ঢাকা: সেনা কর্মকর্তা থেকে সরকারি আমলা, আমলা থেকে কূটনীতিক বনে যাওয়া শমসের মবিন চৌধুরী মাত্র সাত বছরের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে দেশের অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপির ক্ষমতা কেন্দ্রের খুব কাছাকাছি যেতে সক্ষম হয়েছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রে টানা দুই বছর বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে ২০০৮ সালে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে সক্রিয় রাজনীতি শুরু করেন শমসের।
রাজনীতিতে যোগ দিয়েই খালেদা জিয়ার পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পান। ২০০৯ সালে বিএনপির কাউন্সিলের পর দলের ভাইস চেয়ারম্যান হন শমসের মবিন চৌধুরী।
বিচক্ষণ কূটনীতিক ও চৌকস রাজনীতিক হিসেবে খুব স্বল্প সময়ের মধ্যেই বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন তিনি।
খালেদা জিয়ার পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা হওয়ার পর শমসের মবিন চৌধুরীর হাতেই ন্যস্ত হয় বিএনপির পররাষ্ট্রনীতি। অপর দুই উপদেষ্টা রিয়াজ রহমান ও সাবিহ উদ্দীন আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপির বিদেশনীতির নেতৃত্ব দিতে থাকেন তিনি।
২০০৯ সালে দলের ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পাওয়ার পর বিএনপির ওপর শমসের মবিন চৌধুরীর প্রভাব বাড়তে থাকে। ধীরে ধীরে তিনি খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। দলের অনেক স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শমসের মবিন চৌধুরীর সঙ্গে শেয়ার করতে থাকেন খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান।
গত বছরের ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরের এক সন্ধ্যায় লন্ডন থেকে শমসের মবিন চৌধুরীকে ফোন দেন তারেক রহমান। প্রায় ২২ মিনিটের ওই ফোনালাপে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের পালিয়ে বেড়ানো নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তারেক রহমান।
পাশাপাশি সেই সময় চলতে থাকা অনির্দিষ্টকালের অবরোধ ও দফায় দফায় হরতাল কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন তারেক।
এছাড়া জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর মধ্যস্থতায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপির সংলাপের এজেন্ডা কি হবে, সেটিও ঠিক করে দেন বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
শমসের মবিন চৌধুরীর ওপর তারেক রহমানের এতো গভীর আস্থা ছিল যে, ফোনালাপে বার বার বলছিলেন, জাস্ট ডিসকাস উইথ ইউ।
নিচে তারেক রহমান ও শমসের মবিন চৌধুরীর সেই ফোনালাপ হুবহু তুলে ধরা হল।
তারেক রহমান: কেমন আছেন?
শমসের মবিন চৌধুরী: আর আছি কীভাবে। দেশ যেভাবে আছে সেভাবেই।
তারেক: ওবায়দুল কাদের দুই দিন আগে একটা কথা বলেছেন, খেয়াল করেছেন নিশ্চয়?
শমসের: হ্যাঁ, খেয়াল করেছি এবং সেটা কালকে টকশো’তে মাহফুজল্লাহকে দিয়ে বলিয়েছি। ....সমঝোতা হবে, তাইতো?
তারেক: না না, সমঝোতা হচ্ছে পর্দার আড়ালে?
শমসের: হ্যাঁ, সমঝোতা হচ্ছে পর্দার আড়ালে এবং সমঝোতা হলে আস্তে আস্তে ছাড়া পাবে। হঠাৎ কিছু হয়ে যেতে পারে।
তারেক: সমঝোতাটা কারা করছে?
শমসের: ওরা (আওয়ামী লীগ) ওদের নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করছে।
তারেক: আমাদের কারো সাথে কি কথা বলেছে? আপনি কিছু জানেন?
শমসের: আমার জানা মতে, তারা কারো সাথেই আলোচনা করছে না। আজকে তো তারা আলমগীর ভাইয়ের বিরুদ্ধে মার্ডার কেস দিয়েছে।
তারেক: না, সেটা তারা দিতে পারে। কিন্তু উনি এই রকম হাইরেনসিক করছে কেন? উনি তো একজন পলিটিক্যাল লিডার, পলিটিশিয়ান!
শমসের: কে?
তারেক: আলমগীর সাহেব।
শমসের: আমরা একটু পরে ম্যাডামের কাছে যাব। তো, এটা কি আলাপ করব?
