ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

মুক্তমত

দ্রুত বাস্তবায়ন হোক গ্রেনেড হামলার বিচারের রায়

তপন চক্রবর্তী, ডেপুটি এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৫৬ ঘণ্টা, আগস্ট ২১, ২০২২
দ্রুত বাস্তবায়ন হোক গ্রেনেড হামলার বিচারের রায়

১৫ আগস্টের বর্বরতা ঘটেছিল মানুষের চোখের আড়ালে, রাতের অন্ধকারে। কিন্তু ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা হয়েছে প্রকাশ্য দিবালোকে।

এর মাঝখানের সব ঘটনাও সেই দিবালোকেই। ১৫ আগস্ট ও ২১ আগস্ট একই সূত্রে গাঁথা।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ বিচারের হাত থেকে খুনিদের রক্ষায় ‘ইনডেমনিটি অরডিন্যান্স’জারি করেন, যা ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমান আইন হিসেবে অনুমোদন দেন৷ এ ঘটনা জাতির ইতিহাসে কলঙ্ক হয়ে থাকবে চিরকাল। পাশাপাশি কোনো জনসভায় হামলা চালিয়ে একটি দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলের মূল নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার চেষ্টা চালানোর নজির ইতিহাসে বিরল।

চট্টগ্রাম সিইউএফএল ঘাটে ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল রাতে ১০ ট্রাক অস্ত্র ও গোলাবারুদের চালান আটকের ঘটনা অনেকটা আকস্মিক মনে হলেও এ ঘটনাও পূর্বপরিকল্পিত। দেশকে ব্যবহার করে উলফাদের (ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম) কাছে এসব অস্ত্র আনার ঘটনা দেশজুড়ে আলোচিত হয়। ওই বছরের ২১ আগস্ট ঢাকায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় প্রাণ হারান প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন, আহত হন কয়েকশ। অল্পের জন্যে বেঁচে যান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ট্রাকের ওপর তৈরি অস্থায়ী মঞ্চে বক্তব্য দেওয়ার সময় তাকে ঘিরে ছিলেন দলীয় নেতারা। সেই মানববর্মই বাঁচিয়ে দেয় শেখ হাসিনাকে। মাত্র দেড় মিনিটের মধ্যে সেদিন বিস্ফোরিত হয় ১১টি শক্তিশালী গ্রেনেড।
  
’৭৫-এর ১৫ আগস্ট ব্রিগেডিয়ার জামিল উদ্দিন আহমদ বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে গিয়ে জীবন দিয়েছিলেন। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুব বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার জীবন বাঁচাতে নিজের জীবন দিয়ে গেছেন। এ ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াতসহ চারদলীয় জোট সরকার সাজায় জজ মিয়া নাটক। কিন্তু পরে এ নাটকও রণে ভঙ্গ দেয়।

তদন্তে প্রমাণিত হয়, ২১ আগস্টের সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা ও হত্যাযজ্ঞ চালায় হরকাতুল জিহাদের একদল জঙ্গি। ওই নৃশংস হামলায় দেশি-বিদেশি বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন জড়িত ছিল। সংগঠনগুলো হচ্ছে- হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ (হুজি), কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন হিজবুল মুজাহিদীন, লস্কর-ই তৈয়বা এবং এগুলো সবই আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীগোষ্ঠী। তারা তৎকালীন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে। ঘটনার সঙ্গে বিএনপি সরকারের তৎকালীন উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন, মুফতি হান্নান, কাশ্মীরের হিজবুল মুজাহিদীনের নেতা ইউসুফ ওরফে মাজেদ বাটসহ অনেকে যুক্ত ছিলেন। এ ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া মুফতি হান্নানসহ জঙ্গিদের জবানবন্দিতে তা উঠে এসেছে। ২১ আগস্টের হামলাসহ জঙ্গিদের বিভিন্ন হামলায় কাশ্মীরি জঙ্গিদের জন্য পাকিস্তান থেকে আসা গ্রেনেডের একটি অংশ ব্যবহৃত হয়েছে বলে তারা আদালতকে জানায়।

