরী হলেও আরো জরুরী তার সাথে শাপলার সমন্বয়। সেটা না করতে পারলে একুশের এই উচ্ছ্বাস আস্তে আস্তে তার দীপ্তি হারিয়ে ফেলবে। এবং তা প্রায় সত্য হতে চলেছে।

সমাজের একটি অংশ আরেকটি অংশের সাথে নিয়ত মারামারি আর সংঘাতে থাকলে উভয়ের শক্তি হ্রাস পায়। এই হ্রাস প্রাপ্ত শক্তি একুশের চেতনায় সমাজ গড়তে পারবেনা। একদিকে ধর্মীয় পাঠক্রম অন্যদিকে বাংলা ভাষাকে ঘিরে একধরনের ফলাফলহীন আবেগ আসলেই দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এ দুয়ের সমন্বয় করতে হলে দূরত্ব কমানোর কাজ শুরু করার বিকল্প নাই। যেহেতু ধর্মীয় রাজনীতি গোঁড়া এবং তারা অনেক বেশী অনুদার তাদের দিক থেকে এ বিষয়ে কোন আহ্বান আশা না করাই ভালো। তা হলে দায়িত্ব আমাদের। সেই গল্পের মত যার সন্তান তার দায় সে ভাবেই এগুতে হবে আমাদের।

বিশ্বাস করুন একুশের চেতনা আজ  আবারো মুক্তি চায়। তার প্রাণ ভোমরা বন্দী হয়ে আছে ধর্মের খাঁচায়। মানুষের কাছে বাঙালি বা অসাম্প্রদায়িক  হবার আগ্রহ কাজ করছে না। এই বাস্তবতায় বই মেলা বা একুশের দিনটিকে ঘিরে উন্মাদনায় মুক্তি নেই। এই ক্রান্তিকালে একুশ কিন্তু তার শক্তি নিয়েই আমাদের জন্য হাত বাড়িয়ে আছে। আমরা যদি বাংলাদেশ কে মুক্তিযুদ্ধের দেশ ও ভাষাকে আমাদের হাতিয়ার করতে চাই তা হলে আরো একবার আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে সমাজকে মুক্ত করার কাজ করতে হবে। এই সমাজ আজ অবরুদ্ধ। এই জাতি আজ দিশেহারা। এই দেশ এগুতে চাইছে এই তারুণ্য ছড়িয়ে পড়তে চাইছে। কিন্তু তার একদিকে ধর্ম একদিকে উদারতা আরেক দিকে সংশয়। জানিনা কে তাদের পথ দেখাবে বা দেখাতে পারবে। এটুকু জানি একুশের সে শক্তি ফুরোয়নি। আমরা চাইলে এখনো পারি। পারার জন্য যে ত্যাগ তার দায় নিতে পারাটাই এখন মূল বিষয়। অমর একুশে আমরা আবারো আশায় বুক বেঁধে দাঁড়াতে চাই। জাতির জন্যে। দেশের জন্যে। মানুষের জন্যে।

বাংলাদেশ সময়: ০৭০৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।