তারেক: ওনার ওখানে তো কথা বলা সমস্যা। ডিটেইলস বলাটা মুশকিল। কিন্তু কথা হচ্ছে, এই রকম হাইরেনসিক করে তো রেপুটেশন খারাপ হচ্ছে।
শমসের: এটা তো ম্যাডামকে বলা হয়েছে কয়েকবার। কিন্তু বুঝলাম না, ম্যাডাম তো বিষয়টি আমলেই নিচ্ছেন না, আমি যতটুকু বুঝি আর কি।
তারেক: তিনি (ফখরুল) যদি পালিয়েই থাকেন তাহলে আন্দোলনেও নেতৃত্ব দিতে পারবেন না, কথা বলতে পারবেন না। তিনি তো চুপ করে হাইরেনসিকই আছেন, তো লাভটা কী? এতে আরো খারাপ হচ্ছে তো। ডিস্ট্রিক্টের কর্মীরা মার খাচ্ছেন। আর উনি পালিয়ে আছেন, এতে লাভটা কী হচ্ছে? এতে বেনিফিট তো হচ্ছে না।
শমসের: এই প্রশ্নটা অনেকেই করছে। আমি ম্যাডামকেও দুই তিনবার প্রশ্ন করেছি। ম্যাডামের একটা কথা হলো যে, যদি ওনাকে ধরে ফেলে, সবাইকে ধরে তাহলে কাজ করবে কে মাঠে? কাকে দিয়ে আমি কাজ করাবো?
তারেক: উনি কি খুব একটা কাজ করছেন? কাজ করতে পারছেন? কোনো ইনস্ট্রাকশন দিচ্ছেন? কোনো ডিস্ট্রিক্টেই তো কথা বলছেন না, কিছু হচ্ছে না। কারো খোঁজ-খবর নিচ্ছেন না। লাভ হচ্ছে কী? উনি যে চার্জে আছেন, সেখান থেকে যে ডিসিশন দেবেন, ইনস্ট্রাকশন দেবেন সেগুলোও তো হচ্ছে না।
আই অ্যাম জাস্ট ডিসকাস উইথ ইউ। বোধ হয় এ রকম একটা গুজব ছড়াচ্ছে। আমি যা শুনেছি তাই আপনারে সাথে ডিসকাস করছি। সেখানে আপনারসহ কয়েকজনের নাম আছে। মানে ওবায়দুল কাদেরের ব্যাপারটার সাথে ইনভলভ করছে।
দুই নম্বর হচ্ছে, দেশে এখন গেস্ট আসছেন। তো তারা বলছে যে, গেস্ট আসলে দেশে যেন কিছু না হয়। তো এরকম কি কোনো কিছু চিন্তা-ভাবনা আছে?
শমসের: এখন আমার যা মনে হয়, গেস্টদের জন্য বিরতি দেওয়া, না দেওয়া অর্থহীন।
তারেক: আপনি ঠিকই বলছেন। এখন বিরতি দেওয়ার আর কোনো স্কোপ নেই।
শমসের: হ্যাঁ, এখন তো ডিসপ্রেইজ ইজ জিরো নাও।
তারেক: এখন অন্য কোনো কিছুতে গেলে, তাতে যদি কমফোর্টেবল সিচুয়েশন’ হয়, তাহলে কি আমাদের জন্য খুব ভালো হবে?
শমসের: না, কখনই না। তখন বিরোধী দলের মাঠ পর্যায়ে সবাই হতাশ হয়ে যাবে। ডিমোরালাইজড হয়ে যাবে।
তারেক: ওদের আপ লাইনে আনতে পারবেন না আপনারা?