২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এ সংক্রান্ত হত্যা ও বিস্ফোরক মামলা দুটির নতুন করে তদন্ত শুরু করে। ২০০৮ সালে ২২ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। তাতে বলা হয়, শেখ হাসিনাকে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে ওই হামলা চালিয়েছিল জঙ্গিরা। পরে আওয়ামী লীগ সরকার আমলে মামলার অধিকতর তদন্ত হয়। এরপর তারেক রহমানসহ আরও ৩০ জনকে আসামি করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।  

২০১৮ সালের ১১ অক্টোবর মামলার রায় দেন বিচারিক আদালত। রায়ে তদানীন্তন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন আদালত। আদালতের ওই রায়ে একই মামলায় অভিযুক্ত খালেদা জিয়ার বড় ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়, ১১ আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন আদালত। আসামিদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের জন্য মামলার বৃত্তান্ত প্রস্তুত হয়। রায় ঘোষণা করা হলেও হাইকোর্টে আসামিদের আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি এখনও বাকি রয়েছে। তাই ১৮ বছরেও শেষ করা যায়নি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার বিচারিক কার্যক্রম। আসামিদের ডেথ রেফারেন্স ও আপীল শুনানির জন্য বেঞ্চ নির্ধারণে প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন করা হয়েছে। শীঘ্রই এই মামলার আপীল শুনানি শুরু করা হবে বলে আইন মন্ত্রণালয় ও অ্যাটর্নি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘ক্ষমতায় গিয়ে খালেদা জিয়া গ্রেনেড হামলা চালানোর ষড়যন্ত্র করেছিলেন। ওই হামলার সঙ্গে জড়িতরা পরে জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছিল যে খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানও সেই ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিল’।

শেখ হাসিনাকে হত্যার লক্ষ্যে হাওয়া ভবনে যে বৈঠক হয়েছিল, মুফতি হান্নানের সে সংক্রান্ত সাক্ষাৎকার দেখলে সবকিছু স্পষ্ট হয়। মুফতি হান্নান গ্রেনেড হামলার বর্ণনা করে বলেছেন, বিএনপি-জামায়াত জোট শাসনামলে হাওয়া ভবনে বসে হামলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ওই বৈঠকে জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ (যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসি কার্যকর), তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনি নুর চৌধুরীসহ কয়েকজন জঙ্গি নেতা উপস্থিত ছিল। তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুও জড়িত ছিলেন এ ঘটনায়।  

মুফতি হান্নান জবানবন্দিতে বলেন, ‘হামলার মূল পরিকল্পনাই ছিল শেখ হাসিনাকে নিশ্চিহ্ন করা। যার পরিকল্পনায় ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি নুর চৌধুরী এবং তারেক জিয়া। গোপন চারটি বৈঠকে ২১ আগস্ট হামলার চক্রান্ত করা হয় হাওয়া ভবনে বসেই।  

সাক্ষাৎকারে মুফতি হান্নান বলেন, শেখ হাসিনাকে শেষ করে দিতে না পারলে কোনোদিনই রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না। আলী আহসান মুজাহিদ শেখ হাসিনাকে জামায়াত বিদ্বেষী এবং বাবর তাকে চিরতরে শেষ করে দেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন। জনসভায় আক্রমণ করে শেখ হাসিনাকে শেষ করে দেওয়ার মেজর নুরের পরিকল্পনাই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ায় জনসভায় হামলা চালিয়ে হত্যার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।

ঘাতকচক্রের লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বহীন করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে রুখে দেওয়া এবং দেশে স্বৈরশাসন ও জঙ্গিবাদ প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ তা হতে দেয়নি। দেশবাসী এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের বিচারের রায় দ্রুত বাস্তবায়ন দেখতে চায়।  

একইসঙ্গে পলাতকদের গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করা না হলে ষড়যন্ত্রকারীরা আঁটবে নতুন কোনো ছক।  

বাংলাদেশ সময়: ১১৫৫ ঘণ্টা, আগস্ট ২১, ২০২২ 
টিসি/এসএ
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।