শমসের: ওদেরকে আর রাস্তায় ফিরিয়ে আনা যাবে না সহজে।
তারেক: ইজ নট পসিবল ফর কোয়াইট এ লং টাইম। আমার যা মনে হয়। কয়েকবার এরকম হয়েছে তো, এ রকম ব্রেক দিয়ে দিয়ে।
শমসের: ব্রেক করার তো কোনো স্কোপও নেই, কারণও নেই, লজিকও নেই।
তারেক: আপনারা তো যাচ্ছেন, উই ক্যান টক। আপনার সাথে বোধ হয় আরো কেউ কেউ যাবেন। তাদের বোধ হয় ব্রেক দেওয়ার একটা চিন্তা-ভাবনা আছে।
শমসের: অন্যরা কি বলে না বলে, বাট দিস ইজ অলওয়েজ মাই পজিশন। এখন টেম্পোরারি ব্রেক দেওয়ারও সুযোগ নেই।
তারেক: এখন ব্রেকে যাওয়াই যাবে না। লেট ইজ কনটিনিউ।
শমসের: আরেকটা বিষয়, তারানকো আসছে ইউএন থেকে। একটু আগে আমাকে ফোন করেছিল। .. সে আমাকে বলল, হিউম্যান রাইটস একটি স্টেটমেন্ট ইস্যু করবে, ক্রিটিসাইজিং, ভায়োলেন্স অ্যান্ড এভরিথিং ইজ রিলেটেড উইথ অ্যারেস্ট নিয়ে। আমি বললাম, আই হোপ ইট ইজ এ ফ্রেন্ডশিপ। তখন সে বলল যে, হোয়াট ইজ দিস সল্যুউশন? আমরা যদি ইলেকশান পিছিয়ে দেই। আমি বললাম, দেখো, সিচুয়েশন ইজ সার্চ। শর্ট গ্যাপ বিটউইন নাও অ্যান্ড ইলেকশান উইল নট সলিউশন এ প্রবলেম, হেজ টু বি লঙ্গার গ্যাপ। এই লঙ্গার গ্যাপটা যদি তোমরা করাতে পারো, যদি তোমাদের একসেস থাকে, সেক্ষেত্রে প্রাইম মিনিস্টারকে দিয়ে যদি কল করাতে পারো, তাহলেই ইটস মাই ওয়ার্ক, আদার দ্যান ইটস মাই নো ওয়ার্ক।
তারেক: না, আপনি গ্যাপ দিয়ে কী করবেন? সলিউশন তো একটাই। শি হেজ টু একসেপ্ট দ্য ডিমান্ড। এখানে ইলেকশানে গ্যাপ দিয়ে আপনি কী করবেন? তাহলে লাভ হলো কী?
শমসের: না ধরো, গ্যাপ বলতে কী। শি রিজাইনস অ্যান্ড পার্লামেন্ট ডিজলভস জানুয়ারিস। যতদিন পর্যন্ত সে থাকুক জানুয়ারির ২০, ২১, ২২ তারিখ পর্যন্ত। তার পরে তো নাইনটি ডে’স পাওয়া যাবে।
তারেক: না না, আপনারা এত দিন দিয়েন না। এরপর কিন্তু বেঁচে থাকা মুশকিল হবে। কিছু লোক ছাড়া বাকিদের বেঁচে থাকা মুশকিল হবে। ডিমান্ড যেটা, শি হেজ একসেপ্ট দি ডিমান্ড রাইট নাও। এখন যেই আসুক। পার্লামেন্ট ডিজলভ হবে এবং সে হেজ একসেপ্ট দি ডিমান্ড। রাইট হেজ দি মোমেন্ট। আপনি এটাকে লঙ্গার করলেই কিন্তু সুযোগ পেয়ে বসবে। একটা সুযোগ দিলেই তারপরে সে বলবে, ২৪ তারিখের পর আমি আর থাকব না। কিন্তু ২৪ তারিখ পর্যন্ত তারা সময় পাবে এবং এর মধ্যেই অন্য কিছু করে ফেলবে।
শমসের: সেটাও ঠিক, দ্যাট অলসো রাইট।
তারেক: আর যেটা প্রোগ্রাম হচ্ছে পাবলিকলি, সেটা কনটিনিউ।
শমসের: কাম ওয়ার্ক মে...
তারেক: আরে কাম ওয়ার্ক মে, এ তো হয়েই গেছে। এসপার-ওসপার তো হয়েই গেছে। এখন ঠিক আছে চলতে থাক। এখন আপনারা যদি এতে ব্রেক দেন, তাহলে ওদের কনসিকুয়েন্সি অন্যরকম হবে। মিনিমাম যাদের পলিটিক্স করার নলেজ আছে, তাদের এটা বোঝা উচিত।
শমসের: বাট আমি কিন্তু নেভার স্পোকেন ফর এ ব্রেক। ম্যাডাম কখন প্রেস কনফারেন্স করবেন, কী এনাউন্সমেন্ট করবেন বাট উই হেজ টু গো আপ।
তারেক: হ্যাঁ, এটা উনি আগামী তিন/চার দিনের মধ্যে করতে পারেন।
শমসের: বাট মেইন অবরোধ চলতে থাকুক।
তারেক: রাইট, অবরোধ নিয়ে তো কোনো কথা হচ্ছে না। অবরোধ টু কনটিনিউ।
শমসের: ঠিক আছে, দেখি আজ যখন ডাকা হবে। আই গিভ উইল মেক দিস সাজেশন।
তারেক: হ্যাঁ, আদারওয়াইজ কিন্তু অনেকেই বেঁচে থাকতে পারবে না। যারা অবরোধ তুলে নেওয়ার প্রপোজ করবে, তাদের ক্যারি করতে হবে এই লাইয়েবিলিটি।
শমসের: ঠিক আছে, তাহলে সেইভাবেই কথা বলব আমি।
বাংলাদেশ সময়: ২৩০০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৯, ২০১৫
এজেড/এএসআর